somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অমানিশায় ভেসে যাওয়া একটুকরা মেঘ.....অধরা

০১ লা জানুয়ারি, ২০১১ ভোর ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায় অধরা।আরও একটা বছর শেষ হয়ে গেল।
নতুন একটা ক্যালেন্ডার লাগবে ,মনে পড়ে গেল,ছোটবেলার কথা!!বাবার অফিস থেকে দেয়া ক্যালেন্ডার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।প্রত্যেক রুম এ মনে করে এই দিনপন্জির প্রতিস্হাপন টা বেশ উপভোগ করত।
আশেপাশের আত্মীয় স্বজনরাও দিত নতুন নতুন ক্যালেন্ডার।
কোনটা সুন্দর সেটা যেন তাঁর রুমে যায়,কি সতর্ক নজর তখন!
আর আজ........
কিছুই যেন স্পর্শ করছেনা।
নতুন একটা রাখার কথা কাজ ই করছেনা মাথায.!নাহ!!একদম ই করেনি বললে মিথ্যা বলা হবে,কিন্তু সত্য কথা হল,ইচ্ছা করেনি,এখন আর কোন কিছুই ইচ্ছা করেনা যেন।সবকিছু কেমন যেন নির্লিপ্ত লাগে,রাগও হয়না,আনন্দ ও না,এমনকি দু:খ বোধটাও কমে গেছে মনে হয়।নিজেকে মাঝেমধ্যে জমে যাওয়া বরফ লাগে!!
যেই বরফ আরও জমতেও ভুলে গেছে,গলতেও,
তার যেন সারাটা কাল এমনি হিম বরফ হয়েই থাকার কথা..........

শখের বারান্দায় এসে দাড়ালো অধরা।
কত দিন বিকাল বেলা এই বারান্দার ধারে বসে কাটিয়ে দেয়া..
সাদা রংএর হাফ রেলিং বারান্দাটাকে ঘিরে কত শত ছোট ছোট স্মৃতি!

অনেক আগে,যখন অধরা ছোট ছিল,তখন এই বারান্দায় চলে আসত সারাবাড়ি দৌড়ে।আর পিছনে থাকত মা,,,হুম,,, মা!!
হাতে থাকত অধরার প্রিয় কার্টুন আঁকা প্লেটে করে ভাত।
কখনও স্হির হয়ে বসে খেতনা সে।মাকে জালানোটাই যেন তার সবচেয়ে বড় কাজ ছিল তখন।
আর বাবার কাছে গল্প শুনতে চাওয়া,বাসার সামনের ক্লাবটায় যখন ঈদ উপলক্ষে আলোকসজ্জা হত,বাবার গা ঘেষে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখা,আর মুগ্ধতা ভরে ভাবতে থাকা -কি সুন্দর!!!!!!!! -সবই তো এই বারান্দাতেই.....।

আর পরে যখন ছোট বোন অজয়ার জন্ম হল,এই বারান্দা থেকেই দেখেছিল হাসপাতাল থেকে মা কে ছোট একটা গোলাপী তোয়ালে মোড়ানো বাবুকে নিয়ে আসতে।

পরবর্তীতে অজয়া আর তাঁর সব হাড়িপাতিল খেলার রান্নাঘরটাও তো ছিল এই বারান্দাটা।
দুই বোনে মিলে স্কুলে যাওয়ার সময়,এই বারান্দাতে দাড়ানো মাকে শেষ একবার বিদায় দেয়া।
রাগ হলে,মন খারাপ হলে এই বারান্দাতেই চলে আসত অধরা ।
এখনও আসে।এতটুকু ছোট একটা জায়গা,কিন্তু কত অনুভুতি আর স্ম্বতির নীরব সাক্ষী আজ!
কে বলে শুধু মানুষই পারে স্মৃতি ধরে রাখতে??
এই বারান্দাটাও তো জানে,কতবার কেঁদেছে অধরা।কতবার মন খারাপ হয়ে তাকিয়ে থেকেছে আকাশের দিকে!!
মাঝেমধ্যে মনে হয় জীবের চেয়ে জড় বস্তুরই ধারণক্ষমতা বেশি!
এই যে,...মা -টা।ঠিকই তো চলে গেল।কিন্তু এই বারান্দাটা তো এখনও ঠিকই মা-র স্মৃতি ধরে আছে!
এই যে সে-সেও তো চলে যাবে,
বারান্দাটা কি ভুলে যাবে তখন অধরাকে??

চোখটা ছলছল করতে থাকে অধরার।

এই বারান্দার সবটা জুড়ে তো ওর স্পর্শ লেগে আছে।

চুপকরে সারাটা রাত কাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।কতদিন এখানটায় বসে ভোর দেখা হয়না,
এই বিচ্ছিরি অসুখটা হবার পর থেকে কত কিছুই যে আর করা হয়না।চার বছরের ছোট বোনটাও যেন বড় মুরব্বি হয়ে গেছে।আর বাবা!তার দিকে তাকালেই ভেতরটা হুহু করে উঠে!!
আর একজনের কথা মনে পড়ে।

শৈবাল!!

এই বারান্দাটা এই অল্পকিছুদিনের ভালবাসাটারও সাক্ষী।
অধরা তখন ক্লাস নাইনে উঠেছে।একই কোচিং এ পড়ত তারা।ছেলেটার নামটা নিয়ে বায়োলজি ক্লাসে যেন মাত্রাতিরিক্ত বেশিই পঁচানো হত।
এভাবে পঁচানি বকাবকি থেকেই আস্তে আস্তে কিভাবে যেন কাছে চলে আসা।একসময় ভালবাসায় মেতে উঠা দুই কিশোর কিশোরীর,কি অদ্ভুত আহলাদি কাজ কারবার!
অনেক খুনসুটি হত,কিন্তু কখনও ঝগড়া হয়নি।রাগ করে থাকা হত,শৈবাল এসে বাসার নিচ থেকে ফোন করতেই থাকত!তারপর যখন অধরা বারান্দায় যেত কত রকম করে যে ক্ষমা চাইত।
আর রাগ ধরে থাকতে পারতনা অধরা।সেও যে শৈবালকে তার নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসে।
তিন বছর পার হয়ে যায়।কলেজে উঠে বড় বড় ভাব দুইজনেরই,নিজেদের কত কিছু মনে হয় তখন।
পরিণত লাগে ভালবাসাটাকে।চোখের সামনে যেন বড় হতে দেখা একে অন্যের।মাঝে মধ্যে ফাঁক করে লুকিয়ে বেড়াতে যাওয়া।
তাও এই বারান্দায় এসে ঠিক করা হত।
এইচ এস সি ২য় বর্ষের সময়ই,হঠা্ৎএরকম মান অভিমানের সময় ই একদিন আর খোঁজ পাওয়া যায়না শৈবালের,তিনদিন হয়ে গেল,শৈবাল মান ভাঙাতে আসে না কেন!!!ঠিক করল নিজেই ঠিক করবে সব।কিন্তু কোথায় শৈবাল??
ফোন বন্ধ!নেটে নাই!!কোথ্থাও নাই কেন ও!!!
দিকবিদিকহীন হয়ে যায় যেন অধরা।কি করবে কিভাবে কি হবে কিছু বুঝতে পারেনা।ওর শৈবালটা তো কখনও এমন নিখোঁজ হয়না।
শেষপর্যন্ত শৈবালের বাসায় যেয়ে জানতে পারে।
শৈবাল কলেজ থেকে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়,স্পট ডেড!!
সেইদিনের পর থেকে আর কারও সাথে রাগ করেনি অধরা.....নিজেকেই অপরাধী লাগে যেন!

কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল অধরা।বাড়ির কর্তী মেয়েটা হঠাৎ করে যেন সব কিছু ছেড়ে দিল।গুটিয়ে যেতে লাগল সব থেকে..।
আর মৃত্যু দেখতে দেখতে অভ্যস্হ হয়ে যাওয়া মেয়েটার যেন আর বাঁচার আশা ফুরিয়ে যেতে লাগল।
আর স্রষ্টাও যেন এটা বুঝে গিয়েছিলেন।
ছোটবেলায় খুব একটা শখ করত অধরার।সময় নিয়ে মারা যাওয়ার,মরার আগে সব কিছু করে যাওয়ার,চোখের সামনে মৃত্যু জেনে মারা যাওয়ার।
খুব বিচ্ছিরি একটা ইচ্ছা!!!কিন্তু এই ইচ্ছাটাই যে করত ওর।কি করার আছে!!
সব কেড়ে নিয়ে স্রষ্টা যেন এই ইচ্ছাটাই পূরণ করে দিলেন শেষবেলা্য়।
বোধহয় সব পেয়ে মৃত্যুচিন্তা ভুলে যাওয়া ব্যাপারটাই পছন্দ হয়নি স্রষ্টার!!তাই এভাবে একের পর এক মৃত্যু দেখিয়ে অধরাকে প্রস্তুত করে দিলেন ওর সবসময়ের ইচ্ছাটার বাস্তব দেখাতে......।
শৈবালের চলে যাওয়ার পরও দুইবছর পার হয়ে গেল।বাসা আর কলেজের বাইরে খুব একটা বের হয়না অধরা।নিজের রুমটা যেন দিন দিন আরও বেশি আপন হতে থাকে।আর মাঝেমধ্যে অসহ্য রকম মাথাব্যাথা!!!
ইচ্ছে করেই কাউকে বলতনা সে,কি দরকার আরও চিন্তা বাড়ানোর।বাবা আর অজয়া এমনিতেই ওকে নিয়ে কম ভাবেনা।কিন্তু ছোট বোন অজয়া কিভাবে যেন ঠিকই বুঝতে পারে।
কিছুদিন পর ডাক্তারের কাছে যেয়েই ধরা পরে-
ব্রেইন ক্যানসার!!!
বাবা তার সাধ্যমত সব চেষ্টা করে যাচ্ছেন।সব টাকা পয়সা শেষ করে দিচ্ছেন।দুবার বিদেশেও নিয়ে গেছেন।কিন্তু কোন উন্নতি হচ্ছেনা,সেদিন নিজ কানে শুনেছে অধরা,চতুর্থ মানে শেষ ধাপে দাড়িয়ে আছে সে,সেদিন থেকেই জেদ তার,বাসায় চলে আসবে,ডাক্তার ও খুব জোর দিয়ে না করেনি।শেষকটা দিন নিজের স্মৃতিময় বাসায় ,নিজের মানুষদের দেখেই যাওয়ার সাধ ওর।

হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পায় অধরা,অজয়া পিছনে এসে দাড়িয়েছে কখন।
নীরবে তাকিয়ে একটু হাসে অধরা অজয়ার দিকে,
দরজায় শব্দ হয়,বাবা এসেছে,হাতে একটা কেকের বাক্স।
ধুর যাহ!!এতক্ষণে খেয়াল হয়,আজ তো অজয়ার জন্মদিন।বাবাকে তো আজ বিকালে ও নিজেই বলেছিল।উফ,কি যে হয়েছে আজকাল!এত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় সব!!
ওর রুমের ছোট টেবিলটায় কেকটা রেখে ১২টা বাজতেই গান গেয়ে ওঠে অধরা আর বাবা।ছোট অজয়া টা কত বড় হয়ে গেল।মায়ের কোলে ছোট গোলাপী তোয়ালে মোড়ানো নিষ্পাপ মুখটা এখনও মনে পড়ে অধরার!ছোট ছোট হাত পা-এটাও মানুষ?- এইরকম একটা ব্যাপার কাজ করত তখন।সারাদিন বাবুকে দেখে রাখা,জড়িয়ে ধরে ঘুমানো-এক ঝটকায় যেন মনে পড়ে গেল সব!
কাছে যেয়ে অজয়ার গালটা ছুঁয়ে দিল।চেপে ধরল আদরে।অজয়া থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।হুম,,,,,,,,কাঁদছে।কান্নাটা ওকেও ছুঁয়ে গেল।আলতো ফিরে তাকালো বাবার দিকে।
বাবার চোখেও পানি!!!
অনেক হৈহুল্লোড় করল ওরা।কেক খাওয়া,একে অন্যে আদর করা।
রাত প্রায় ৩টা,মাথা ব্যাথায় ঘুম ভেঙে গেছে।
তাকিয়ে দেখল-ক্লান্ত হয়ে ওর রুমেই বেডের পাশের সোফাতে বসেই ঘুমিয়ে আছে বাবা,আর অজয়া তাঁরই পাশে বাবাকে ধরে অধরার খাটের দিকে মুখ করে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে।
কি আদুরে লাগছে দুইজনকে! কেন যেন মনে হচ্ছে আজ ই বোধহয় ওর যেতে হবে।অসহ্য ব্যাথা আর বমি।পুরো পৃথিবীটাই কেমন যেন নড়ে উঠছে।
নাহ!ডাকবেনা ওদের।
আরেকটু ঘুমাক।
এইভাবেই এরকম শান্তিময় দুটো মুখ দেখে তো মৃত্যুতেও সুখ!!

হঠাৎ করে কতশত বৃত্ত যেন প্রচন্ডবেগে ওর দিকে ধেয়ে আসছে।


কিন্তু বাবা আর অজয়া কোথায়??

আস্তে আস্তে সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হতে থাকে.......তাহলে কি ও চলে যাচ্ছে শূন্যতার গভীরে.........................


সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:১২
৫১টি মন্তব্য ৫০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×