somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ্যমবুশ ৪

১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গাজা আর শহর নেই—এখন এটা এক বিপর্যস্ত ছাইয়ের রাজ্য। দুই বছর ধরে চলে আসা অবরোধ ও নির্বিচার বোমাবর্ষণে গাজারপ্রায় সব অবকাঠামো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপগুলোর নিচে কেউ আর মানুষ খুঁজে না, কেবল শরীর খুঁজে। রক্ত, ধোঁয়া আর মৃত শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ এখন গাজার নতুন ভূচিত্র।

লোহিত সাগরের প্রতিশোধ নিতে নতুন পরিকল্পনায় ইসরায়েল কার্পেট বোম্বিং শুরু করে। আকাশজুড়ে শত শত বোমারু বিমান ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরতে থাকে। প্রতি মিনিটে ফেলা হয় একেকটি বোমা। এই বোমাগুলোর ভেতর থাকে বিস্ফোরক, ধাতব বল, দাহ্য কেমিক্যাল এবং কিছু ক্ষেত্রে রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদান।

AI-ভিত্তিক হিট-ম্যাপিং, ইনফ্রারেড সিগন্যাল এবং ইন্টেলিজেন্স ডেটার ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হয় সেইসব স্থান—যেখানে অনাথ শিশুরা জড়ো হয়েছে, খাবারের লাইনে মা-বোন দাঁড়িয়ে, ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ একটু ছায়া পেয়েছে। ঠিক সেখানেই পড়ে আগুন, ধোঁয়া আর মৃত্যুর বৃষ্টি।

একটি খোলা ময়দানে, যেখানে দু-একজন স্বেচ্ছাসেবক পানি দিচ্ছিল আহত শিশুদের, সেখানে একসাথে পড়ে চারটি বোমা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুধু রক্ত, কাটা অঙ্গ, পুড়ে যাওয়া ছায়া পড়ে থাকে মাটিতে। কিছু শিশুর মুখে আগুন জমে গিয়েছিল, কেউ চিৎকার করতে পারছিল না।

“আমরা মরার আগে মরে যাচ্ছি,”—এক নারী বললেন, যিনি পেট ফেটে যাওয়া মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটছিলেন।

“তারা আমাদের ভয় দেখাতে চায়। আমরা আর ভয় পাই না। আমরা আর কাঁদি না।” — কিশোর বয়সী এক তরুণ বলল, তার চোখ শুকিয়ে গেছে, মুখে পাথরের মত স্থিরতা।

রাস্তায় পড়ে থাকা শত শত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে এক ইমাম চিৎকার করে বলেন—“এখন জান্নাত ছাড়া কিছুই আমাদের দুনিয়ায় অবশিষ্ট নেই।”

শিশুদের একটি জটলা এক টুকরো শুকনো রুটি ভাগ করে খাওয়ার চেষ্টা করছিল। আঘাত আসে ঠিক সেখানে। পরের মুহূর্তে ধোঁয়ার ভেতর শুধু দেখা যায় পোড়া হাড়ের স্তূপ, কান্নাহীন মুখ, আর কিছু চোখ—যারা সব দেখে, কিন্তু কিছু বলে না।

আরেক জায়গায় মানুষ জড়ো হয়েছিল একটি ভাঙা পানির ট্যাংকের নিচে। একজন স্বেচ্ছাসেবক বোতল দিয়ে শিশুদের পানি দিচ্ছিল। এক মা বলছিল, “বাবা একটু দাঁড়াও, আগে ছোটটার মুখে দিই।” ঠিক তখনই আকাশ ফেটে পড়ে আগুনে।

তিন সন্তানকে হারিয়ে এক নারী চিৎকার করলেন না। তিনি তাদের হাত গুছিয়ে রাখলেন, মুখ ঢেকে দিলেন, তারপর ধীরে বসে বললেন, “এবার আমরা সবাই একসাথে যাবো।”

শিশুরা আর কাঁদে না। কাঁদতে কাঁদতে চোখ শুকিয়ে গেছে। একজন কিশোর বলল, “কাঁদলে দুর্বল দেখায়। এখন কেবল শক্ত হয়ে থাকতে শিখেছি, যেন শহীদ হই, লজ্জিত না হই।”

দিনের পর দিন, রাতে রাত, আকাশ থেমে নেই। প্রতিদিন শত শত বোমা পড়ে, একেকটি মাটিতে বড় বড় গর্ত বানায়, ধ্বংস করে শতাধিক জীবন। মাঝে মাঝে বোমার শব্দ এত তীব্র হয়, ভূমিকম্পের মতো মাটি কেঁপে ওঠে।

সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই নিরবতা পালন করে, আবার কেউ কেউ পক্ষপাত দেখায়।

সিএনএন শিরোনামে লিখে—"ইসরায়েল গাজায় প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে"
বিবিসি বলে—"হামাসকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিখুঁত অভিযান"
ফক্স নিউজ লেখে—"ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্যালুট জানাই"
দ্য টাইমস বলে—"গাজায় বিশৃঙ্খলা: সিভিলিয়ানদের মাঝে লুকিয়ে হামাস"

কোথাও নেই ‘গণহত্যা’, ‘শিশু’, ‘শরণার্থী’, ‘ব্যারেল বোমা’ বা ‘মানবাধিকার’।

শুধু কিছু সাহসী রিপোর্টার, আল জাজিরা, প্রেস টিভি, স্বাধীন সাংবাদিকেরা ছড়িয়ে দেয় দুঃসহ দৃশ্য—একটি স্কুলের মাঠে ছড়ানো ছেঁড়া বই, একটি হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপে পোড়া নার্সের শরীর, এক ক্যামেরাম্যানের রক্তে ভেজা মাইক্রোফোন।

বিশ্বজুড়ে মানুষ প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে। তেহরানে, ঢাকায়, ইসলামাবাদে, ইস্তাম্বুলে, জাকার্তায় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামে। তারা শুধু “ফিলিস্তিন” বলে না—তারা “মানবতা” বলে। লেবানন ও ইরান তাদের সীমান্তে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়, হুথিরা ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন—“তারা শিশুদের মারছে, আর বিশ্ব সভ্যতা চুপ করে দেখছে। যদি ওদের চোখে পানি না থাকে, আমাদের হৃদয়ে আগুন আছে।”

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও প্রতিক্রিয়া আসে। ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে একজন এমপি বলেন—“এই মুহূর্তে গাজায় যা হচ্ছে, তা মানবতার শেষ।”

নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী বলেন—“আমরা এতদিন একতরফা কথা শুনেছি। এখন চোখ খোলার সময়।”
ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ের পার্লামেন্টে একযোগে ঘোষণা আসে—“এই হামলা অবিলম্বে বন্ধ না হলে, আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করবো।”

ইউক্রেন যুদ্ধ ও অন্যান্য সংকটে নীরব থাকা কিছু রাষ্ট্রপ্রধান এবারও চুপ, কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নে একজন নেতা বলেন—“আমার কিছু বলার নেই। আমি নিজেই শোকাহত।”

মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকায়, দক্ষিণ আমেরিকায়, এমনকি ইটালির কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও প্রার্থনায় বসে—“গাজার শিশুদের আত্মা যেন শান্তি পায়।”

মিশর অবশেষে তার সীমান্ত খুলে দেয়। ধোঁয়া আর আগুনের ভিতর দিয়ে আহত, পোড়া শরীর নিয়ে মানুষ ক্রল করে রাফাহ পার হচ্ছে। অনেকেই হাঁটার শক্তি রাখেনি—কেউ কোলে, কেউ স্ট্রেচারে, কেউ চোখে মরার অপেক্ষায়। সীমান্তে বসে থাকা একজন রেড ক্রিসেন্ট চিকিৎসক বলেন—“এরা আর মানুষ না, এরা কেবল হৃদয়ের আওয়াজ। এদের দেহ ভেঙেছে, আত্মা ভাঙেনি।”

গাজায় একমাত্র অবশিষ্ট মিনার থেকে ভেসে আসে ধ্বনিত আজান। বোমার ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে এক কিশোর তাকিয়ে থাকে আকাশে—যেখানে হাজারো বিমান উড়ছে, কিন্তু তার চোখে ভয় নেই। সে শুধু বলে—“তারা আমাদের মারবে, আমরা শহীদ হবো। কিন্তু একদিন, গল্পটা আমাদের হয়ে লেখা হবে।”
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৪৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×