(পর্ব: ৩)
(লেখক তার বাস্তব অবিজ্ঞতা থেকে পাঠকদের উপকারার্থে মত প্রকাশ করেছেন)
(ঝ) অতি লোভী: (১) বিগত ধর্মঘটের পর থেকে কুয়েতের সকল কোম্পানীগুলোতে মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ৪০ দিনার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায়-১০,০০০/= দশ হাজার টাকা। মাসিক বেতনও মাসে দিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া নতুন বাংলাদেশী আসতে না পারায় অনেকে আবার ডবল ডিউটি করছেন- যে কোন ভাবেই আপনি ৮০/১০০ দিনার বেতন পাচ্ছেন। কেউ ধৈর্য্য ধারণ করে না সবর করেন না শুকরিয়াও আদায় করেন না। মনে রাখবেন সবরে নেয়ামত। আল্লাহ সবরকারী ধৈর্য্যশীলদের ভালবাসেন।
(২) ব্যবসা-বাণিজ্য : হাসাবিয়া মুরগাব, মাহবুলাহ সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রত্যেক বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার হাট বসে। বাংলাদেশের মত সব কিছু বেচা বিক্রিও করছেন। পুলিশ আসলে সব ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালান। কেন পুলিশের নাকানী চুবানী খাবেন? এখন তো মোটেমুটি ভাল বেতন পাচ্ছেন এবার এ বদ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন। ভারতীয়, পাকিস্তানী, শ্রীলংকান এরা কি আমাদের মত এসব করছে। আমাদের সকলের এ সব বুঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুক। আমীন
(৩) আমাদের দেশের এ এদেশে ৩ বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। আমাদের দেশে নভেম্বর ডিসেম্বর ও এদেশে মার্চ, এপ্রিল মে মাসে বিশেষ করে গ্রীষ্মের ছুটিতে। ঠিক এমনি এক অনুষ্ঠান মাস ব্যাপী। স্থান ফাহাহিল থেকে অনেক দূরে প্রায় সৌদি বর্ডার এর কাছাকাছি। এটা ছিল (কেপিসি) কুয়েত পেট্রোলিয়াম কোম্পানীর। আমাকে ৪০ জন পুরুষ মহিলা দিয়ে সেখানে পাঠানো হলো। প্রত্যেক দিনই হোটেল শেরাটন, কালটন টাওয়ার, মেরিয়ড, হোটেল শাফির ইন্টারন্যাশনাল থেকে খাবার নিয়ে আসা হয়। কুয়েতীর খাওয়া শেষে বাঙালীদের খাওয়া শুরু হয়। আশেপাশের অনেক কুয়েতী বসা থাকে। কি হুলুস্থল কান্ড হৈ চৈ কেউ খাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি কেউ ব্যাগে ভরছে কেউ পকেটে পুরছে কেউ একটার বদলে ১০টা মুখে পুড়ছে। শেষে দেখা গেল অনেকে খাওয়া পেলোও না। এসব দেখে অনেক কুয়েতীরা হাসাহাসি করছে। আমি লজ্জায় জিহ্বায় কামড় দিয়ে রইলাম। কেন আমাদের এসব লজ্জার কাজ করতে হবে? আমরা কি সুন্দর ও শৃঙ্খলভাবে ভদ্রতার সহিত টেবিলে যে ভাবে সাজানো আছে সেখান থেকে ভদ্রতার সহিত সব কিছু সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসে বসে খেতে পারি না? সবার খাওয়া শেষে বেঁচে থাকলে এগুলো যাদের প্রয়োজন ভাগ করে নিতে পারি না? রাত ১০/১১টায় বাসায় নিয়ে গিয়ে নিজেও খেলেন না অন্য কেও খেতে দিলেন না। নষ্ট করে ময়লার ডাষ্টবিনে ফেললেন। কি লাভ হলো? এভাবে আর কত লজ্জিত করাবেন। দয়া করে এসব বন্ধ করুন। খাওয়া কি দেখেননি? একটু লজ্জা শরম থাকা উচিত।
অনুষ্ঠান শেষে কুয়েতীরা বিভিন্ন পুরস্কার পেল। বাংলাদেশীরা সে মালটা তার গাড়ীতে উঠিয়ে দিলে কোয়ার্টার দিনার, আধা দিনার, এক দিনার দেয়। এ লোভে সে মালামাল গাড়ীতে উঠানোর দৃশ্য কেউ চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। একজন একজনকে দিয়া এসে আবার দেওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি। আমরা কি সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে এ কাজ সমাধা করতে পারি না। একজন একবার নিয়ে অন্যজনকে একবার নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারি না। এ দৃশ্য যে সমস্ত কুয়েতী অন্য দেশীয়রা দেখেছেন, বলুন তারা আমাদের সম্পর্কে কি বলাবলি করছে। দয়া করে বাংলাদেশী জাতিকে আর লজ্জিত করবেন না।
(ঞ) গুজব : ভিন্ন দেশীদের তুলনায় আমরা বাংলাদেশীরাই গুজবে কান পাতি, সাথে সাথে সত্যি মিথ্যা বিচার না করে আরও অতিরিক্ত করে অন্যের কাছে প্রকাশ করি। শ্রোতাও শুনে তার শত ভাগ মিথ্যা বলে অপরের নিকট প্রকাশ করি। আমাদের এসব বদ অভ্যাস থেকে বেঁচে থাকতে হবে। যা নিজ চোখে দেখেছেন তা বলুন কিন্তু অতিরিক্ত কেন? বাঙালীকে হাইকোট দেখানোর মতই। নিজের পিছনের অংশের খবর রাখেন না আর খবর রাখেন অন্যের গীবত, খবর রাখেন আমেরিকার। বাড়ীতে ভাত, ডাল, আছে কিনা এসবের খবর আগে রাখুন তারপর অন্য সব।
(ট) মিথ্যা প্রচার : হাসাবিয়া থেকে পুলিশ একজনকে ধরে নিয়ে গেল। আপনি বাসে এসে বললেন আমি এখন হাসাবিয়া থেকে ২ গাড়ী লোক ধরে নিয়ে যেতে দেখেছি। শ্রোতাও অন্য জায়গায় গিয়ে বলল ১০০ জন ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের এ সমস্ত গুজব থেকে বেঁচে থাকতে হবে। চিলে কান নিয়ে গেল বলে চিল্লাচিল্লি করলে হবে না। নিজের কানে হাত দিয়ে দেখুন কান আছে কিনা? আল্লাহ আমাদের এসব থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।
(ঠ) উৎসুক : হাসাবিয়া বাস ষ্ট্যান্ড এর পাশে ১টি পুলিশের গাড়ী থামল হর্ণ বাজিয়ে। একজনকে ধরল হাওয়াইয়া (সিভিল আই.ডি) চেক করে ছেড়ে দিল অথবা না পেয়ে গাড়ীতে উঠালো। দেখা গেল রাস্তার উভয় পার্শ্বে দোকানের বারিন্দায় বা সিঁড়ি গুলোতে হাজার হাজার লোক উৎসুক হয়ে তা দেখছে। পুলিশ তা দেখে আরও বেশী করছে অথবা তার সাথীদের বলছে দেখ বাঙালীদের অবস্থা। আমরা এভাবে কেন তাকিয়ে থাকবো? আমাদের এসব খাছলত পরিবর্তন হবে না?
খ্রিস্টানদের বড় দিন : প্রতি বৎসর ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ খ্রিস্টানরা বড় দিন পালন করে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন বাসা বাড়ীর মহিলাদের ছুটি থাকে। মালিয়া হোটেল শেরাটনের পার্শ্বে রয়েছে তাদের বড় গির্জ্জা। এমনিতেই প্রতি রবিবার তাদের প্রার্থনার ছুটিতে মালিয়া স্থানটি ফিলিপিন, হিন্দু, খ্রিস্টানদের রম রমাট আড্ডায় পরিণত হয়। দোকান পাটগুলোতে অসংখ্য ভীড় থাকে। ঐ স্থানে একই সময়ে বাংলাদেশী ভাইয়েরা ২/৪/৫, ১০ জনের দল বেঁধে ছুটছে সেখানে। সুযোগ বুঝে মেয়েদের সাথে টিপটিপি করে অযথা ভিড় বাড়ায়। তাদের শরীরের সাথে শরীর লাগায়, বলে কি একটু ভাল লাগে। যত খ্রিস্টান বা ভিন্নমতাবলম্বীদের দেখা যায় না তার চাইতে হাজার গুণ বেশী মুসলমান বাংলাদেশীরা ভিড় করে। কেন আপনারা যান? কি পান? দয়া করে এবার এ সব থেকে বিরত থাকুন। সৎ হউন। একটু ভাল হওয়ার চেষ্টা করুন।
(ঠ) দেশে যাওয়া আসা এবং স্ত্রীর হক : আপনার প্রতি যেরূপ স্ত্রীর হক রয়েছে। স্ত্রীরও তেমনি আপনার প্রতি হক রয়েছে। এখন দেখা যায় অনেকে ১০/১৫/২০ বৎসরে ও বাড়ী যান না। অনেকে আবার নতুন বিয়ে করে ১, ১১/২ , ২ মাস থেকে চলে আসে। আবার ৫/৭ বৎসরেও বাড়ী যাওয়া হয় না। মাঠের (ঘাসের) মাঝখান দিয়ে যখন মানুষ চলাচল করে তখন এটা রাস্তা হয়ে যায়, ঘাসগুলো উঠে যায়। সরকারের সর্বনিম্ন নিয়ম অনুসারে প্রতি বৎসর ২০ দিন ছুটি। ২ বৎসরে ৪০দিন ছুটি। আপনি ইচ্ছা করলে অন্ততঃ প্রতি ২ বৎসর অন্তর ৪০ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ী-ঘরে ঘুরে আসতে পারেন। অনেক বলে বেতন ১৭ দিনার কত দিনে টিকেটের পয়সা জমা হবে। মোটামুটি সবাই ভাল বেতন পাচ্ছেন। নিুতম বেতনও কম হলে ১০ হাজার টাকা। চিন্তা করছেন দেশে কত বেতন পায় একজন বিএ এমএ পাশ ? এর শুকরিয়া আদায় করুন। অনেকে বলে যে কাজে আছি দেশে থেকে আসলে ঐ কাজ নাও পেতে পারি। সব কিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিন। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন। আল্লাহকে বড় বন্ধু হিসাবে জানুন- তাহলে দুনিয়াও আখেরাতে লাভবান হবেন।
(ড) বহনের মালামাল : অনেকে বাড়ী যাওয়ার জন্য কম্বল তোষক টিভি ফ্রিজ, কসমেটিক্স সাবান ইত্যাদি কিনে ৭০/৮০ কিলো মাল হয়ে যায়? দেশে কি কোনটার অভাব আছে? টাকা দিলে সবই তো পাওয়া যায়। এছাড়া দেশের টাকা দেশে রইল। দেশকে ভালবাসুন। আমরাই দেশের গর্ব। বাংলাদেশ বিমান, কুয়েত এয়ার ওয়েজ ৪৫/৫০ কিলো অন্যান্য ৩০/৩৫ কিলো মাল নেওয়ার সুযোগ দেয়। আপনি সে সুযোগ গ্রহণ করেন। মাল বেশী হলে কিলোতে ২/৩ দিনার করে বা ঘুষ দিয়ে নিয়ে যান। ঘুষ দেওয়া নেওয়া উভয় গুনাহগার। অথবা ওয়াস্তা খোঁজেন। দরকার কি এ সবের? বাড়ীর চৌদ্দ পুরুষের সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হবে এমন কথা ছিল নাকি? ভারতীয়, পাকিস্তানী, শ্রীলংকান (বাসার মহিলা ব্যতীত) তারা একটি ব্রিফকিস নিয়ে চলে যায় না? তারা ইচ্ছা করলে কি এসব নিতে পারে না? সবার প্রতি অনুরোধ রইল অন্তত প্রতি ২ বৎসর অন্তর অন্তর একবার বাড়ি যান।
বিমান / কর্তৃপক্ষ: ভারতীয়রা এয়ার ইন্ডিয়া, পাকিস্তানীরা পিআইএ, শ্রীলংকানরা এয়ার লংকা ব্যতীত অন্য কোন বিমানের টিকেট তারা খুব সহজে কাটে না। আমরা কি বাংলাদেশ বিমানের উপর নির্ভর করতে পারি না। অনেকে বলেন, এ বিমান নিয়মিত সার্ভিস দেয়না ঠিকমত যাওয়া আসা করে না সময় মত গন্তব্য স্থলে মালামাল পৌঁছায় না। সেবিকারা ভাল সেবা বা উন্নত খাবার দেয় না ইত্যাদি অভিযোগ। বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে আমিও এ অভিযোগ তুলে ধরলাম। আপনারাও অভিযোগ তুলে ধরুন। তবে মনে রাখুন দেশের প্রতি যাদের অগাধ ভালবাসা আছে তারা কখনও বাংলাদেশ বিমানকে ছাড়বেন না এ আমার একান্ত অনুরোধ।
(ঢ) ফোন / মোবাইল / অপচয় : অপচয় কারী শয়তানের ভাই (আল কুরআন) আমরা সবাই জানি। সিগারেট পানকরা অপচয়। এটা আমি বললে বন্ধ হবে না। কিন্তু দেখা যায় ফোনের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা অপ্রয়োজনীয় কথা বলে পয়সার অপচয় করছেন। আরও বলে অসুবিধা কি? সারাদিন কথা বললে ‘১ দিনার যায় না। দেখুন এখন গ্রীষ্ম মৌসুম/ এখানে যদিও গরম বেশী পড়ে তবে আমরা পাচ্ছি এয়ার কন্ডিশন। ঠান্ডা পানির জন্য রয়েছে ফ্রিজ। আমাদের দেশে প্রচন্ড গরম সিংহভাগ লোকই এই গরমে তারা কষ্ট করেন, এমন কি সবার বাড়িতে ফ্যানের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। তারপরও মাঝে মাঝে থাকে না বিদ্যুৎ, লাকড়ির অভাবে আগুন জ্বালাতে পারে না, মশার কামড় তো আছেই পয়সার অভাবে খাওয়া জোটে না আবার এয়ার কন্ডিশন? আপনার আশে পাশে আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীরা কত কষ্ট না করছে? একটু চিন্তা করে চোখ খুলে দেখুন। দেশের একজন গরীব মানুষ কত কষ্ট করে রিক্সাওয়ালা বা শ্রমিক (পুরুষ-মহিলা) কয় দিনে ২৫০ টাকা রোজগার করছে। দয়া করে তাদের জন্য সেই ২ দিনার বা ২৫০/ ৫০০ টাকা বাড়ী পাঠিয়ে তাদের দিতে বলুন না। শুধু নামাজ পড়লে হবে না, মনে রাখবেন অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া বড় এবাদত। হয়তো আমাদের ছবি, টিভিতে থাকবে না। পত্রিকায় ছাপা হবে না, কিন্তু আল্লাহতো দেখছেন এ বিশ্বাস রাখুন অন্তরে, মন খুশী হবে।
দ্বিতীয় পর্ব এখানে...
প্রথম পর্ব এখানে...
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






