ঐযে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে উনি আমার স্বামী। জানেন লোকটাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। পরিবারের অমতে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলো ২টয় সন্ধ্যা ৭টায় ছিলো আমার হলুদ। আপনি বিয়ে করেছেন? হেসে ফেললাম। উত্তর আসলো, ঠিক কাজ করছেন। সম্ভবত গতরাতের ঝগড়ার দগদগে জ্বালা আবার অনুভূত হলো; বললো, বিয়ের মতো ফাঁকি আর কিছুতে নেই। রাজারবাগে গ্রীনলাইন বাস স্টপেজে বছর দুয়েক আগে এই দম্পতির দেখা পেয়েছিলাম। গতবছর কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে সীমান্ত স্কয়ারে গিয়েছিলাম। জ়েবি ফ্যাশনের হিজাবগুলো বেশ মানসম্মত। আম্মার পছন্দের কালারগুলো খুঁজতে খুঁজতে পরিচয় হলো দোকানটির মালিকের (একজন নারী উদ্যোক্তা) সাথে; আলাপের ফাঁকে জানা গেলো আমাদের দু’জনের বাড়িই দক্ষিনবঙ্গে। কিছু পারিবারিক আলাপের পর সেই মূল্যবান প্রশ্ন। বিয়ে করেছেন? চিরাচরিত সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম ‘না’। মুখটা উজ্জলতর করে ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন জিতছেন আপা, জিতছেন! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে? ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, একজন পুরুষকে আপনার ২৪ঘন্টা সহ্য করতে হয় না!
স্ত্রীর অঙ্গ এবং ভঙ্গী পরিচিত হয়ে গেলেই পুরুষ সংসারের প্রতি বৈরাগ্য অনুভব করেন। তাই তো সৃষ্টিকর্তা নারীকে ১৮কলা দিয়ে পাঠিয়েছেন। যদিও বিয়ে পুরুষের দায় বাড়ায়, নারীর বাড়ায় দাম। আমার কাজিনের গল্প বলি। আমার ভাইটা সাধারণ এবং নির্বিবাদী মানুষ। পারিবারিক এক আয়োজনে অনেকদিন বাদে তাকে দেখে চমকে উঠি, কী অবস্থা আপনার! কি শ্রান্ত লাগছে একদম বিমর্ষ-বিধ্বস্ত! ভাইয়া হাসেন, তুই ভালো আছিস? ভাইয়া বিয়ে করেছেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বান্ধবীকে। ভাবী (বান্ধবী) আরব্য রজনীর নায়িকাদের মতো। তিনি আয়ত চোখ মেলে তাকালে মনে হবে আপনার সাথে কথা বলছে। তাদের সাত বছরের এক পুত্রসন্তান রয়েছে। ভাইয়া বললেন, ছেলেটা না থাকলে এই সংসার টিকতো না রে। ভগ্নপ্রায় এই সম্পর্কটাকে আমরা দুজনেই টেনে নিয়ে যাচ্ছি। অথচ তাদের প্রেমের বিয়ে পরিবারের প্রশ্নপত্রে নানা ছোট-বড় ব্যাখ্যা দিয়ে। আমার এই ভাইকে কত মেয়ে পছন্দ করতো! সেটা নিয়ে আমরা কত্ত হাসাহাসি করেছি। প্রতিযোগীতার দৌড়ে ভাইয়া স্বামী হিসেবে পাস মার্কস পেয়েছেন কিন্তু যাপন করার জন্য একটা জীবন পেলেন না। আমার ভাবী (বান্ধবী) কলেজের সেরা রেজাল্ট করেও সংসারের খাতিরে চাকুরি করেন না। বর্তমানে তিনি নিজ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন এবং দাবী আদায়ে নির্দয় নারীর ভুমিকায় টপ পজিশনে আছেন। ধারণা করি ভাবীও সুখে নেই।
সেলফোন আমার কাছে একটা যন্ত্র এবং সারাক্ষণ এটার সাথে লেপ্টে থাকা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। সম্প্রতি মুগ্ধতাবোধ করছি এমন এক ছেলের ছবি সেলফোন স্ত্রিনে কাভার ফটো দিয়ে রেখেছি। তো এই ছবি কোনো একভাবে আমার মা-জননীর দৃষ্টিগোচর হলো। এশার আজানের সময় আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন ছেলেটা কে। আমি শিশুসুলভ সরলতায় বললাম কোন ছেলেটা? ঐযে যার ছবি দেখলাম। কার ছবি দেখলা? আরে ওইযে মোবাইল চার্জে দেয়ার সময় দেখা যায়। ও আচ্ছা। একটা ছেলে। কে তোমার বন্ধু। বললাম না, একে আমি পছন্দ করি। দেখতে ভালো আছে, বিয়ে করবা। হ্যাঁ। ছেলেটা কী করে? বললাম অভিনয় করে। আমার মা-জননী আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে চলে গেলেন। বুঝলাম এই বেয়াদবির জন্য রাত ১১টার আগে খাবার জোটার কোনো চান্স নাই। কারণ এই অপমানের সমুচিত জবাব দিতে তিনি আজ দীর্ঘক্ষণ নামাজ আদায় করবেন সাথে বেশ কয়েকবার ওয়াজিফা পড়বেন। দিনদুই সময় লাগে এই নিন্মচাপ কেটে যেতে। একবার সুসময় বুঝে বললাম আচ্ছা আম্মু আমি কি বিখ্যাত হতে পারবো? চেষ্টা করলে কি না হয়। আচ্ছা আম্মা তুমি কি জানো বিখ্যাতরা হয় আবিবাহিত থাকেন না হলে বহু বিবাহ করেন। তুমি আমাকে কোনটার অনুমতি দিবা? আমার মা-জননীর উত্তর তুমি এত বেয়াদব কেন!
আমার মা-চাচীরা একেকজন কমপ্লিট প্যাকেজ। আল্লাহতায়ালা জানেন কিভাবে আমার বাপ-চাচারা তাদের অর্জন করেছিলেন। চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো ঠিক তেমনি আমার পরিবারের একমাত্র দুঃখ আমি। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করা যাক। আমার বাবা জাপানের মত প্রগতিশীল হলেও মাজননী চীনের মতো লোকশিল্প প্রিয় মানুষ। তার রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য আর মর্যাদার প্রতি অসীম ভালোবাসা। তো বড় চাচী আমাকে দেখলেই দোয়া দেন রাজ রাজেশ্বরী হও। আমি হেসে বলি আমি রাজশ্বরী হতে চাই না চাচী। রানীদের অর্ধেক জীবন কাটে আকাংক্ষায়, বাকি অর্ধেক অপেক্ষায়! সম্রাট শাহজাহানকে তার স্ত্রী মমতাজ একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিভাবে পারেন যে কোনো নারীকে শয্যায় স্থান দিতে। সম্রাট রহস্য করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মিষ্টি! তা যে দোকানেরই হোক, মিষ্টি তো শুধু মিষ্টিই হয়’।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:২৮