আমাদের দাম্পত্য সর্ম্পকে সহসাই এক নতুনমাত্রা যোগ করেছে করোনা। কোয়ারেন্টাইন বলুন আর বন্দী জীবনই বলুন, স্বামী স্ত্রী সবার জীবনেই এই ভাইরাস টক-ঝাল-মিষ্টির একটা মিশ্র অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে। ছুটির দিন ছাড়া যাদের দিনেরবেলা দেখা-সাক্ষাত হওয়াই দূরহ ব্যাপার ছিল, আজ তারা দিন-রাত চব্বিশটা ঘন্টা একসাথেই কাটাচ্ছে। এই দুঃসময়ে নিদারূন দাম্পত্য জীবনে এদের দিন-রাত পঞ্জীগুলির অবস্থা অনেকটা যেন এইরকম-
.
অসহায় স্বামীরাঃ জীবনের সাধ আহ্লাদ ইতিমধ্যেই সব জলাঞ্জলি দিয়ে কেরানি-বৃত্তিক মানসিকতা নিয়ে চরম একঘেঁয়ে পুরোমাত্রায় যান্ত্রিক মানুষে পরিনত হবার পর, বাচ্চাকাচ্চা বড় করার সংসার নামক মেসিনে গভীর এঁটেল মাটির কাদায় প্রতিনিয়ত লেপ্টালেপ্টি করে দিনরাত কাটাছে। দিনের কিছু মুহূর্ত বাইরে কাটিয়ে যাও আগে নিজেকে কিছুটা সান্তনা দিতে পারতো, এখন সেটাও সাময়িকভাবে বন্ধ। জীবনটা এখন এদের জেলখানায় বন্দী কয়েদীদের মতো, পৌরুষত্বের অহমিকা এখন গর্তে লুকিয়েছে। ছড়ানো ছিটানো কিছু স্বাধীনতা আর বাইরে বেড়ানোর মুক্তির ঝাপ্টা পুলিশ আর আর্মির ডান্ডাবেড়ির ভয়ে কোথায় পালিয়ে গেছে এরা এখন নিজেরাও জানে না। বন্দী এই জীবনের অসহায়ত্ব নিয়ে দার্শনিক হয়ে যে এই বন্দীর দিনগুলি কাটাবে সেটারও উপায় নেই। প্রতিনিয়তই বৌ’রা সামান্য তেল-নুন-চালের নৈমিত্তিকতায় এদের জীবন কেন এত দুর্বিসহ করে তুলে সেটা এদের ছোটমাথায় কিছুতেই ঢুকে না। হায়রে জীবন আর হায়রে সংসার!!! নিকুচি করি এই গন্ডারের মত চামড়ার জীবনের.........
.
অসহায় স্ত্রীঃ জীবনের সব স্বপ্ন বিয়ের সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেছে। প্রতিদিন রান্নাঘরের চুলায় হাড়ি-পাতিল আর ডেকচি ঠেলতে ঠেলতে সংসার আর দাম্পত্য প্রেম নিয়ে যে মধুর রূপকথাগুলি ডিস-চ্যানেলগুলিতে দেখেছিল আর রোমান্টিক বইগুলিতে পড়ে এসেছিল তা অনেক আগেই রঙ্গীন থেকে ফ্যাঁকাসে হয়ে এখন পুরোদস্তর সাদাকালো হয়ে গেছে। তারপরও অজানা কোন এক টানে নিজের শরীর মন না চাইলেও নিতান্ত মূল্যহীনভাবে সংসারের সব কাজ করে যেতে হচ্ছে চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। একঘেঁয়ে মানুষে পরিনত হয়ে বাচ্চাকাচ্চা বড় করার সংসার নামক মেসিনে গভীর বেলে আর এঁটেল মাটির মিশ্রণের কাঁদায় প্রতিমুহুর্তে লেপ্টালেপ্টি করে এদেরও দিনরাত কাটছে নিতান্তই অসহায়ভাবে। স্বামী নামক বজ্জাত পুরুষজাত’টাকে বশ করার সবরকম কলা কৌশল প্রয়োগ করার পরেও কিভাবে যেন ফাঁকফোকর গলে ঠিকই এরা নিজেদের ধান্দায় থাকে। কিছুটা পারস্পরিক সমঝোতা আর বোঝাপড়ার অভাবে এদের মেজাজ থাকে এখন মুখরা। এর মধ্যেই করোনা নামক একটা বিশ্ব-বেঈমান ভাইরাস এসে ইতিমধ্যেই দূর্বিসহ হয়ে যাওয়া জীবনটা আরও যন্ত্রনাদায়ক করে তুলছে। আগে সারাদিন বাইরে থাকতো, অন্ততঃ কিছুটা সময় বাসায় নিজের মতো করে থাকা যেত। এখন সেই একান্ত নিজের সময়গুলিও হারিয়ে ফেলে প্রায়সই এরা মারমুখী হয়ে উঠে। বাসায় আগে যেসব কাজ কাজের-বুয়া এসে করে দিয়ে যেত, এখন দৈনন্দিন সবকাজের সাথে এই কাজের-বুয়ার কাজও করতে হচ্ছে নিজেকে। অথচ ঘরের মধ্য ঘুমিয়ে, বসে থেকে পাষন্ডটা সাহায্য করা তো দূরের কথা, একের পর এক মোঘল বাদশাদের মতো হুকুম দিতে থাকে। রাগে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে খুনতিটা এনে.........
.
পৃথিবীর বুকে এই বৃহত্তর জীবন নামক নির্মম যুদ্ধে স্বামী বা স্ত্রী সবাই ইতিমধ্যেই নিরংকুশভাবে পরাজিত হয়েছে। এখন শুধুই সংসারের এঁটোকাটার ভাগ নিয়ে প্রতিনিয়ত মারমার কাটকাট করে এরা দিনাতিপাত করছে। যেমন তাজ্জব ব্যাপার এত সময় একসাথে এদের থাকাটা, ঠিক তেমনই তাজ্জব সব ব্যাপার ঘটছে এটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। নিউটনের তৃতীয়সূত্র মতে প্রতিটা ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত মূখী প্রতিক্রিয়া থাকলে সম্ভবত করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দাম্পত্য সর্ম্পকের এই নব্য ভার্সনের প্রতিক্রিয়া একেক জায়গায় একেক রকম দেখা যাচ্ছে।
.
কয়েকদিন আগে পড়লাম চায়নাতে এত লম্বা কোয়ারেন্টাইনের প্রভাব এসেছে ভয়াবহ ভাবেই। বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য এই কয়দিনেই নাকি মাত্রাতিরিক্ত আবেদন সরকারের কাছে জমা হয়েছে। সম্ভবত বৈবাহিক জীবনে এরা প্রথমবারের মতো এত সময় একসাথে কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চাইনিজ কুংফু কারাতি’র সিনেমা দেখে আসা আমাদের কাছে বরং এই প্রতিক্রিয়া বড়ই বিষ্ময়কর! এইসব সিনেমা যে আসলেও শুধু সিনেমাই, করোনা সেটা প্রকৃষ্ঠভাবেই প্রমাণ করে দিয়েছে। তা না হলে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদনের জায়গায় চায়নার হাসপাতালগুলিতে করোনা-রুগীর জায়গায় পঙ্গু-রোগীর সংখ্যাই হু হু করে বেড়ে যাবার কথা!
.
আমাদের পাশের দেশেই পশ্চিমবঙ্গে আবার ঘটনা ঘটছে উলটো। সারাদিন এদের সব চ্যানেলে পরকিয়া সম্পর্কের নাড়ি নক্ষত্র দেখানো হলেও এখানে কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কে যেন প্রণয়ের মধুময় বাতাসের ঝড় উঠেছে। সেদিন পড়লাম সেখানে নাকি এখন জন্মনিরোধক সামগ্রীর ফেস মাস্কের মতোই হাই ডিমান্ডে আছে। ইকনোমিক্সের থিওরী মেনে সাপ্লাই কম থাকার কারণে এটার যথারীতি দামও আকাশচুম্বী অবস্থা! তাও নাকি কেনার জন্য হাহাকার অবস্থা! দাদারা নিজেরা করে এক কাম আর চ্যানেলগুলিতে দেখায় আরেক আকাম! করোনা দাদাদের আসল চরিত্রও আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেল! সাবাস করোনা!
.
মানব জীবনে বিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ইসলামে বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমেই ঈমানের পূর্ণতা পাওয়া যায়। বিয়ে শুধু শারীরিক চাহিদা বা ঈমাণ পূর্ণ করে তাই নয়, মনুষ্যত্ব এবং ব্যক্তিত্বেরও বিকাশও ঘটায়।
.
ভুলে যাই আমরা সবাই রক্ত মাংশের মানুষ, দোষ-ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষ। ভুলে যাই প্রতিটা মানুষের জীবনই অপূর্ণ। আর তাই পূর্ণতাকে কাছে পাবার জন্য, দেখার জন্য মনের ভিতরে সুতীব্র আকাংঙ্খা নিয়েই আমরা বড় হই। সবার দাম্পত্য জীবনের সঙ্গীর অবস্থাও কিন্তু একইরকম। নিজে অপূর্ণ থেকে কেউ আরেকজনকে পূর্ণ করতে পারবে না। দাম্পত্য সঙ্গীর কাছে অহেতুক এই আকাশচুম্বী আশা করে কোনই লাভ নেই। সবাই নিজের কষ্টগুলোকে সহ্য করতে না পেরে রাগ অভিমান জীবনসঙ্গীর ঘাড়ে ঢেলে দিতে চায়। ভুলে যায় নিজের কষ্ট নিজেকেই সহ্য করে কমিয়ে আনতে হয়। তা না হলে হুট করে একদিন দেখবেন সেই কষ্টগুলো জমে জমে হিমালয়ের চেয়েও বড় আকার নিয়েছে। আপনার সঙ্গী আপনার কোন কষ্টই কমাতে পারবে না। বরং নিজেদের মধ্যে শ্রদ্ধা আর সম্মানের সর্ম্পক থাকলে আপনাকে প্রচুর মানসিক শক্তি দেবে এইসব কষ্ট পার হয়ে আসার।
.
পুরুষরা তো ঘরেই বসে থাকেন। আজাইরা ফেসবুক আর সোসাল মিডিয়াতে অনর্থক সময় না দিয়ে নিজের জীবনসঙ্গীকে রান্নাঘরে যেয়ে সংসারের কাজে সাহায্য করে আসুন। বাসায় অন্ততঃ নিজের বাচ্চাগুলিকে পালতে বৌ’কে সাহায্য করুন। বিয়ের এতবছর পরেও অবাক হয়ে দেখবেন, এতদিনের চেনা মুখরা বৌ’ও অকারণেই লাজুক লাজুক চেহারা নিয়ে অসময়ে এসে আপনাকে চা কফি কিছু লাগবে নাকি জিজ্ঞেস করবে!!!
.
মেয়েরা না হয় এই দূঃসময়ে নিজের একান্ত সময়গুলি একা একা না কাটিয়ে তার কিছুটা নিজের জীবনসঙ্গীর সাথে কাটানোর চিন্তা করুন। নিজের বাচ্চা না শাশুড়ীর বাচ্চা, কে বেশি জ্বালায় সেটা নিয়ে আজাইরা ফেসবুক আর সোসাল মিডিয়া গরম না করে এটার কারণ খোঁজার চেষ্টা করুন। যেই জ্বালাক না কেন, কি করবেন জ্বালালে? ফেলেও দিতে পারবেন না, রেখে পালিয়েও যেতে পারবেন না। সুতরাং অনর্থক হা-হুতাশ করে অন্যের কাছে কুবুদ্ধি না চেয়ে নিজের সংসারের সমস্যা নিজেই সমাধান করুন। আপনার সমস্যা অন্য কেউই সমাধান করে দিতে পারবে না। জ্বালানোর মানুষগুলি'কে একান্ত সময়গুলি দিন, খুব কাছাকাছি থাকুন। যত কাছে থাকবেন, অবাক হয়ে দেখবেন এরা ততই কম জ্বালাচ্ছে। খুব শিঘ্রই এরা আর কেন জ্বালাচ্ছে না সেজন্যই অবাক হয়ে যাবেন!!!
.
মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন শরীফে ঘোষণা করেছেন-
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً
অর্থাৎ ‘(আল্লাহ’র বহুনিদর্শনের মাঝে এটিও একটি) যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা রুমঃ আয়াত ২১)
.
আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৭নং আয়াতে এরশাদ করেন: ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাক স্বরূপ আর তোমরা তাদের জন্য পোশাক স্বরূপ’। অর্থাৎ পোশাক যেমন করে মানব দেহকে সকল প্রকার নগ্নতা, অশ্লীলতা, কুশ্রীতা ইত্যাদি থেকে বাঁচিয়ে রাখে ঠিক তেমনি বিবাহর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে সেভাবে বাঁচিয়ে রাখে।
.
আসুন এইসময়ে আমরা নিজেদের একান্ত ব্যক্তিজীবনের কাজগুলিকে আলাদা করে রেখে শৃংখলা, ধৈর্য, সাহসিকতা, সহমর্মিতা নিয়ে জীবনসঙ্গীরা একে অপরের পাশে যেয়ে দাঁড়াই, সাংসারিক কাজে মনোনিবেশ করি। কারণ দিন/রাত শেষে এই সংসারটা কিন্তু আপনাদের দুইজনেরই। নিজেরা যেই আচরণ করবেন অপরজনের কাছে থেকে ঠিক একই ফলই পাবেন। নিজে বীজ লাগাবেন ধুতরা গাছের আর আশা করে আছেন নিয়মিত আম্রপালী খাবেন সেটা তো সম্ভব না।
.
কোয়ারেন্টাইন / লক ডাউন / বন্দী জীবনের এই সময়গুলিতে এতদিন যা যা করে এসেছেন সেইগুলিকে পূনরায় নিজেরাই মূল্যায়ন করে দেখুন। এতদিন কি সঠিক রাস্তায় হেঁটেছেন নাকি উলটো রাস্তায় না জেনেই দৌড়িয়েছেন?
.
.
এই সিরিজের আগের লেখা পড়তে চাইলে-
তোমার স্ত্রী, তোমার অনুপমা সঙ্গী!
.
.
সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।
জনস্বার্থে – নীল আকাশ@সামহ্যোয়ারইন ব্লগ,
কপিরাইট @ মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:৫৬