somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলবায়ু পরিবর্তন: বাহাসের ক্ষুদ্র ইতিহাস

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শেষ কিস্তি
(ব্র্যাকেটবদ্ধ সংখ্যা ফুটনোট নির্দেশক)

জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতিকরন
১৯৮৮ পর থেকে যেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আঙ্গিকগত দিক থেকে এবং প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিভিন্ন এনজিও তাদের প্রচারনায় শীর্ষে নিয়ে আসে।তবে একই সঙ্গে লক্ষ্যনীয়ভাবে অন্য আরেকটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী তৈরী হয় যারা এই নতুন গণচেতনার বিরূদ্ধে কাজ করতে থাকে এবং বিভিন্ন লবিং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিক নির্দেশনা পরিবর্তনের প্রয়াস পায়। (১৩)এই সংঘবব্ধ গোষ্ঠীর পেছনের কলকাঠি নাড়তে থাকে গাড়ি কারখানার, তেল কোম্পানীর এবং অন্যান্য বৃহৎ শিল্পের মালিকবৃন্দ। Global Climate Change Coalition (GCCC) নামে এই গোষ্ঠী কিয়োটো প্রটোকলের বিরোধিতা করে তিনটি যুক্তিতে; যথা- যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির গতি ক্ষতিগ্রস্থ' হবে, জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো এই সুযোগে বাজার দখল করে ফেলবে। তবে একের পর এক ১৯৯০, ১৯৯৫, এবং ২০০১ পর্যন্ত আইপিসিসি’র তিনটি মূল্যায়ন রিপোর্টেই ক্রমবর্ধমান হারে জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকার সাক্ষ্যপ্রমান চলে আসায় (GCCC) এর মাঝে ভাঙ্গনের সুর দেখা দেয়। ১৯৯৭ সালে বিপি এবং পরবর্তীতে শেল (১৯৯৮), ফোর্ড (১৯৯৯)এবং ক্রমান্বয়ে টেক্সাকো, ডেইমলার-ক্রাইসলার ইত্যাদি কোম্পানী জিসিসিসি ছেড়ে যায়। ২০০১ সালে আপিসিসি’র তৃতীয় মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশের ফলস্রুতিতেই ২০০২ সালের গোড়ার দিকে জিসিসিসি ভেঙ্গে যায়।

১৯৯০ থেকে ২০০৪:নীতিকৌশল গ্রহন প্রক্রিয়া
এই সময়কালের মধ্যে আন্তরাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড নিঃসন্দেহে বহুগুন বেড়ে যায় এবং ১৯৯০ সালে জেনেভাতে প্রথম জলবায়ু সম্মেলনের দু’বছর পরই ১৯৯২ সালে রিয়ো ডি জেনিরোতে ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই ইউএনএফসিসি (United Nations Framework Convention on Climate Change ) সম্পর্কে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯৯৪ সাল থেকে কার্যকর হয় এবং বর্তমানে ১৯১ দেশ এটিকে অনুসমর্থন করেছে। এই কনভেনশনে স্বীকার করা হয়েছে যে, গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনে উন্নত দেশগুলোই প্রথম থেকেই দায়ী যেক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনপ্রতি নির্গমন হার আপেক্ষিকভাবে অনেক কম। কিয়োটো প্রটোকলের অধীনে উন্নত দেশগুলো ২০১২ সালের মাঝে ১৯৯০ সালের নির্গমন সীমার চেয়েও গড়ে প্রতি বছর ৫.২ শতাংশ হারে নির্গমন কমানোর ব্যাপারে সম্মত হয়। বিভিন্ন দেশ তাদের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য বিভিন্ন রকম নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা দাবী করে। এ বিষয়ে বিতর্ক চরমে উঠে যখন ২০০১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এই চুক্তিকে ‘চরম খুঁত সম্পন্ন’ হিসেবে অভিহিত করেন।(১৪) এই উক্তির পর থেকে বিতর্ক কেন্দ্রীভুত হয়ে পরে বিশ্বে ক্ষমতার মেরুকরন নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিকতা এবং একপাক্ষিকতা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে উঠে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন বিতর্কের প্রভাব বিশেষ করে চলচিত্র ও গল্প উপন্যাসেও ফুটে উঠেছে। ২০০৪ সালে মুক্তি পায় ‘দ্যা ডে আফটার টুমোরো’ নামের একটি ছবি যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। ২০০৪ সালে মাইকেল কার্কটনের ‘স্টেট অব ফিয়ার’ নামে একটি রোমাঞ্চ উপন্যাস তুমুল সাড়া ফেলে দেয় যেটিতে মূল বক্তব্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সবকিছুই একটি ষড়যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঐ সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন এবং বার্ড-হ্যাগেল রেজুলেশন (১৫) এর অজুহাতে কিয়োটো প্রটোকল সিনেটে উপস্থাপন করেননি।

২০০৫ এবং ভবিষ্যৎ পথ
২০০৫ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড় ক্যাট্রিনা’র আঘাতে আবার জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনা তুঙ্গে উঠে, বিশেষতঃ টাইম, দ্যা স্টার্ন রিভিউ, বিজনেস উইক, অবজার্ভার ইত্যাদি পত্রিকা ও ম্যাগাজিন এ বিভিন্ন বিশ্লেষন ধর্মী লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ২০০৬ এ মুক্তি পায় “এন ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ” যার কারনে আল গোর ২০০৮ সালে নোবেল শান্তি পুরুষ্কার এ ভূষিত হন। অতঃপর ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় আইপিসিসি চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট একথা স্পষ্ট করেই ঘোষনা করা হয় যে, মানব কর্মকান্ডই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ৯০ শতাংশের চেয়েও বেশী দায়ী। ২০০৭ এ ডাভোস এ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষনা দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন কে একটি ’চরম সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বস্তুত পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা হলো সময়ক্ষেপন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিতর্কের বিষয়বস্তু ও সামপ্রতিককালে পরিবর্তিত হতে দেখা গিয়েছে। যেমন, আগে বিতর্ক কেন্দ্রীভূত ছিল ‘মানুষের কর্মকান্ডের ফলে আদৌ জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কী না’ কিন্তু বর্তমান সময়ে বিতর্ক সরে এসেছে ‘কিভাবে এর সমাধান করা যায়’ এবং যেহেতু এর সাথে চরম দূষনকারী রাষ্ট্রসমূহ জড়িত এবং কোন বাস্তবিক কর্মকান্ড চালাতে হলে একটি অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব আছে তাই বিতর্কও দীর্ঘ হচ্ছে। সমাধান নিয়ে তর্ক যত দীর্ঘ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সন্দেহও একপক্ষে ঘনীভূত হচ্ছে যেমনটা সাইকো থেরাপিস্ট কার্ল ঝাং বলেছেন “ শুধু রাতের বেলায়ই কোন ছায়া থাকেনা”(১৬)। অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, যেসব গোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের বিরোধিতা করছে তারা সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে এখন অনেকটা গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছে। যেমন ২০০৭ এর মার্চ ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোর এ একটি প্রামাণ্যাচত্র দেখানো হয় যা মূলত একটি প্রোপাগান্ডা এবং এমন একটি মহলকে উদ্দেশ্য করে এই অনুষ্ঠানটি সমপ্রচারিত হয়েছে যারা মূলত সন্দেহবাদী। এর প্রথম ৭০ সেকেন্ড এ বলা হয়েছে “ বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্র ফুঁসে উঠছে, হারিকেন তীব্র হচ্ছে এবং এটা আপনার দোষেই হচ্ছে। ভয় পাচ্ছেন? ভীত হবেন না কারন এটা সম্পূর্নই মিথ্যা।” অনেক স্থানেই প্রচারনা চালানো হচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রচারনা হলো বামপন্থীদের প্রচারনা এবং এই বিজ্ঞান সম্পূর্নই পক্ষপাতদুষ্ট।

উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে পুরুষ ও নারীর জীবন থেকে যথাক্রমে ২৪১০০০ এবং ২৫৩০০০০ ঘন্টা হারিয়ে যাচ্ছে (১৭) এবং এখনই পদক্ষেপ না নিলে অবস্থা দিন দিন চরম রূপ ধারন করবে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত যে বাহাস দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে তার রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষন করার দাবী রাখে কারন এই তর্ক তথা জলবায়ু পরিবর্তন উপশমের পদক্ষেপ নেওয়া যত বেশী দির্ঘায়িত হবে ততবেশী ক্ষতিগ্রস্থ হব আমরা সবাই আর সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে দারিদ্র পিড়ীত রাষ্ট্র সমূহের দরিদ্র জনগন।


ফুটনোট
(১৩)Evans, Alex and Steven, David; Climate change: the state of the debate, The London Accord 2, Centre On International Cooperation, October 2007
(১৪) তিনি বক্তব্যে ‘Fatally Flawed’ শব্দযুগল ব্যবহার করেছিলেন।
(১৫) এই রেজুলেশনটি ১৯৯৭ সালে সিনেটে পাশ হয়েছিল যার মূলকথা হলো এযসব চুক্তিতে উন্নয়ণশীল দেশগুলোকে কোনভাবেই অঙ্গীকারাবদ্ধ করা হয় না এসগুলো সিনেটে পাশ করা যাবেনা।
(১৬) উক্তিটি নেওয়া হয়েছে Evans, Alex and Steven, David; Climate change: the state of the debate, The London Accord 2, Centre On International Cooperation, October 2007 page 34.
(১৭) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (২০০২), এনসাইক্লোপিডিয়া অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, সেজ পাব্লিকেশন ২০০৬।

২য় পর্বের জন্য
Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১:৩৪
১২টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×