একেকটা সময় আসে যখন আশেপাশের সবকিছুকেই নিরর্থক লাগতে শুরু হয় খুব বেশি মাত্রায়। হাসি,কান্না,কথা বলা,ভাবনা,বেঁচে থাকা এমনকি মরে যাওয়াটাও। এই সময়গুলির নাম দিয়ে থাকি স্থবির সময়। কেননা ওই সময়টায় কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও আমি যুগপৎ ভাষাহীনতা ও স্থবিরতায় আক্রান্ত হই। আর সময়ের সুতোগুলো হাত থেকে খুলে খুলে হারিয়ে যায় একটু একটু করে। আমি জড় ও নিথর দৃষ্টিতে আশেপাশের চলমান দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে তাদের অর্থহীনতার সীমারেখা পরিমাপে ব্যর্থ হয়ে মৌন কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই অস্বস্তিকর স্থবিরতার দ্বন্দ্ব অবশ্য কমে না তাতে। বরং রাতের একেকটা প্রহরের সাথে সাথে তারা বেড়ে উঠতে থাকতে সমান্তরালে; গজিয়ে ওঠে তাদের শিকড় বাকড়,শাখা প্রশাখা আর ক্রমশঃ তার জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আমি আটকে যেতে থাকি।
স্থবিরতার যন্ত্রণাটা একটা সময় মাথার ভেতর অসহনীয় হয়ে উঠলে নিজেকে ধাক্কা দেয়াটা জরুরি হয়ে ওঠে। তখন ইচ্ছে হয় একটা গিটার হাতে নিয়ে তার স্ট্রিংগুলোর উপরেই যন্ত্রণার যাবতীয় জঞ্জালটা ঝেড়ে দিতে। কিংবা নিদেনপক্ষে চিত্কার করে একটা গান গাইতে। তবু স্তব্ধতার প্রতি অধিক আনুগত্যবশতঃ করা হয়ে ওঠেনা কোনটাই। এইভাবে যন্ত্রণাগুলো একে একে জমে উঠতে থাকে নিঃশব্দে নিভৃতে। আঁচড় কাটতে থাকে পেলব অথচ নির্মম নৃসংশতায়। আমি তাদের লালন করি। তাদের ঘরবসতি বানাই এবং খাদ্য যোগাই নিয়মমাফিক। ফলতঃ সময়ের ব্যাপ্তির সাথে সাথে তাদের নখরগুলো হয়ে ওঠে পরিপুষ্ট এবং আঁচড়গুলো ধারালো।
এরকম অর্থহীনতার স্থবিরতা থেকে নিজেকে মুক্তি দেয়ার একমাত্র খোলা পথ আরো বেশি অর্থহীন কিছুতে মেতে উঠে কিছু সময়ের জন্য মনোযোগ সরিয়ে নেয়া। প্রক্রিয়াটা হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ও ধারাবাহিক। এবং ফলাফলটা আসে হাতেনাতেই। কিন্তু আবার কখনো কর্মহীনতায় একা হয়ে গেলেই স্থবিরতাটা শক্তভাবে জেঁকে বসে। এ যাত্রায় তার সাথে এসে যুক্ত হয় যাবতীয় অপরাপর যন্ত্রণাসমূহ। তার মধ্যে থাকতে পারে ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নহনন ও স্বপ্নহীনতা,যাপিত জীবন বিষয়ক দ্বন্দ্ব ও ক্লেদাক্ততা, সামষ্টিক সম্পর্কের সূতো বোনায় ব্যর্থতা এবং প্রত্যাশা পালন ও ভঙ্গ হবার যন্ত্রণাজনিত ধারাবাহিক বেদনাগুলি। এরা যখন যুথবদ্ধ হয়ে ওঠে তখন তাদের বলা যায় অপ্রতিরোধ্য। মস্তিষ্কের ভেতর অবিরত বিউগল বাজাতে বাজাতে তারা আমাকে প্রকারান্তরে আচ্ছন্ন করে ফেলে নেশার ঘোরে। যন্ত্রণা প্রশমনের বদলে তাকে নিজের কাছে সযত্নে ধরে রাখাতেই তাই ঝোঁক থাকে বেশি।
তাদের বাড়িয়ে দেয়া পাঁচটা হাতের আঙ্গুলে নিজেকে আপাদমস্তক জড়িয়ে নিয়ে আমি রাতের কোলে শুয়ে শুয়ে একাকী অন্ধকারের গাঢ় হয়ে ওঠার একেকটা স্তর গুনি। নিঃসঙ্গতা তাতে পূর্ণ মাত্রা যোগ করে। মানুষ সাধারণত নৈঃসঙ্গ ভালো না বাসলেও আমি তার প্রেমে পড়ে আছি বহুকাল ধরে। বলা যায় তাকে নিয়েই আমার ঘর বসতি। এরকম সময়গুলোতে আমার কেন মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার একেকটা অন্তহীন রাত্রির কথা যে রাতগুলোতে আমার একান্ত সঙ্গী ছিল কেবল এই নৈঃসঙ্গ! যে সময় সমস্ত রাত্রি ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় একা জেগে থেকে দিনলিপি লেখা হত,নেয়া হত রাত্রিকালীন বৃষ্টির ঘ্রাণ, আর অপেক্ষায় থাকা হত সূর্যোদয়ের। সেই সময়ের পর কেটে গেছে প্রায় এক যুগ। আজ বহু বহুদিন পর সেরকম রাত্রি দেখা হলো এক। আর যন্ত্রনাগুলি হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমায় আগের মত বিবশ করে দিল।
যন্ত্রণা ভুলে যেতে মানুষ কতকিছুই করে। কেউ গান গায়,কেউ বন্ধু বানায়,কেউ লেখে কবিতা। সুরের ভেতর,অক্ষরের ভেতর অথবা কোনো দ্বিতীয় সত্ত্বার ভেতর তাদের যন্ত্রণাগুলি ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে থাকে নিঃশব্দে। আমি তার কোনটাই করিনি কখনো। আমি গভীর ভালবাসায় তাদের আঁকড়ে ধরে রেখেছি সবার অগোচরে। একটা পূর্ণ রাত্রি শেষ হয়ে যাবার পর যখন আমার ঘুম আসে না কিছুতেই তখন তারা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে নিরবচ্ছিন্ন ছায়ার মত। আর আমি তাদের মেলে দেয়া ডানার নিচে শুয়ে দুই হাত বাড়িয়ে গভীর মমতায় নিজেকে জড়িয়ে ধরে থাকি।
এক যুগ আগে যখন এই রাতগুলো আমাকে ছুঁয়ে গেছে তখনও নিজের হাত ধরে ছিলাম আমি এমন ভাবেই। এক যুগ পরও আছি ঠিক সেভাবেই।
এই সমস্ত জীবনটা তাই আপাত অর্থহীন হলেও নিজস্ব মুহূর্তগুলি সত্যি। কারণ মানুষ মুহূর্তেই বাঁচে। হয়ত সেই মুহূর্তগুলির যন্ত্রণামাখা স্বপ্ন হতে পারে মানুষ হয়ে ওঠার। স্বপ্ন হতে পারে কোনো একদিন মানুষের মত করে বেঁচে ওঠার বা বাঁচতে শেখার। সেই স্বপ্ন আদৌ কখনো সত্য হবে কিনা সে হিসেব সময়ের।
তার বাইরে এটুকুই সত্যি আমরা বেঁচে আছি জীবনের হাত ধরে। সেই এক জীবনে নিজের ভেতর নিজেকে পূর্ণভাবে ধারণ করে নেয়া.......আর প্রতিটি ধেয়ে আসা নির্মম যন্ত্রণার মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারা গভীর নির্ভরতায়......সেটাই বা কম কিসে? গোটা পৃথিবী হারিয়ে যাক,তুমি নিজের সাথে জুড়ে থাক! সব চিহ্ন মুছে যাক,সবাই তোমায় ভুলে যাক, তুমি নিজেকে জড়িয়ে ধরে থাক।
যে অনন্ত আকাশ তার নিঃসীম ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে আমাদের সেখানেই একদিন তো মিলিয়ে যেতে হবে একাকী। নিজেকে ছাড়া আর কেইবা তোমার সাথে থাকবে তখন?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৩:৫৮