আল্লাহ তাআলা পৃথিবিতে জড় ও জীব মিলে সর্বমোট ৮০ হাজার বস্তু সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে স্থলভাগে ৪০ হাজার এবং পানিতে ৪০ হাজার। এসব সৃষ্টির মধ্যে জিন, ফেরেশতা ও মানুষ সেরা; তবে মানুষই আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেনঃ ‘আমি অবশ্যই মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি এবং স্থলে ও সমুদ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছি।’ (সূরা ইসরাঃ ৭০) আর মানুষের মধ্যে ঈমানদারের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। পবিত্র কোরআনে উত্তম মানুষকে মুহসিন—অনুগ্রহশীল, সিদ্দিক—অতি বিশ্বাসী, সালেহ—নেককার, ন্যায়পরায়ণ ইত্যাদি বলা হয়েছে। আর অসৎ ব্যক্তিকে জালেম-অত্যাচারী, ফাসেক-পাপী, মুদিল্ল-পথ হারা, কপট ইত্যাদি বলা হয়েছে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে আবদার করলেন, হে রব! আপনি মানবজাতিকে দুনিয়া দান করেছেন, তারা পানাহার করে, বস্ত্র পরিধান করে আর আমরা সদা আপনার প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করছি। আমরা পানাহ করি না, কোনও কৌতুক করি না, তাই মানবজাতিকে যেমন দুনিয়া দান করেছেন, তেমনিভাবে আমাদের আখেরাত দান করুন। আল্লাহ তাআলা প্রত্যুত্তরে বললেন, যাদের আমি নিজ কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছি, তাদের সমতুল্য এমন কাউকে করব না, যাদের কুন (হও) দ্বারা সৃষ্টি করেছি।’ (আল-মুজামুল আওসাত:৭/৯৯) তবে মানুষ যদি আল্লাহর নির্দেশ মতো চলে, তাহলে সে ফেরেশতাকেও ছাড়িয়ে যায়। আর যদি গোমরাহির মধ্যে থাকে। ইসলামের বিধান মানতে নারাজ হয়, তাহলে সে শয়তানের চেয়ে খারাপ হয়ে যায়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি-বিবেক দিয়েছেন। কিন্তু অন্য কোনও মাখলুকাতকে সেটি দেননি। ফলে মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে পারে। আর মানুষের সেই চিন্তা-ভাবনা যদি ঈমানের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়। সবার কল্যাণের জন্য হয়, তাহলে ফেরেশতার থেকেও অধিক মর্যাদার অধিকারী হয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হয়েছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তখন তা দুলতে থাকে। অতঃপর তিনি পর্বতমালা সৃষ্টি করে তার ওপর তা স্থাপন করেন। ফলে পৃথিবী স্থির হয়ে যায়। ফেরেশতারা পর্বতমালা দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে পর্বত থেকে মজবুত কি কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ, তা হলো লোহা। ফেরেশতারা আবার প্রশ্ন করল, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে লোহা থেকে মজবুত কি কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ আছে, তা হলো আগুন। ফেরশতারা আবার প্রশ্ন করে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে আগুনের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কি কোনো কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ আছে, তা হলো বাতাস। ফেরেশতা প্রশ্ন করে, হে আমাদের রব! আপনার সৃষ্টির মধ্যে বাতাসের চেয়ে অধিক প্রবল কি কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, ‘হ্যাঁ আছে, তা হলো আদম সন্তান। সে ডান হাতে যা দান করে, বাঁ হাত থেকে তা গোপন রাখে।’ (মুসনাদ আহমদ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৬) এ ছাড়াও মানুষের মধ্যে এমন কিছু গুণ আল্লাহ দান করেছেন, যা অন্য সৃষ্টির মধ্যে নেই। সুশ্রী চেহারা, সুষম দেহ, সুষম প্রকৃতি, অঙ্গসৌষ্ঠব ইত্যাদি একমাত্র মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোনো জীবকে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া বুদ্ধি ও চেতনায় মানুষকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দান করা হয়েছে। ফলে মানুষ সমগ্র ঊর্ধ্বজগৎ ও অধোজগেক নিজের কাজে নিয়োজিত করতে পারে। তাকে বিভিন্ন সৃষ্ট বস্তুর সংমিশ্রণে বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত করার শক্তি দেওয়া হয়েছে। বাকশক্তি ও পারস্পরিক মতবিনিময়ের যে নৈপুণ্য মানুষ লাভ করেছে, তা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। ইঙ্গিতে মনের কথা অন্যকে বোঝানো, লেখা ও চিঠির মাধ্যমে গোপন ভেদ অন্য পর্যন্ত পৌঁছানো—এসব মানুষেরই স্বাতন্ত্র্য। সব প্রাণী একক বস্তু আহার করে। কেউ কাঁচা গোশত, কেউ মাছ আবার কেউ ফলমূল আহার করে। একমাত্র মানুষ সংমিশ্রিত খাদ্য প্রস্তুত করে ভক্ষণ করে। বিবেক-বুদ্ধি ও চেতনা মানুষের সর্বপ্রধান শ্রেষ্ঠত্ব। এর ফলে সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তা ও প্রভুর পরিচয় এবং তাঁর পছন্দ ও অপছন্দ জেনে পছন্দের বিষয় গ্রহণ করে এবং অপছন্দের বিষয় বর্জন করে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজি (সাঃ) বলেছেন, ‘মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে সাধারণ ফেরেশতার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : ১/১৭৪)। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, জায়েদ ইবনে হারাম (রা.) নামে এক গ্রাম্য সাহাবি নবীজিকে (সাঃ) গ্রামের জিনিস উপহার দিতেন। তিনিও তাকে শহরের জিনিস উপহার দিতেন। নবীজি (সাঃ) উপহাস করে বলতেন, জায়েদ আমার গ্রাম্য বন্ধু, আর আমি তার শহুরে বন্ধু। নবীজি (সাঃ) তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। জায়েদ (রাঃ) ছিলেন খুবই কৃষ্ণকায় ব্যক্তি। একদা জায়েদ (রাঃ) মদিনার বাজারে গ্রামের জিনিসপত্র বিক্রি করছিলেন, এমতাবস্থায় নবীজি (সাঃ) জায়েদকে (রাঃ) চেহারা ফিরিয়ে নবীকে (সাঃ) দেখতে পেয়ে জায়েদকে (রাঃ) পেছন দিক দিয়ে জাপটে ধরেন। জায়েদ (রঃ.) নবীকে (স.) চিনতে না পেরে বলেন, তুমি কে? আমাকে ছেড়ে দাও। জায়েদ চেহারা ফিরিয়ে নবীকে (সাঃ) দেখতে পেয়ে নিজের শরীরকে প্রিয় নবী (সাঃ) এর পবিত্র শরীরের সঙ্গে লাগানোর চেষ্টা করেন। নবীজি (সাঃ) বলতে লাগলেন, এ গোলামকে কে কিনবে? আমি একে বিক্রি করবো। জায়েদ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সস্তায় বিক্রি করতে হবে। কারণ আমি কালো-কুৎসিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘জায়েদ! তুমি সস্তা নও, তোমার রবের কাছে তুমি অনেক দামি!’ (তিরমিজি সূত্রে মেশকাত : ৪১৬)। মহানবী (সাঃ) বিদায় হজের ভাষণে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বলেছেন, ‘তোমাদের এই পবিত্র শহরে, এই পবিত্র মাসে আজকের এই দিনটি যেমন পবিত্র ও মর্যাদাবান, তেমনি তোমাদের পরস্পরের রক্ত, তোমাদের পরস্পরের ধন-সম্পদ এবং পরস্পরের মান-সম্মানও তেমনই পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৪)
মহানবী (সাঃ) বলেন, বিচার দিবসে আল্লাহর কাছে মানুষ অপেক্ষা অন্য কোনো সৃষ্টি অধিক সম্মানের হবে না। জিজ্ঞেস করা হয়, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের ক্ষেত্রেও কি এটা প্রযোজ্য হবে? অর্থাৎ নিকটবর্তী ফেরেশতাদের চেয়েও কি মানুষের মর্যাদা বেশি? মহানবী (সা.) প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘নিকটবর্তী ফেরেশতারাও এক শ্রেণির মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান হবে না।’ (বায়হাকি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৪)নবীজি (সাঃ) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘একজন সাধারণ ঈমানদার আল্লাহর কাছে কিছু কিছু ফেরেশতা থেকেও অধিক সম্মানী। অর্থাৎ মুমিনমাত্রই বিশেষ বিশেষ ফেরেশতা থেকে আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানী।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/৫৩) তবে শর্ত হচ্ছে ঈমান ধারণ করে পরিপূর্ণ মুমিন হতে হবে। নবীজি (সাঃ) বলেছেন, ‘মুমিনরা একটি শরীরের মতো, শরীরের একটি অঙ্গে ব্যথা অনুভব হলে সমস্ত অঙ্গের ব্যথা অনুভব হয়।’ (বুখারি : ৬০১১; মুসলিম : ২৫৮৬; মুসনাদ আহমদ : ৪/২৬৮)। নবীজি (সাঃ) আরও বলেছেন, ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে অপমানিত করে না এবং তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে না।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ২/৯০৭; মুসনাদে আহমদ : ২/২৭৭) আমাদের কর্তব্য কোনো ঈমানদারকে কখনও তুচ্ছজ্ঞান না করা। গালাগাল না করা। কারণ ঈমানদারকে গালি দেওয়া ফাসেকি। নবীজি (সাঃ) বলেছেন, ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি এবং তার সঙ্গে যুদ্ধ করা কুফরি।’ (বুখারি : ৬০৪৪; মুসলিম : ৬৩) তাই আাসুন আমরা কোরআন ও হাদিগসের আলোকে ইসলােমের নির্দেশিত পথে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করে পূর্ণ ঈমানদার হয়ে ফেরেশতাদের চেয়েও বেশী মর্যদাবান হয়ে আল্লাহর প্রত্যাশা পূরণ করি। আমিন
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:১০