প্রথম পর্ব
নটরডেমে থাকতে ডিবেটিং ক্লাবে যোগ দিয়েছিলাম কিন্তু স্থায়ী হই নি। কয়েকদিন গিয়েই আমার আর ভালো লাগে নি। পরে লেখককুঞ্জ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে সেদিকে যাওয়ার কথাও আর ভাবি নি। ইস্ট ওয়েস্টে ঢোকার পর বিতর্কের প্রতি আগ্রহী হলাম। সামার সেমিস্টারের ঘটনা। একদিন এক বড় ভাই (হীরকদা) আমাকে ঢেকে বললেন তার দলে বিতর্ক করতে। ভাইয়ার একজন তার্কিক অসুস্থ ছিলেন। ফলে তার স্থলে আমাকে বিতর্ক করতে হতো। কোন রকম আশা ছাড়াই আমি বিতর্ক করতে যাই। আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মধ্যে বিতর্ক। ছোট পরিসরে। কোথা থেকে সেই আত্মবিশ্বাস পেয়ে ছিলাম সেদিন জানি না। তবে বিতর্ক শেষে যখন স্পিকার হিসেবে থাকা রুপম ভাইয়া এবং বিচারক হিসেবে থাকা স্ট্যালিন ভাইয়ার দুজনই আমাকে সেরা বিতার্কিক হিসেবে রায় দিলেন, তখন মনে হচ্ছিল আমি আর সিনেমার এক্সট্রা আর্টিস্ট নেই। এরপর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নিয়মিত বিতর্ক করতে শুরু করলাম। তবে মূল সুযোগটা আসলো ২০০৩ সনের শুরুর দিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগীতায়। জীবনে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক করতে গিয়েই চলে গেলাম সেমিফাইনাল পর্যন্ত। সেখানে নর্থ সাউথের সাথে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে (১৬৭/১৬৬) হেরে বিদায় নিতে হয়। তবে সেখানে আমার পরিচয় হয় কাসেদ ভাইয়ার সাথে। ভাইয়া বিতর্ক শেষে বলেছিলেন আমি নাকি অনেক দূর যাবো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, কথাটা বলে ভাইয়া লিফ্ট দিয়ে নেমে যাচ্ছিলেন। দরজা বন্ধ হওয়ার সময় তিনি নাটকীয় ভাবে ম্যাট্রিক্স স্টাইলে আঙ্গুল তুলে আমার দিকে তাক করে ছিলেন। ভাইয়া হয়তো জানেন না, পরবর্তিতে আমি যত বিতর্ক করেছি তাঁর নেই আঙ্গুল তুলে দেখানোটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। পরবর্তিতে সে বছরই ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগীতার ফাইনালে উঠে ছিলাম যদিও শাহান ভাইয়ের জি.ও.ডি-এর কাছে হেরে রানার্স আপ হই।
পড়ালেখার ক্ষেত্রে ২০০৩ সনের শুরুটা হয় একটা প্রবল ধাক্কা দিয়ে। অল্পের জন্য আমি ম্যারিট স্কলারশীপটা মিস করি। আমার সি.জি.পি.এ ছিল ৩.৮৮। আমার ঠিক উপরে ছিল আমারই প্রিয় চার বন্ধু নাহিদ, নাজিয়া, তৌফিক এবং ক্যারল যারা সবাই পায়। বর্ডারলাইনে এসে আটকে গেলাম আমি। আমার থেকেও কম সি.জি.পি.এ নিয়ে তখন স্কলারশীপ পেতে দেখেছি অন্য ব্যাচ থেকে। বিষয়টা আমাকে তখন খুব কষ্ট দিয়েছিল। যদিও এখন যারা ইস্ট ওয়েস্টে পড়ে, তারা হয়তো আমার এই লেখা পড়ে হাসবে। ওদের এখন সম্ভবত ৩.৯৭ রাখতে হয় স্কলারশীপ পেতে!
এ ঘটনার পর আমার ভেতরে একটা পাগলামী ঢোকে। যেসব বিষয়ে এ- পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছিল সেগুলো আমি ড্রপ করে দিতে শুরু করলাম। তবে আমার এই পরিকল্পনা আমার জন্য কাল হয়ে দাড়ালো অল্প সময়ের মধ্যেই। দেখা গেলো আমি বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে পড়ছি। আমার মাথার উপর অনেক অনেক বিষয়ের বোঝা চেপে বসলো এবং যেই এ- থেকে আমি মুক্তি চাচ্ছিলাম সেই এ- আমাকে আরো চেপে ধরছে। এমনও হয়েছে, আমি বন্ধুদের পড়াচ্ছি এবং তারা এ পাচ্ছে কিন্তু আমি এ- পাচ্ছি। ইলেক্ট্রনিক সার্কিট পরীক্ষার পর জমির স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে যান তাঁর রুমে। তখন তিনি আমাকে বোঝান আমার সমস্যাটা। তিনি বলেন, আমি যখন বন্ধুদের বোঝাই, তখন আমার ধারণা থাকে আমি সব পারি। ফলে আমার নিজের পড়াটাকে আরো “ফাইনটিউন” করার বিষয়ে নজর দেই না এবং পরীক্ষায় বন্ধুরা ভালো করে এবং আমি পিছিয়ে পড়ি। আমিও চিন্তা করে দেখলাম আসলেই কথাটা সত্য। ফলে আমি নিয়মিত গ্রুপ স্ট্যাডিজ করা বন্ধ করে দিলাম।
সে বছরই আমি প্রথম আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পাই। এ. আই. ইউ. বি. আয়োজিত সেই প্রতিযোগিতায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচটি দল পাঠানো হয়েছিল। আমি কোনক্রমে পঞ্চম দলের শেষ সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেই। এ. আই. ইউ. বি.-এর একটা বিশেষ সুনাম রয়েছে সব সময়। সেটা হলো তারা দারুণ অতিথি পরায়ণ। প্রতিযোগিতা চলার সময় এত চমৎকার স্ন্যাক্স এবং সেটাও পরিমাণে এত বেশী দিত যে খাবার ফেলে প্রোগ্রামিং করা দায় ছিল। তবে আমাদের সেই দোটানা ছিল না। কারণ মূল প্রতিযোগিতার প্রশ্ন দেখার পর আমাদের দলের আর প্রোগ্রামিং করা হয় নি। বরং খাবারের প্রতিই আমাদের আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। প্রতিযোগিতা শেষে যখন আমরা বের হয়ে এলাম তখন দেখলাম ইস্ট ওয়েস্টের কোন দলই কোন প্রশ্নের সমাধান করতে পারে নি। পরদিন আমাদের বিভাগীয় প্রধান আজাদ স্যারের রুমে ডাক পড়লো। কাচুমাচু চেহারা নিয়ে সবাই হাজির হলাম। স্যার খুব দুঃখের সাথে জানালেন তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে ফলাফল তৈরীর রুমে বসে ছিলেন। ওখানে যখন একটার পর একটা দলের নাম ঘোষণা হচ্ছিল, তিনি আশা করছিলেন আমাদের অন্তত একটা দল সেরা দশের মধ্যে থাকবে। পরবর্তিতে যখন তিনি জানতে পারেন সেরা দশ দূরে থাক, কোন দলই একটা সমস্যারও সমাধান করতে পারে নি, তখন তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছেন। সেদিন আজাদ স্যারের চেহারা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। পনের সদস্যের দলে আমি যে তখন পনের তম।
অতঃপর এত জটিল বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সহজ বিষয়গুলো নিয়েই চিন্তা করতে শুরু করলাম। সায়মা তখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছে। ফলে ইস্ট ওয়েস্ট থেকে রাস্তা পার হয়ে ব্র্যাকে গিয়ে আমি এক রকম আর্কিটেকচার পড়া শুরু করলাম। বেশ কিছু যন্ত্রপাতিও কিনে ফেললাম। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাউন্ডেশন বিল্ডিং-এ বসে বন্ধুদের নিয়ে ব্র্যাকের ছাত্রীর এ্যাসাইনমেন্ট করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। আর তখনই বুঝতে পারলাম আমি কত বড় বাঁচা বেচেছি। আর্কিটেকচার আসলে মানুষ পড়ে না। এর জন্য যন্ত্র হয়ে যেতে হয়। একেকটা ছাত্রছাত্রীকে দেখতাম তারা জীবন্ত রোবট হয়ে ঘোরা ফেরা করছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে প্রোজেক্ট-ডিজাইন-জুরি নামক একটা চক্রের মধ্যে তারা বাস করতে শুরু করে। ফলে আমি মানে মানে সায়মাকে সরাসরি সাহায্য করার কাজ থেকে অবসর নিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে “সাইকোলজিকাল সাপোর্ট”-এর কাজ করতে শুরু করি!
জীবনের সবচেয়ে বড় প্রহসন হলো জীবন মানুষকে হাসাতে হাসাতে কাঁদায়। সব কিছু যখন স্বপ্নের মত সুন্দর যাচ্ছিল তখন হঠাৎ এলো এক চরম বিষাদ। একদিন সকালে আমার ছোট বোনের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। পিংকী আমাকে ডেকে বলে, ভাইয়া এদিকে আসো। আব্বু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি দ্রুত দৌড়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি আব্বুকে দুজন ধরে রেখেছে। আব্বু প্রচন্ড কাঁপছে। তখনই হসপিটালে নেয়া হয় এবং জানা যায় আব্বুর দুটো কিডনীই ফেইল করেছে। এটা কি করে সম্ভব হলো আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না। যে মানুষটা কাল রাতেও ভালো ছিল, সকাল বেলা কি করে তার দুটো কিডনী অকেজো হয়ে যায়! বিকেলে বার্ডেমে গিয়ে দেখি আব্বুর পাশে আম্মু চুপচাপ বসে আছে। ভয়াবহ রকম কিছু যন্ত্র আশেপাশে। আম্মুর কাছে জানতে চাইলাম এখানে কি হচ্ছে। আম্মু ব্যাখ্যা করলো, ডায়ালাইসিস চলছে। শরীরের সমস্ত রক্ত একদিক দিয়ে বের করে এনে ইউরিয়া পরিশোধিত করে আবার শরীরে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। যে কাজটা কিডনী করতো, সেটাই এখন যন্ত্রের মাধ্যমে করা হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে কত দিন? আম্মু কোন জবাব দেয় নি। আসলে আম্মুর সম্ভবত সেদিন কোন জবাব ছিল না। (চলবে)