সমস্ত প্রশংসা আকাশ-যমীনের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর জন্য। যিনি জীবন-মরণের একমাত্র মালিক। তিনি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করার জন্য এবং সীমা লংঘণকারীদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্যে সমস্ত মাখলুকের মৃত্যু ও পুনরুত্থান অবধারিত করেছেন। দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর বংশধর ও সৎকর্মশীল সাথীদের উপর। নদীর সাথে মানুষের চলার গতির যথেষ্ট মিল রয়েছে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আপনি এখন যে পানি অবলোকন করছেন সেটি একটু আগে বয়ে যাওয়া পানি নয়। অথচ নদী সেটিই। এমনিভাবে বর্তমান পৃথিবীতে আপনি যাদের সাথে বাস করছেন, তাদের কেউ পাঁচ শত বছর পূর্বের মানুষ নয়। তারা এ পৃথিবীতে আপনার মতই বসবাস করেছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আপনি এখন তাদের স্থান দখল করে বসেছেন। আপনিও চলে যাবেন। আপনার স্থানে অন্যরা আসবে। মানব জাতির চলার এ গতি একদিন থেমে যাবে। সেদিন পৃথিবীতে বসবাসরত সকল মানুষ একসাথে নিঃশেষ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। রাতের তারকাগুলোর আলো নিভে যাবে। সাগরের ঢেউ থেমে যাবে। নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যাবে। আজ আমি কিয়ামত সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো তাদের জন্য যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী।
কিয়ামত শব্দের অর্থ উঠে দাঁড়ানো। এটি আরবি শব্দ কিয়াম থেকে আগত যার অর্থ উঠা। কিয়ামত ও পরকালে বিশ্বাস ঈমানের অংশ।ইসলাম ধর্মে অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যেদিন ইসরাফীল (আঃ) শিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন সে দিন কিয়ামত হবে, অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেওয়ার সাথে সথেই আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ খসে পড়বে, পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তুলার মত উড়তে থাকবে। সকল মানুষ ও জীব-জন্তু মরে যাবে, আকাশ ও সমগ্র পুথিবী ধ্বয়স যাবে। দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত সৃষ্টজীবের আর্বিভাব হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে। কিয়ামতের সঠিক সময় আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী কিয়ামত খুব বেশি দূরে নয়। কেননা কোরআনে কিয়ামতের সময়কাল বোঝাতে ‘নৈকট্যবাচক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কিয়ামত সম্পর্কে জানতে চাইলে আল্লাহ ওহি নাজিল করেন। ইরশাদ হয়, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১) আল্লাহ আরো বলেন, ‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা কামার, আয়াত : ১) অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনার কাছে কিয়ামত কখন হবে জিজ্ঞাসা করছে? তার আলোচনার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক! তার পরম জ্ঞান আছে তোমার প্রতিপালকের কাছে।’ (সুরা নাজিয়াত, আয়াত : ৪২-৪৪)
কিয়ামতের আগের সমাজ যেমন হবেঃ
যখন চরিত্র দুর্বল হবে, মা-বাবার প্রতি সন্তানের অবাধ্যতা বৃদ্ধি পাবে। সন্তানরা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে। তারা তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করবে যেমন মুনিব তার গোলামের সঙ্গে করে। সামাজিক রীতি ও মূল্যবোধ পাল্টে যাবে। তাতে ভালো-মন্দের মিশ্রণ ঘটবে। নিচু শ্রেণির মানুষ জাতির শাসক ও নেতা হবে। অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ-সম্পদ থাকবে। বিলাসিতা ও অপচয় বেড়ে যাবে। মানুষ গর্ব করবে অট্টালিকার উচ্চতা আর ভোগের সামগ্রী ও আসবাবপত্র নিয়ে। যদিও তারা ফকির ছিল ও দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটাত এবং তারা অন্যের দয়ায় জীবন যাপন করত। যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দাসি তার মনিবকে প্রসব করবে, তুমি দেখতে পাবে যাদের পায়ে জুতা এবং পরনে কাপড় নেই, নিঃস্ব ও বকরির রাখাল তারা উঁচু উঁচু প্রাসাদ তৈরিতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১)
যেভাবে সংঘটিত হবে কিয়ামতঃ
ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে। আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-নক্ষত্র কোনো কিছুই আপন অবস্থায় অবশিষ্ট থাকবে না। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে কিয়ামত কখন ঘটবে? আপনি বলুন! প্রকৃতপক্ষে তার জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকের কাছেই আছে। শুধু তিনিই যথাসময়ে তা প্রকাশ করবেন; তা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে একটি ভয়ংকর ঘটনা হবে। আকস্মিকভাবেই তা তোমাদের ওপর আপতিত হবে। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮৭)
আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের সঠিক সময় কাউকে অবগত করেন নি। উদ্দেশ্য হলো মানুষ যাতে সবসময় সতর্ক থাকে , পরকালের জন্য পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে এবং সর্বদা সৎকাজে লিপ্ত থাকে। কিয়ামত মানব জাতির একস্থান থেকে অন্য স্থানে গমণ মাত্র। অচিরেই এমন একদিন আসবে যেদিন আমরা সবাই নতুন এক জগতে ফিরে যাবো। সেখানে আমাদের সকল কাজের হিসাব নেয়া হবে। কিয়ামতের দিন ওই কঠিন সময়ে আল্লাহ কিছু ব্যক্তির দিকে তাকাবেন না। দুনিয়াতে তারা আল্লাহর রহমতে সব সুখ শান্তি পেলেও তাদের কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের ওপর রেগে থাকবেন। তারা সেদিন আল্লাহর সুদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবেন। তাদের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না। তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন।
যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অস্বীকার ও শপথকে তুচ্ছ বিনিময়ে বিক্রি করেঃ
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অস্বীকার এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রিয় করে, এরা আখিরাতে কোনও অংশই পাবে না এবং আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না। বস্তুত তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা আলে ইমরান: ৭৭)
খোঁটা দানকারীঃ
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, তিন ধরণের লোক এমন আছে, মহান আল্লাহ যাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, কিয়ামতের দিন তাদের দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবে না বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আমি (আবু হুরায়রা) বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? ওরা তো ক্ষতিগ্রস্ত! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপর পরিধানকারী, ব্যবসার সামগ্রী মিথ্যা শপথ দিয়ে বিক্রয়কারী এবং কাউকে কিছু দান করার পর তার খোঁটা দাতা।’ (মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, হাদিস নম্বর: ২৯৪) অন্য হাদিসে এসেছে ‘লুঙ্গির যে পরিমাণ অংশ টাখনুর নিচে থাকবে, ওই পরিমাণ জাহান্নামে যাবে।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর ৫৭৮৭)
পোশাকের মাধ্যমে অহংকার ও বড়ত্ব প্রকাশকারীঃ
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না, যে অহংকারবশত পোশাক প্রলম্বিত ও প্রদর্শিত করে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৮৫৬)
বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক ও অহংকারী দরিদ্রঃ
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেবেন না। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তারা হলো বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক ও অহংকারী দরিদ্র।’ (মুসলিম শরীফ, ঈমান অধ্যায়, হাদিস নম্বর: ২৯৬)
রুকু ও সিজদার মাঝখানে যারা মেরুদণ্ড সোজা করে নাঃ
ত্বলাক বিন আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন ওই নামাজির দিকে (রহমতের দৃষ্টিাতে) তাকাবেন না, যে রুকু ও সিজদার মাঝাখানে সোজা হয়ে দাঁড়ায় না।’ (তিরমিজি, হাদীস: ২৬৫)
মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, নারী হয়ে পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী ও দাইয়ুসঃ
আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তিন ধরণের মানুষের দিকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন দৃষ্টিপাত করবেন না। মাতা-পিতার অবাধ্য, পুরুষের সদৃশ অবলম্বনকারী নারী এবং দাইয়ুস। আর তিন প্রকার লোক জান্নাতে যাবে না। মাতা-পিতার অবাধ্য, মদ পানে আসক্ত এবং অনুদানের পর খোঁটাদাতা।’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নম্বর : ৬১১)
সমকামীঃ
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না, যে ব্যক্তি পুরুষের সঙ্গে কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে পায়ুপথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে।’ (তিরিমিজি, হাদিস নম্বর: ১১৭৬)
কিয়ামত কখন হবে তা নিয়ে গবেষণা করা অনর্থক। কিয়ামতের জন্যে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা এবং সর্বদা আনুগত্যের কাজে লিপ্ত থাকাই প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির একান্ত করণীয়। আমরা যেন সবাই উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যেন সবাই ইবাদতে মশগুল থাকি, মহান আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের কবুল করে নেন। আমিন।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৩৭