বাংলাদেশের অহংকার বিজ্ঞানী ড.দেবেন্দ্রমোহন বসুর ১২৯তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কণা-পদার্থবিদ্যা (Particle physics) গবেষণার অগ্রদূত ড. দেবেন্দ্র মোহন বসু। যিনি পদার্থবিজ্ঞান জগতে ডি. এম. বোস (D. M. Bose) নামে অধিক পরিচিত। ভারতীয় উপমাহাদেশের তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এ উপমহাদেশে উইলসন ক্লাউড চেম্বার নিয়ে প্রথম এ দেশে পরমানু বিজ্ঞান সম্পর্কে গবেষনায় ব্রতী হয়েছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে আরো একজন বসু আছেন যাঁদের নাম জগদীশচন্দ্র বসু ও সত্যেন বসু। তাঁদর মতো দেবেন্দ্র মোহন বসুর নাম অতটা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত না হলেও মহাজাগতিক রশ্মি, পারমাণবিক ও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার গবেষণায় তার অবদান অসীম। ১৯২৩ সালে তিনি তাঁর গবেষক ছাত্র এস কে ঘোষকে সাথে নিয়ে ক্লাউড চেম্বারে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ শুরু করে হিলিয়াম গ্যাসের মধ্যে পোলোনিয়াম থেকে উৎসরিত আলফা কণার গতিপথ পর্যবেক্ষণ করেন এবং নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের গতিপথের ছবি তোলেন। ছবিতে ধরা পড়লো যে নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াস বিয়োজিত হয়েছে। বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে তাঁদের তোলা ছবি ও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলে আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া পড়ে যায়। তি্নিই প্রথম ফটোগ্রাফিক ইমালশন পদ্ধতিতে ‘মেসন’ এর ভর নির্ণয় করেছিলেন। তাঁর পদ্ধতি অনুরসণ করে মেসনের ভর নির্ণয়ের জন্য ১৯৫০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েল (Cecil Frank Powell)। পাওয়েল নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে দেবেন্দ্রমোহনের পদ্ধতি ছিলো এরকম পরীক্ষার পথ-প্রদর্শক। পদ্ধতি জানা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র উন্নতমানের উপাদানের অভাবে বাঙালির হাত ছাড়া হয়ে গেল আরো একটি নোবেল পুরষ্কার। আজ এই পদার্থ বিজ্ঞানীর ১২৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৮৫ সালের আজকের দিনে তিনি কিশোর গঞ্জের ইটনায় জন্মগ্রহণ করেন। বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসুর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
দেবেন্দ্র মোহন বসু ১৮৮৫ সালের ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর এলাকা ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহিনী মোহন বসু এবং রেংলার আনন্দ মোহন বসু তার সহোদর কাকা। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর আপন মামা। শৈশবে দেবেন্দ্রমোহনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল একটি ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। বালিকা বিদ্যালয় হলেও এতে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পর্যন্ত সহশিক্ষা চালু ছিল। এরপর তিনি আনন্দমোহন বসু প্রতিষ্ঠিত সিটি স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং এ স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেছেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পিতৃবিয়োগ ঘটলে মাতুল বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্যে ভারতে বসবাস করেন। এন্ট্রান্স পাশ করে দেবেন্দ্রমোহন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর দ্রুত জীবিকা অর্জ্জনের তাগিদে প্রকৌশলী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ভর্তি হলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। এ সময় তিনি ছাত্রবাসে থাকতেন। কিছুদিন পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাঁকে বাড়ী ফরেঁ আসতে হয়। ফলে প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন পূরণ হয়নি তার। এসময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরামর্শ দিলেন মামা জগদীশচন্দ্রের মত পদার্থবিজ্ঞান পড়তে। দেবেন্দ্রমোহন পুনরায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন পদার্থবিদ্যা আর ভূতত্ত্ব নিয়ে। যথাসময়ে প্রথম শ্রেণী সহ বিএসসি পাস করলেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। জগদীশচন্দ্র বসু তখন বায়োফিজিক্স ও প্ল্যান্ট ফিজিওলজি নিয়ে গবেষণা করছেন। দেবেন্দ্রমোহন শিক্ষানবিশ গবেষক হিসেবে জগদীশচন্দ্রের রিসার্চ গ্রুপে যোগ দেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রমোহন ইংল্যান্ডে গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ক্যাভেনডিশ ল্যাবে স্যার জে জে থমসন ও চার্লস উইলসনের সাথে কাজ করার সুযোগ লাভ করলেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রমোহন লন্ডনের রয়েল কলেজ অব সায়েন্সে ভর্তি হলেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকেই ডিপ্লোমা ও প্রথম শ্রেণীর অনার্স সহ বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
(বিখ্যাত বিজ্ঞানী মামা জগদীশচন্দ্র বসুর পেছনে দাঁড়ানো দেবেন্দ্রমোহন বসু)
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এসে দেবেন্দ্রমোহন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ঘোষ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কলেজে যোগ দিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ঘোষ ভ্রমণ বৃত্তি’ পেলেন দেবেন্দ্রমোহন। বৃত্তি নিয়ে ১৯১৪ সালে তিনি ভর্তি হলেন বার্লিনের হামবোল্ড ইউনিভার্সিটিতে। দুবছর পড়াশোনা ও গবেষণা করলেন প্রফেসর এরিখ রিগনারের গবেষণাগারে। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ইউরোপে। যুদ্ধের কারণে থিসিস জমা দিতে পারলেন না তিনি। পাঁচ বছর তাকে জার্মানিতে থাকতে হলো। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে পিএইচডি সম্পন্ন করে ভারতে ফিরে দেবেন্দ্রমোহন যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আগের পদে। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে তিনি ছিলেন। এবছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত প্রফেসরের পদ খালি হলে দেবেন্দ্রমোহন ‘ঘোষ প্রফেসর’ পদ ছেড়ে ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দিয়ে তিন বছর ছিলেন এই পদে। তার মামা জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালনার ভার এসে পড়ে দেবেন্দ্রমোহনের ওপর। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ পর্যন্ত তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দির পরিচালনা করেন। এসময় দেবেন্দ্রমোহন নতুন নতুন বিভাগ খুলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাপ্রদান ও গবেষণামূলক কাজের ব্যাপক প্রসার ঘটান। ভারতে বিজ্ঞানের প্রসারে নিরলস কাজ করে গেছেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯৪৩ সালে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। দেবেন্দ্রমোহনকে ভারতের কণা-পদার্থবিদ্যা (Particle physics) গবেষণার অগ্রদূত বলা হলেও তিনি চুম্বকত্ব নিয়েও চমৎকার গবেষণা করেছেন। ১৯৪৫ সালে নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ হিসেবে এটমিক এনার্জি কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। সিটি কলেজের ব্যবস্থাপনার সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। দীর্ঘ আঠারো বছর বিশ্বভারতীর সাম্মানিক কোষাধ্যক্ষ ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। ২৫ বছর ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশনের। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। সমরেন্দ্রনাথ সেন ও সুব্বারাপ্পার সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইতিহাস। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ সাময়িকীর প্রধান সম্পাদক ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ডি. এম. বসুর সরাসরি সম্পৃক্ততা না ঘটলেও অপ্রত্যক্ষভাবে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে একটি ঘটনার সাথে। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ দু’বছর প্যারিস ও বার্লিনে শিক্ষা-ছুটি শেষে সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন প্রতিষ্ঠিত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে সুখ্যাতি নিয়ে। ১৯২৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। ড. দেবেন্দ্রমোহন বোসও ছিলেন একজন প্রার্থী। অন্যদিকে সত্যেন বোসও ছিলেন একজন যোগ্য ও শক্তিশালী প্রার্থী, যিনি ১৯২১ সাল থেকে রীডার পদে অধিষ্ঠিত, যাঁর পক্ষে আইনস্টাইন, পল লেঞ্জেভিনের মত খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এত বড় বড় মানুষের সুপারিশ সত্ত্বেও নির্বাচক কমিটি বিখ্যাত পদার্থবিদ সোমেরফিল্ডের (Sommerfeld) সুপারিশ ক্রমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দেবেন্দ্রমোহন বোসকে অধ্যাপক পদে নির্বাচন করেন। তবে কাযনির্বাহী পরিষদ ১৯২৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সিদ্ধান্ত নেয় যে ড. দেবেন্দ্রমোহন বোস অপারগতা প্রকাশ করলে সে স্থানে সত্যেন বোস অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাবে। দেবেন্দ্রমোহন বসু এই পদে যোগ না দেওয়ায় ১৯২৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সত্যেন বোস অধ্যাপক পদে যোগ দেন।
আশ্চর্যের বিষয় যে এরকম একজন কর্মবীর এবং প্রথম সারির বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও দেবেন্দ্রমোহন কেন যেন রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। তিনি যে প্রচারবিমুখ ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে শুধু জন্মসূত্রে নয়, মেধা ও যোগ্যতায়ও যিনি জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আনন্দমোহন বসুর মত মানুষের উত্তরসুরি তিনি কেন তুলনামূলক ভাবে অপরিচিত-প্রায়! ১৯৭৫ সালের ২ জুন ভারতের কলকাতা শহরে পরলোক গমন করেন বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু। আজ এই পদার্থ বিজ্ঞানীর ১২৯তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের গর্ব কিশোরগঞ্জের অহংকার বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসুর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কুড়ি শব্দের গল্প
জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!
সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্ম ও বিজ্ঞান
করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন