somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসংলগ্ন আত্মপ্রলাপ ও বনপাখির অব্যক্ত জবানবন্দী

২৪ শে নভেম্বর, ২০১০ রাত ২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১.
তাকে আমি পেয়েছিলাম পুরোপুরি গুঁড়িয়ে যাওয়া দুমড়ে মুচড়ে অন্ধকারে সেঁধিয়ে থাকা বিস্রস্ত এক ভীত হরিণীর বেশে।
তার চোখের কোণায় জল জমে ছিল তখন অবধি। সেখানে জমাট বাঁধা সংখ্যাতীত দ্বিধা আর অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তার দৃষ্টি থেকে মুছে দিয়েছিল শৈশবের সারল্যকে। কারণ তখন সে আর সেই দেবশিশুটি নেই যাকে এক বিষাক্ত অজগর গ্রাস করে নিয়েছিল প্রায় অর্ধেক। অজগরটি যখন তার হিসহিসে জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিল দেবশিশুটির আনত কোমল কম্পমান দুটি ঠোঁট, তখন তার করাল দাঁতের থলেয় লুকিয়ে থাকা সবটুকু বিষ ছড়িয়ে গিয়েছিল শিশুটির দেহে। সে তখন তা জানতে পারেনি। জেনেছিল বহু পরে। যখন আরো এক গ্রাস নীলচে সর্পবিষ তার সারা শরীরে উগড়ে দিল কেউ। সেই তাকে আমার প্রথম দেখা।
নিভে যাওয়া চোখ,মুছে যাওয়া হাসি আর হারিয়ে যাওয়া শৈশবের অসহনীয় অশ্লীল যন্ত্রণার সবকটি রেখা মুখে।
সেইদিন তাকে আমি মন্ত্র পড়ে একটা ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ বানিয়ে দিয়েছিলাম। এখনো মাঝে মাঝে তাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি অনেকটা সময় ধরে।
দুঃখ কেবল একটাই,সেই স্ফুলিঙ্গটাকে আমি জ্বলতে দেখি প্রায়ই ,শুধু জ্বলে উঠতে কখনো দেখি না।
স্ফুলিঙ্গগুলি কখনো আগুন হয়ে জ্বলে উঠতে পারে না কেন কে জানে!
অনেক অনেক বছর পর তার সাথে একদিন দেখা হলে,এই প্রশ্নটা তাকে আমি করব বলে ঠিক করেছি। সে কি উত্তর দেবে তাই ভেবে ভেবে এখন আমার দিন কাটে,রাত কাটে.....কেটেই যায়....
শুধু মুহূর্তগুলিকে কেন যেন আর আপন মনে হয়না।
০২.
আজ আমি একটা গল্প বলব। গল্পটা খুব পুরোনো।
একবার এক কাশফুলকে এক উড়ন্ত গাংচিল প্রশ্ন করলো,তোমার নাম কি,কাশফুল?
কাশফুল জবাব দিল,বনপাখি। গাংচিল শুধালো,সে কেমন নাম? কাশফুল বলল,আমি পূর্বজন্মে ছিলাম পোষ না মানা উড়ন্ত বন শালিক। ভাগ্যদেবীর অভিশাপে এই জনমে কাশফুল হয়ে বাঁধা পড়লাম গাছের ডালে। শুধু মন হয়ে রইলো বন শালিকের। একদিন প্রজাপতিরা দল বেঁধে বেড়াতে এলো কাশের বনে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা কাশের মায়ায় আটকে পড়ল চিরতরে। বনপাখি নামের কাশফুলকে তারা ভুল করে ভালোবেসেছিল সবার অজান্তে। বনপাখি তা জানত অথবা জানত না। জানত না প্রজাপতিরাও।
তুমুল জ্যোত্স্নার রাতে তারা কাশের বুকে চুপ শুয়ে শুয়ে আকাশের গা থেকে ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা চাঁদের আলোয় ভিজতো। সমস্ত রাত্রি জেগে বনপাখি নামের কাশফুল তাদের জোছনাগীতি শোনাতো। তারা সুরের সম্মোহনে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত দুচোখ বুজে।
একদিন বনপাখি ডানা মেলে জেগে উঠলো। তারপর একটা একটা করে প্রজাপতির ডানা কেটে নিয়ে তাদের ঝেড়ে ফেলে দিল নিজের শরীর থেকে আর উড়াল দিল সীমাহীন আকাশে। ডানা হারানো প্রজাপতিগুলো অবাক বিষন্ন দৃষ্টি মেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো বনপাখির দিকে। ততক্ষণে সে চলে গেছে অনেকখানি দূর। প্রজাপতিদের বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে বাতাস থেকে বাতাসের কানে।
গাংচিল,তুমি বনপাখির কাছে এসো না। সে অভিশপ্ত কাশফুল। সমস্ত প্রজাপতিদের ডানার রক্ত আর দীর্ঘশ্বাসের দাগ লেগে আছে তার শরীরে। তুমিও প্রজাপতিদের মত ডানা হারিয়ে একদিন নিঃস্ব হয়ে পড়ে রইবে কাশের বনে। তোমার স্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে যাবে, কবিতাগুলো হারিয়ে যাবে - তুমি বনপাখির হাত ধরতে যেও না।
গাংচিল মাথা নেড়ে বলল, যদি আমি তোমার যন্ত্রণাগুলো ফানুস বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিই? কাশফুল শুধালো,সে কেমন করে?
অতঃপর গাংচিল তার চারটি ডানা ঝাপটিয়ে কাশফুলকে ছিঁড়ে নিয়ে ঠোঁটে করে উড়ে চলল পাহাড়,জঙ্গল আর মরুভূমি পেরিয়ে.......
অবশেষে সমুদ্রের পাড়ে এসে শেষবারের মত গভীর ভালবাসায় চুম্বনের পর তাকে বিসর্জন দিল সমুদ্রের জলে।
গাংচিল সম্ভবত ভালবেসেছিল কাশফুলকে। তাই তাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল যন্ত্রণাময় জীবনের অভিশাপ থেকে।
আজকাল আমার কেন যেন ওই গল্পের কাশফুলকে মাঝে মাঝে খুব ঈর্ষা হয়।
০৩.
আমি ঠিক করেছিলাম প্রতিদিন একটা করে কবিতা লিখব। লেখা শেষ হলে কবিতার পাতায় ছড়িয়ে দেব এক মুঠো পোড়া ঘাস আর এক গুচ্ছ বেলীফুল। কবিতার শরীর জড়িয়ে থাকবে নিশ্চুপ আঁধারের সমস্ত অব্যক্ত পাপ আর আঁধারের শরীর জড়িয়ে আমি। এইভাবে কবিতার খাতা ভরে উঠবে দিনে দিনে সকল শূন্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আর আমার নুয়ে যাওয়া দৃষ্টির বিষন্নতা বয়ে।
একে একে সাঁইত্রিশটি কবিতা লেখার পর একদিন কলমের কালি ফুরিয়ে গেল। কলমে নতুন কালি ভরে যখন কবিতা লিখতে গেলাম তখন খাতার বেঁচে থাকা সমস্ত সাদা পৃষ্ঠাগুলো ভূতুড়ে দৈত্যের মত আমাকে চারিদিক থেকে আক্রমণ করে বসলো। তীব্র শ্লেষে ভেংচি কেটে তারা আমায় সং সাজা এক সার্কাসের স্থবির মূর্তি বানিয়ে দিল আর ভীষণ রকম আঁতকে উঠে আমার হাত থেকে কলম মাটিতে পড়ে গেল।
সেইদিন আমি জানলাম আমার আর কবিতা লেখা হবে না কোনদিন।
কেননা আমি অলীক স্বপ্নগ্রস্থ ছিলাম।
আর স্বপ্নটা ভেঙ্গে গিয়েছিল কলমটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই।
সেইদিন আরো একটা ভয়ঙ্কর কুৎসিত সত্য জেনে গিয়েছিলাম আমি। কিছু কিছু মানুষদের কখনো কবিতা লিখতে নেই। কেননা স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা তাদের আসলে নেই। দিনরাত্রি তারা বাস করে অন্তঃসারশূন্য কিছু দুঃস্বপ্নের প্রলাপের মাঝে আর মূর্খ পাগলের মত কেবলই ফাঁপা শব্দে চেঁচিয়ে যায় অর্থহীন আত্মমগ্নতায়।
এবং আমি সেইসব মানুষদের একজন।
০৪.
এবং এখন শেষটা নির্ধারণ করবার দায়-দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে নানা কারণেই। দ্বিধান্বিত হওয়াটা বরাবরই সহজ সিদ্ধান্ত নেবার চেয়ে। কেউ একজন বলেছিল, মানুষ আসলে দ্বিধায় থাকতেই ভালবাসে। সিদ্ধান্ত পৌঁছুতে সে কখনো চায় না, কেননা যেই মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সেই মুহূর্ত থেকেই তাকে ছেড়ে দিতে হয় দুটোর মধ্যে কোনো একটা। আমি যদিও সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত বরাবরই এবং কোনকিছু ছেড়ে দিতেও আপত্তি নেই বিশেষ তবু কঠিন হয়ে পড়ছে সেই জায়গায় পৌঁছনোটা। তার সিংহভাগ দায় চাপানো যেতে পারে নিজস্ব জটিল মনঃস্তত্ব এবং বাদবাকিটুকু পরিবেশের প্রতিকূলতার ঘাড়ে।
অতঃপর শেষ অবধি পাল্লা কোনদিকে হেলবে তা এখনো জানা হয়নি। কেবল জানা আছে,বাতাসের গায়ে একদা ছুঁড়ে দেয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। টিমটিমিয়ে জ্বলা স্ফুলিঙ্গের কাছ থেকেও উত্তর পাবার অপেক্ষায় আছি। সে যদি সত্যি সত্যি নিভেই যায় একদিন,তবে নাহয় বাতাসের শরীর থেকে প্রশ্নগুলো কুড়িয়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে দেব একটা একটা করে। একটা সময় নিজেকে খুন করতেও যদি হাত নাই কাঁপে আর, তবে কি হবে লোকদেখানো অনর্থক কিছু "আত্মিক উচ্চাভিলাষ" চেতনা নামক ভাবসর্বস্ব ফাঁপা দেয়ালে টাঙিয়ে রেখে? নাকে মুখে লাল-নীল রং লাগিয়ে জবরজং পোশাকে নিজেকে যাত্রা আর সার্কাসের ক্যারিকেচার বানানো হলো অনেক। রোমাঞ্চকর সব নাটকের শেষ দৃশ্যে মুগ্ধ চোখের দর্শকদের হাততালিও কুড়োনো হল বহু। একটা সময় আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে ঝনঝন করে আয়নাটা যদি ভেঙ্গে পড়ে তখন ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো বিঁধে রক্তাক্ত হবার প্রস্তুতিও নেয়া চাই। ছেলেভুলানো মনোহর ছড়া আউড়ে নিজেকে নিজের কদর্যতা,সীমাবদ্ধতা ভুলিয়ে রাখা আর কত? বাকি সবাইকে ফাঁকি দেয়া শেষ।
নিজেকে নিজে এবার নাহয় চিনে নেয়া হোক। শুধু নির্বোধের মত অর্থহীন চেঁচামেচি বন্ধ করে নিজেকে চেয়ে দেখা হোক একবার। তুমি এত ফাঁপা আর নগন্য যে নিজেকে ঝালিয়ে নেবার বিলাসিতাও হয়তবা মানায় না তোমাকে আর। তবে নাহয় সেটাই জেনে নেয়া হোক। এইবেলা নিজের সাথে বোঝাপড়া চুকিয়ে নেয়া হোক,হয়ত ডুবে যাবার এখনো কিছু আছে বাকি। হয়ত এখনো দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে ডাঙায় উঠে আসার কোনো না কোনো পথ.......নাহয় খুঁজেই দেখা হোক তাকে একবার।
আকাশের সব তারা নিভে যাক। তোমার গায়ে জোনাকি জ্বলুক।
দেখো,একদিন তুমি সত্যি সত্যি পাখি হয়ে যাবে। একদিন সত্যি পাখি হয়ে উড়ে যাবে।
আর তোমার শরীরে জড়িয়ে থাকা সমস্ত অসমাপ্ত কবিতার দীর্ঘশ্বাসেরা একে একে মুছে যাবে।
কারণ সেইদিন তুমি নিজেই একটা গোটা কবিতা হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১০ ভোর ৬:১৩
৬৯টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×