নিজ দেশ হতে হাজারো মাইল দূরে অবস্থান আমার। পড়-শুনার ব্যস্থতা সত্তেও মনটা উড়ে যায় হাজারো মাইল দূরের সেই পাড়াগাঁয়ে। যেখানে আছেন আমার জনমসুখিনী মা এবং পরম শ্রদ্ধেয় বাবা।
আজ থেকে বহু বছর আগে। পবিত্র রমজান মাসের কোন একভোরে আমার জন্ম। আমার আগে মা-বাবার চার মেয়ে। মাকে বহুবার আগ্রহভরে বলতে শুনেছি। আমার জন্মের সেই আনন্দগণ মূহুর্তটির কথা। মা-বাবার প্রথম সন্তানটি মেয়ে। আত্মীয়-স্বজনরা বড় আপাকে বেশ আদর যত্ন করতো। একটি মাত্র মেয়ে তার আদরের কি আর কমতি আছে! আবার যখন মা অন্ত:সত্ত্বা তখন সবার মনে আশা এবারের সন্তানটি যেন ‘ছেলে’ হয়। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালার ইচ্ছা করে কাজ। সন্তানটি ‘মেয়ে’ হয়। সে মেয়ের ও আদর-ক্বদরে তেমন কমতি হয়নি। পরের বার সবাই নিশ্চিত যে এবারের সন্তানটি হবে ‘ছেলে’। না, মেয়েই হলো। এরপরও তারা হাল ছাড়েন নি। কারণ, চতুর্থ সন্তান ‘ছেলে’ হওয়ার সম্ভাবনা নাকি খুব বেশি! সবাই মোটামুটি সুন্দর একটা পছন্দের নাম-টাম নিয়েও হয়তো ব্যতি-ব্যস্ত ছিলেন। ফ্রাগন্যান্সির সময় হলো, এমনকি ডেলিবারিও হল। প্রসব ব্যদনায় মা জ্ঞান হারালেন। হুশ ফিরে এলে মা ব্যকুল হয়ে উঠেন সন্তানটির ‘লিঙ্গ’ ভেদ করতে। তিনি দেখলেন সবকিছু কেমন যেন মরা-মরা। সবখানে ফিনপতন নিরবতা। মায়ের বুঝতে বাকি রইল না এ নিরবতার অর্থ। তিনি বলে উঠলেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ্’। আমাদের ধাত্রি, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে রহম করুন, মায়ের নাম ধরে বললেন- কি ব্যপার, হয়েছে কি? তিনি কিছু বলেন না। বলার প্রয়োজনও নেই। কারণ, প্রতিবার যখন তিনি অন্ত:সত্ত্বা হন। আর সবাই ‘ছেলে’ নামের সোনার হরিণের আশায় দিনগুণে। আর তার সেই পুরাতন নিয়মে মেয়ে হয়। সবাই কেমন যেন অনমনা হয়ে যায়। অবস্থা দেখে তিনি সন্তান দেওয়ার একমাত্র মালিকের শোকর আদায় করেন। বলেন- আলহামদুলিল্লাহ্। এবারও চিত্রটা প্রায় আগের মতই তবে নিরবতাটা একটু বেশি।
এরপর সবাই হাল ছেড়ে দেন। ‘ছেলেরআশা’ নামের বস্তুটিকে সবাই বিদায় দেন। কি লাভ! ছেলে যখন হবেই না, তো ছেলের আশা না করাই ভাল!
এরপর মা আবার অন্ত:সত্ত্বা। এবার আমার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আগের সেই আমেজ-গুরুত্ব নেই। কারণ, মেয়েই তো হবে! এতো আর নতুন কিছু না। হৈ হল্লোল করার কি আছে।
মা কিন্তু আশা ছাড়েন না। তিনি এবং নানু, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সূউচ্চ মাক্বাম দান করুন, আশা ছাড়েন না। তারা নাছোড় বান্দা। ছেলে নামক বস্তুটির ব্যাপারে তারা আশাহত নন। আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে সেজদায় লুটিয়ে দো’য়া করেন। কেউ কা’বা শরীফ যাচ্ছেন, তো তার কাছে অনুরুধ করা হচ্ছে একটু দো’য়ার। কোন কামিল ব্যক্তি এসেছেন, তার কাছেও একই অনুরুধ। যেন তারা আল্লাহ তা’য়ালার কাছ থেকে ‘ছেলে’ নামক নিয়ামতটি না নিয়ে থামবেন না।
আল্লাহ তা’য়ালা মহান দয়াময়। তিনি আশান্বিত বান্দাকে আশাহত করেন না। এ তার সাধারণ নিয়ম। মায়ের বেলায় ও সে নিয়ম চলে।
মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। ধাত্রি এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটি ‘মেয়ে’ সন্তান দুনিয়ার মুখ দেখবে। এমনভাব নিয়ে কেউ তেমন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার মনে করে না। অন্য চার বার দাদি ছিলেন। এবার তিনিও নেই, আল্লাহ তায়ালা দাদুকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। রমজান মাসের সেহেরির সময়। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। পুরোনো সেই একটি ‘দৃশ্য’ দেখার আগ্রহ নিয়ে বসে থাকার ফুরসত বা আগ্রহ কোনটাই তাদের নেই। এদিকে আমাদের ঘরে শুরু হয়েছে ক্বিয়ামাতের বিভিষিকা। সন্তান প্রসবের সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে। মা বেহুশ হয়ে গেলেন। এর পরের ঘটনা তিনি আর জানে না। তাই আমিও জানি না। জ্ঞান ফিরলে তিনি লক্ষ করলেন, সবখানে কেমন যেন আনন্দের ধুম পড়ে গেছে। আশে-পাশের সবাই আমাদের ঘরে দৌড়ে আসছেন। তাদের কৌতুহলের শেষ নেই। বারবার তারা নবজাতকের দু’উরুর মাঝে কি যেন আবিস্কারের চেষ্টা করছেন। পরিস্তিতি ভিন্ন রকম দেখে মা ভয়-সঙ্কা নিয়ে বললেন- কী সন্তান?
ফুফুর, মানে আমার ধাত্রি, খুশি কে দেখে অবস্থা! তিনি এক প্রকার লাফিয়ে উঠলেন ‘ছেলে’ বলে। শব্দটি যেন মুখ থেকে নয় মনের গহীন থেকে বের হয়ে এলো। মায়ের খুশি যেন আর সয় না! ‘জনমসুখিনী’ মা আমার ঐ অবস্থায় ছেলেকে ধরতে চান! একটু কলিজায় বাজাতে চায় সোনার হরিণটাকে! যে জিনিস তিনি এর পূর্বে দেখেন নি। আল্লাহ তা’য়ালা অনুগ্রহপূবর্ক দিয়েছেন। তিনি আবার মহান আল্লাহ তা’য়ালা শুকর আদার করলেন। আমার বাবা। গুরু-গম্ভীর মেজাজের মানুষ। তাই তিনি হৈ হল্লোল করছেন না। তবে তিনি যে খুব্ই খুশি তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তিনিও মনে মনে আল্লাহ তা’য়ালার শোকর আদায় করছেন। বাবা মাদ্রাসা পড়ুয়া নন। তারপরও ‘এতগুলো মেয়ে’ হওয়ার পরও তিনি কোনদিন অস্থির হননি। মন খারাপ করেননি। শোকে মুহ্যমানও হননি। মাকে টু শব্দটি পযন্ত বলেননি। বরং বরাবরই তিনি একই রকম ছিলেন। আসলে ইসলাম নামের যে বৃক্ষটি এদেশের মাটিতে শেকড় ঘেরে আছে। তাই বাবাকে সান্তনা দিয়েছে। সুবোদ দিয়েছে।
রজানের সেই ভোর চিরে খবর চড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।
নানুকে খবর দেওয়া হল ‘ছেলে’ সন্তানের।
নানু আবার জিজ্ঞেস করে- কী সন্তান?
বার্তাবাহক বলে- ছেলে।
নানু যেন কানে শুনতে পাচ্ছেন না। মনে হয় কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে। নাকি তিনি ‘শ্রবণশক্তি’ হারাতে বসেছেন। না হয় তিনি ভুল শুনছেন কেন? মেয়ে হয়েছে অতচ তিনি শুনছেন ছেলে! পরপর অনেকবার জিজ্ঞাসার পরও নানু এতমিনান হতে পারেন না! দ্রুত কাপড়-ছোপড় নিয়ে মেয়ের বাড়ি রওয়ানা দেন। পৌছেঁ নবজাতককে ভালভাবে লক্ষ করেন। খুঁজে খুঁজে দেখেন। তারপর নিশ্চিত হন। ঠিক একই কিস্সা নানা সাহেবের ব্যাপারেও!
শেষ পযন্ত নিশ্চিত হয়ে সবাই খুশি! আনন্দ। আহ্লাদিত। শুকরগুজার।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে মায়ের জমনসুখের মাধ্যম করে দুনিয়ার পাঠিয়েছেন। মা খুশি হলেন। বাবা খুশি হলেন। খুশি আমার আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শীরা সকলেই।
এরপর আমার ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়। তারপর ছোট দুই বোনের।
ধীরে ধীরে আমরা বড় হতে থাকি। আর দেখি মায়ের সংগ্রাম। দিনকে রাত আর রাতকে দিন করে অসহ্য কাটুনি কেটে যাচ্ছেন। এ জীবনে তাকে এতটুকু ফুরসত পেতে দেখিনি। সেই ছোটবেলা থেকে আজ অবধি তার সংগ্রাম দেখে আসছি।
আমি ও আমরা কি পারবো মা-বাবাকে খুশি করতে? আমাদের কাজ-কর্ম দিয়ে? তাদের একটু সেবা করে দোয়া নিতে? তাদের নেক নজর কি এ গুনাহগারদের উপর থাকবে?
হে আল্লাহ! যেমন সুখের বার্তা নিয়ে আপনি দুনিয়াতে এ গুনাহগারকে পাঠিয়েছেন। দুনিয়া ও আখিরাতে আমাকে ও আমাদেরকে মা-বাবার সুখের মাধ্যম হওয়ার তাওফীক আপনি দান করুন। তাদের ছাঁয়া যেন দীর্ঘদিন আমাদের উপর থাকে। আমরা যেন মা-বাবার সুখের সমারোহ দেখে দুনিয়া থেকে যেতে পারি। পরপাড়েও যেন মা-বাবাকে নিয়ে আপনার শান্তিরনীড় জান্নাতে একসাথে বসবাস করতে পারি, সে তাওফীক আপনি দান করুন। আমীন!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


