ছবি: ইন্টারনেট
১ম পর্ব - Click This Link
২য় পর্ব - Click This Link
---এবার বল কী হয়েছে?
---স্যার আমার বিয়ে।
---কী বলছ? বিয়ে? এই বয়সে?
---আমি এই বিয়ে করতে চাই না স্যার। আপনি আমাকে বাঁচান।
---অবশ্যই বাঁচাবো। কিন্তু আগে আমাকে সবটা খুলে বল।
---আমার সৎ মা আমাকে এক লন্ডনী বুড়ো লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। লোকটার লন্ডনে বউ ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি সব আছে। কিন্তু কিছুদিন পর পর লোকটা দেশে আসে। দেশে লোকটা একটা বউ বিয়ে করে রেখে যায়। কিন্তু আগের বউটা নাকি কার সাথে পালিয়ে গেছে। তাই এখন আমাকে বিয়ে করতে চায় সে। বিনিময়ে আমার সৎ মা কে এক লাখ টাকা দিবে লোকটা। পঞ্চাশ হাজার আজ দিয়ে গেছে। আরও পঞ্চাশ কাল বিয়ের পর দেবে।
আসলাম খান হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। কিছু বলতে পারলেন না। আসলাম খানকে চুপ করে থাকতে দেখে বীথি বলল,
---আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না স্যার। আমি আরও পড়াশুনা করতে চাই।
আসলাম খান এবার মুখ খুললেন।
----আমি তোমাকে ঐ বুড়োর হাত থেকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু তাতে তোমার কতটা উপকার হবে বুঝতে পারছি না।
---আপনার কথা বুঝলাম না স্যার।
----আমি যদি এখন সব মুরুব্বীদের নিয়ে এই বিয়ে বন্ধ করতে চাই তাহলে কেউ রাজী হবে না। কারণ গ্রামে প্রভাবশালী বয়স্ক লোকের সাথে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে এখনও একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তাই ব্যাপারটা সমাধান করতে হলে তোমার মায়ের সাথে করতে হবে। বুঝাই যাচ্ছে তোমার সৎ মা লোভী একজন মানুষ। একমাত্র টাকার মাধ্যমেই তাকে রাজী করানো যাবে। এখন ধরো, যে টাকা ঐ বুড়ো দিয়েছে তার দ্বিগুণ টাকা আমি তোমার মাকে দিলাম।
আসলাম খান কথা শেষ করার আগেই বীথি বলে উঠলো,
---না না, আপনি এত টাকা কেন দিতে যাবেন আমার মাকে?
---আমার কথাটা আগে শেষ করতে দাও। ধরো দিলাম এবং বললাম বিয়েটা ভেঙে দিতে। তোমার মা টাকা পেয়ে ঠিকই বিয়েটা ভেঙে দিবে। কিন্তু তখন গ্রামে কথা উঠবে তোমাকে আমাকে নিয়ে। আমি কেন এত টাকা দিয়ে বিয়েটা ভাঙলাম সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। গ্রামের মানুষ কোন সহজ ব্যাখ্যা গ্রহণ করবে না। দারোয়ানও এত রাতে তোমাকে এখানে আসতে দেখেছে। সেও চটকদার গল্প নিশ্চয়ই তৈরি করে ফেলেছে। এসবে আমার তেমন কিছু হবে না। হয়তো একটু স্ক্যান্ডাল হবে আর কিছু না। আর আমি এখানে থাকিও না। সমস্যা হবে তোমার। গ্রামের মানুষের বাঁকা বাঁকা কথায় তোমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তাছাড়া আজ একটা বিয়ে ভাঙলাম, কালই তোমার মা যে আরেকজনকে ধরে আনবে না তার নিশ্চয়তা কী? আজ আমি এখানে আছি। কাল তো আর আমি এখানে থাকবো না। তখন?
বীথির মাথা কাজ করছিল না। আসলাম খানের প্রত্যেকটা কথা সত্যি। ও কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। বড় অসহায় লাগছিল বীথির।
----আমার কাছে একটা উপায় আছে, যদি তুমি রাজী থাকো।
---কী উপায় স্যার?
----আমরা দুজন যদি বিয়ে করে ফেলি তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
বীথি চমকে উঠলো আসলাম খানের কথা শুনে। কী বলছে লোকটা? বউ মরে মাথা টাথা নষ্ট হয়ে গেলো না তো। বীথি বোকার মত চেয়ে রইল। ও ঠিক শুনেছে কী না তাও ভাবতে লাগলো।
----তুমি ঠিকই শুনছ বীথি। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো তোমার কোন ক্ষতি আমার দ্বারা হবে না। হয়তো ভাবছো আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে। তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছি আমি। কিন্তু.....
----না, না। এসব কিছুই আমি ভাবছি না। বরং আমি ভাবছি আমার মত একটা অতি সাধারণ মেয়েকে আপনার মত এত বড় মানুষ কেন বিয়ে করতে যাবে। হয়তো আপনি ভেবেচিন্তে বলছেন না। আমাকে বাঁচাতে ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে ফেলেছেন।
----শোন বীথি, আমি বুঝিয়ে বলছি তোমাকে ব্যাপারটা। আমারও বয়স কিন্তু কম না। আমিও বিবাহিত। তোমার প্রায় দ্বিগুণ বয়স আমার। তুমি সাধারণ বলে নয় বরং আমি তোমার যোগ্য নই বলেই আমার তোমাকে বিয়ে করা উচিৎ নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অন্য কোন উপায় ভেবে পাচ্ছি না। আর এদিকে আমাদের হাতে সময় একেবারেই নেই। আর এই বিয়েকে সিরিয়াসলি নেয়ার কোন দরকার নেই। মনে করো এই বিয়েটা তোমার মা আর গ্রামের লোকের মুখ বন্ধ করার একটা উপায় মাত্র। মনে করো এটা শুধুমাত্র একটা চুক্তির বিয়ে যা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানবে না। সবাই জানবে আমরা সত্যিকার স্বামী স্ত্রী। বিয়ে করে আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।
বীথি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো। কিন্তু এই মুহূর্তে এরচেয়ে ভাল কোন উপায়ও নেই ওর কাছে। দ্বিধাভরা কণ্ঠে ও জিজ্ঞেস করলো,
----কোথায় নিয়ে যাবেন স্যার?
----আমার বাড়িতে। ওখানে থেকে তুমি লেখাপড়া করবে। একটা ভাল কলেজে তোমাকে ভর্তি করে দিবো। তুমি পড়াশুনা শেষ করে নিজের রাস্তা বেছে নেবে। মনে রেখো আমি তোমার উপর কখনোই কোন অধিকার ফলাবো না। যেদিন তুমি তোমার রাস্তা বেছে নেবে সেদিন আমি তোমাকে লিখিতভাবে ডিভোর্স দিয়ে দিবো। এই হলো আমাদের চুক্তি।
-----
আসলাম খানের গাড়িটি এগিয়ে চলেছে রাস্তা দিয়ে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন আসলাম খান আর পাশের সিটে বসে আছে উনার সদ্য বিবাহিতা গ্রাম্য বঁধু বীথি। গ্রামের রাস্তাগুলোতে অনেক বাঁক থাকে। বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা চুপচাপ, কোন কথা না বলে।
মুনিরা বেগম এতটাকা একসাথে হাতে পেয়ে আর কোন বাঁধাই দেননি ওদের বিয়েতে। ভোরবেলা কাজী ডেকে বিয়েটা পড়িয়ে তাড়াতাড়ি ওদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বললেন। নয়তো লন্ডনী বুড়ো বরযাত্রী নিয়ে চলে আসলে আবার সমস্যা হবে। আসলাম খান মুনিরা বেগমকে বলে দিয়েছেন বীথির সাথে উনার সব সম্পর্ক এখানেই শেষ। উনি যেন ওর সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা না করেন। মুনিরা বেগম আর কোন দ্বিমত করেন নি। বীথির খুব খারাপ লাগছিল খোকনের জন্য। কে জানে আর কোনদিন ভাইটিকে দেখা হবে কী না। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছে ও। নিজেকে ওর একটা নিলামী পণ্য ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না। যে বেশি টাকা দিতে পারবে পণ্যটি তার। খোকন টলটলে চোখে চেয়ে দেখছিল বোনের চলে যাওয়া। বীথি অঝরে কেঁদে যাচ্ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল এই বুঝি এই গ্রাম ছেড়ে, ভাইটিকে ছেড়ে ওর শেষ যাওয়া। আর বুঝি কোনদিন ফিরে আসা হবে না এই গ্রামে।
গাড়িতে আসলাম খানের পাশের সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল বীথি। এত দামী গাড়িতে এত বড় মানুষের পাশে বসে নিজেকে বড় মলিন বড় তুচ্ছ মনে হচ্ছিল ওর। কে বলবে পাশের ঐ লোকটার সাথে কিছুক্ষণ আগেই বিয়ে হয়ে গেলো ওর। আসলে ওটা তো কোন বিয়ে না। শুধুমাত্র একটা চুক্তি। তারমানে ঐ লোকটার সাথে ওর কোন সম্পর্কই নেই। আসলাম খান জমিদার বাড়ির ছেলে, এই তথ্য ব্যতীত আর কিছু বীথি জানেও না লোকটি সম্পর্কে। অর্থাৎ একজন অজানা সম্পর্কহীন লোকের সাথে ও পাড়ি জমিয়েছে সম্পূর্ণ অজানা এক ঠিকানায়।
নানা আশংকায় কেঁপে উঠছে বুকটা। আসলাম খান গাড়িতে ওঠার পর থেকে একটা কথাও বলেন নি বীথির সাথে। উনার চোখ স্থির সামনের দিকে। একবার ভুলেও তাকাচ্ছেন না বীথির দিকে। যেন বীথি এক অস্তিত্বহীণ মানুষ। হয়তো বীথি যে উনার পাশে আছে সেটাই উনি ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই বীথি নামের একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। হয়তো এই বিয়েটা উনার মত বড়লোক মানুষের শুধুই একটা খেয়াল। পরক্ষণেই আবার নিজের ভাবনায় লজ্জিত হলো বীথি। কেন ও বারবার এটাকে বিয়ে ভাবছে। আসলাম খান তো বলেই দিয়েছেন এই বিয়েটা শুধুই একটা চুক্তি। একরাশ হীনমন্যতা এসে ছেয়ে ধরলো বীথিকে। সারাটা পথ নির্বাক কাটিয়ে অবশেষে ওরা এসে পৌঁছালো গন্তব্যে।
বিশাল একটা বাড়ির প্রবেশ গেটে এসে থামলো গাড়িটা। বীথি বেশ অবাক হলো। অবিকল স্বপ্নে দেখা সেই লোহার গেট। দারোয়ান গেটটা খুলে দিয়ে সালাম দিলো এবং অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল বীথির দিকে। হয়তো ভাবছে নতুন কোন কাজের লোক নিয়ে এলেন বুঝি সাহেব। এত বড় বিশাল বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতেই এক রাশ ভয় এসে গ্রাস করলো বীথিকে। ঝোঁকের মাথায় সে কি মস্ত কোন ভুল করে ফেললো? গাড়িটি সেই আঁকা বাঁকা ফুলের গালিচা বিছানো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল অট্টালিকার দিকে। দুপাশে ডজন ডজন নাম না জানা রঙ বেরঙের ফুলের গাছ। নাকে এসে লাগলো নানান ফুলের মিশেল ঘ্রাণ।
অট্টালিকার সামনে এসে গাড়িটি থামলো। আসলাম খান গাড়ি থেকে নেমে এসে বীথির পাশের দরজাটা খুলে বীথিকে নামার জন্য বললেন। বীথির মনে হলো এই কন্ঠস্বর ওর ওচেনা। এই গাম্ভির্যের কালো চাদরে মোড়া লোকটি ওর অচেনা। সেই প্রাণচ্ছল আন্তরিক লোকটি ইনি নন। কেমন অন্যমনস্ক, কেমন যেন উদভ্রান্ত। তিনি বীথির দিকে তাকাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তার দৃষ্টিতে যেন বীথি নেই। এক অচেনা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে বীথির বুকটা। গাড়ি থেকে নেমে আসে ও। বিশাল এই প্রাসাদ বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিতান্তই তুচ্ছ একটা কীট মনে হয় ওর। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও।
আসলাম খান যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পান। বীথির হাত ধরে বলেন,
---চলো বীথি। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
আবার সেই আন্তরিক কণ্ঠস্বর। বীথি যেন প্রাণ ফিরে পায়। নাহ, ওর ভয়ের কিছু নেই। আসলাম খানের হাত ধরে বাড়ির ভেতরে ঢোকে ও। জনা দশেক কাজের লোক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। আসলাম খান বীথিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। বীথি দেখতে পেলো সবার চোখেই একটা অবাক তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি। হয়তো ভাবছে, সাহেব আর মেয়ে খুঁজে পেলেন না বিয়ে করার জন্য। এই গেঁয়োটাকেই এখন থেকে ম্যাডাম ডাকতে হবে!
বীথি নিজেকে সান্ত্বনা দিল, যে যা ভাবার ভাবুক। ওর তাতে কিছু আসে যায় না। ও এখানে এসেছে কন্ট্রাক্টে। কিছুদিনেরই তো অতিথি।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:০০