somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্রোহ ও প্রেমের কবি আবুল হাসানের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৬ শে নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, আধুনিক কবি সাংবাদিক আবুল হাসান। মধ্যষাটের দিকে আধুনিক বাংলা কবিতার যুবরাজ কবি আবুল হাসানের আগমন ঘটে। সময়টি ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকাল, দুঃসহ সময়। অন্যদিকে তখন থেকেই শুরু হয় বাঙালি রেনেসাঁসের পুনরুজ্জীবন বা নতুন করে পথচলা। কারণ ’৫২-এর মহান ভাষা-আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছিল একটি একক জাতিসত্তাবোধ, পূর্ণাঙ্গ ও পরিশুদ্ধ ভাবনা। আর সেই ভাবনা থেকে ব্যক্তি ও কবি আবুল হাসান কখনো পৃথক ছিলেন না।সমসাময়িক লেখক বন্ধুদের ভাবনা থেকে একটু ভিন্ন ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের কাব্যসহিত্যে আবুল হাসান নির্মাণ করেন একটি স্বকীয় কাব্যভুবন। আবুল হাসানের চারিদিকে রাজনৈতিক আলোড়ন, স্বেচ্ছাচার, মূল্যবোধহীনতা, মানুষের প্রত্যাহিক জীবন-যন্ত্রণা, যুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর বিপন্নতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই নেতিবাচকতায় নিজেকে নিবেদিত না করে তিনি শোনালেন আশার গান।
“ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও”

পাথর থেকে লাবণ্য ঝরানোর কবি আবুল হাসানের প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া, আর সাহিত্যক নাম আবুল হাসান। আবুল হাসান অল্প বয়সেই একজন সৃজনশীল কবি হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। মাত্র এক দশকের কাব্যসাধনায় তিনি আধুনিক বাংলার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। বাংলাদেশের আধুনিক কবি ও সাংবাদিক আবুল হাসান ষাট দশকের জনপ্রিয় কবিদের একজন এবং সত্তুর দশকেও জনপ্রিয় ছিলেন। আত্মত্যাগ, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতিমুগ্ধতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবুল হাসানের কবিতায় সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আবুল হাসান যতটা নাগরিক চেতনায় দুঃখবোধ উচ্চারণ করেন। তার চেয়ে বেশি মগ্ন ছিলেন লোকায়ত দর্শনের প্রতি। তাঁর কবিতায় লোকায়ত দর্শনের পাশাপাশি ভারতীয় পুরাণ কাহিনি, গ্রিক ও পাশ্চাত্য মিথ একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে। বাংলার ভাববাদী দর্শন লোকায়তচর্চা তিনি তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে মূর্ত করেছেন। মাত্র ২৮ বছরের জীবনকালে আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত বেশ কিছু কবিতা। মধ্যষাট থেকে যাত্রা শুরু করলেও স্বাধীনতা-উত্তর অস্থিরতায় ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে ৪৫টি কবিতাসমৃদ্ধ কবি আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় রাজা যায় রাজা আসে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ ও খরাপীড়িত দেশে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ যে তুমি হরণ করো প্রকাশিত হয়। তার আরো পরে ৪৪টি কবিতা গ্রন্থিত আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে পৃথক পালঙ্ক নামে। বস্ত্তত এই কাল-পরিক্রমায় কবি আবুল হাসান প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই আস্তে-আস্তে উত্তরণের পথে যেতে থাকেন, যার বাস্তব রূপায়ণ চোখে পড়ে পৃথক পালঙ্কে। ১৯৭০ সালে এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হন। মাত্র ২৮ বছরের জীবনকালে আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত বেশ কিছু কবিতা। এছাড়াও রয়েছে গল্প ও কাব্যনাটক। ১৯৭৫ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ কবির ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রেম ও্ দ্রোহের কবি আবুল হাসানের মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি


কবি আবুল হাসান ১৯৪৭ সালের ০৪ আগষ্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ার বর্নি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা আলতাফ হোসেন মিয়া ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। আবুল হাসান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে এস.এস.সি পাশ করেন। তারপর বরিশালের বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ শ্রেণীতে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষা শেষ না করেই ১৯৬৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তাবিভাগে যোগদান করেন। পরে তিনি গণবাংলা (১৯৭২-১৯৭৩) এবং দৈনিক জনপদ-এ (১৯৭৩-৭৪) সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বহু বর্ণিল জীবন পাড় করেছেন তিনি। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি দৈনিক জনপদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ ১। রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২) ২। যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪) ৩। পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫) এছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশ হয়েছে মেঘের আকাশ আলোর সূর্য। জার্মানি থেকে ফিরে এসে আবুল হাসান ‘কুক্কুরধাম’ নামে একটি বৃহৎ কাব্য রচনার পরিকল্পনা করেন। এর বেশ কিছু অংশ তিনি রচনাও করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি তা আর শেষ করতে পারেননি। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, ফখরুল ইসলাম রবি ও জাফর ওয়াজেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা, যা তাঁর শিল্পচিত্তের প্রামাণ্য দলিল। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮২ সালে মরনোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।


কবি আবুল হাসান দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলেন, সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো বার্লিনে। ফিরে আসার পর কবি আবুল হাসান অল্প কিছুদিন ভালো ছিলেন, তারপর তাঁকে আবার পি জি হাসপাতালে (এখন শেখ মুজিব হাসপাতাল) ভর্তি করতে হয়। কিন্তু সকল চেষ্টাকে ব্যার্থ করে মাত্র ২৮ বছর বয়সে কবি আবুল হাসান ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। স্বল্প জীবনকালের কবি আবুল হাসান আমাদের কাব্যজগতে ৬০ দশকের কবি। ২৮ বছর তাঁর জীবনকাল। মাত্র ১০ বছর তাঁর কাব্য জীবন। আবুল হাসানের কবিতায় উদ্দাম যৌবনের গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আবুল হাসান তাঁর সৃষ্টিতে আজো স্বতন্ত্র। তার স্বর ভিন্ন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আরও ঋদ্ধ প্রকাশ ও নির্মাণ লক্ষ করতে পারতাম, তার অকাল মৃত্যুতে নিশ্চয়ই আমরা সে প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত কবির ১ম কাব্যগ্রন্থ 'রাজা যায় রাজা আসে' বই এর নামকরণের মতই বলতে ইচ্ছে করে কত কবি আসে কত কবি আবার চলেও যায় তবু একজন আবুল হাসান আর আসেন না। এই অপূর্ণতা আমাদের কষ্ট দেয়। তবে কবি আবুল হাসানের মতো কবিরা যায়ও না, আসেও না; তারা রয়ে যায়। মানুষের হৃদয়ের কাছে খুব গভীর কষ্টের মতোই আবুল হাসান রয়ে যায়!


কবি আবুল হাসান সাতচল্লিশ উত্তর কালের বাঙ্গালির জন্য কামনা করেছেন। মধ্যযুগের কবি দেবীকে সামনে পেয়েও অর্থ নয়, বিত্ত নয়, প্রসাদ নয়, কবি চেয়েছেন “আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।”তাঁর রচনার মধ্যে রয়েছে সর্বনাশের পাশাপাশি সম্ভাবনার ইঙ্গিত। প্রগাঢ় ইতিবাচক চেতনায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। মারী ও মড়কের কান্নার মধ্যেও তিনি অসীম শান্তির বানী মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন। অনিঃশেষ শান্তিকামী আলোর ঝলকানি তাঁর সৃষ্টিকে করে স্বতন্ত্র। ‘উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!/মানুষের লোকালয়ে ললিতলোভনকান্তি কবিদের মতো/তুমি বেঁচে থাকো, তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!’কবি আবুল হাসানের আজ কবির ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রেম ও্ দ্রোহের কবি আবুল হাসানের মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:২২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×