কবীরা অর্থ বড়। কবীরা গুনাহ মানে বড় পাপ। পাপ হলো শরিয়তের আদেশ–নিষেধ লঙ্ঘন করা, নির্দেশ অবহেলা করা ও নিষেধ অমান্য করা। পাপের আরবি হলো মাছিয়াত, ইছম, তুগইয়ান, জুরম, ফিসক ইত্যাদি। ফারসি, উর্দু ও হিন্দিতে গুনাহ, খতা, পাপ, বদ, বদী ইত্যাদি। পাপ বা অপরাধ ছোট হোক বা বড় হোক, তা সব সময় বর্জনীয়। কোনো ছোট পাপকে হালকা মনে করাও একটি কবিরা গুনাহ বা বড় পাপ। মাত্রাভেদে ও পরিণতির ভিত্তিতে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পাপকে ছগিরা ও কবিরা দুই ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো কুফর ও শিরক। কুফর মানে হলো আড়াল করা, গোপন করা, লুকানো এবং কৃতঘ্নতা বা অকৃতজ্ঞতা। পরিভাষায় কুফর হলো আল্লাহ বা স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করা। এটা সবচেয়ে বড় গুনাহ। এই প্রকার কুফরের কোনো ক্ষমা নেই। কবীরা গুনাহ বা বড় অপরাধ হলো: সেসব আদেশ–নিষেধের লঙ্ঘনে জাহান্নাম, আগুনের শাস্তি বা নির্দিষ্ট আজাবের সাবধানবাণী রয়েছে। এই সব কাজ হারাম। কোরআন)। কবীরা গুনাহ সমূহের মধ্যে বেঈমানি করা বা অঙ্গীকার পূর্ণ না করা একটি ভয়াবহ অপরাধ। অর্থাৎ বেঈমানি করা কবিরা গুনাহ।
পৃথিবীতে মানুষের হরেক রকম চেহারা দেখা যায়। কেউ আপনাকে যেমন তার স্বার্থ হাসিল করার জন্য ব্যবহার করবে আবার কেউ আপনাকে তার প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তার উদ্দেশ কিংবা স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে আপনাকে ভুলে যাবে। যারা উপকারীরই উপকার স্বীকার করে না তাদের এক কোথায় আমরা অকৃতজ্ঞ কিংবা বেঈমান বলে থাকি। বেঈমান ব্যক্তিরা হরেক রকম রূপ দেখায়।তারা যেমন আপনার বিপদের দিনে আপনার বন্ধু হতে সময় নিবে না। আবার ঠিক তেমনি আপনার প্রয়োজনে কিংবা আপনার কষ্টের দিনে তাদের আর খুঁজে পাবেন না। কারণ তারা সুসময়ের বন্ধু হয়ে থাকে সবসময়। তারা সবসময় সুযোগ খুঁজে থাকে আপনার ক্ষতি করার। বেঈমানদের আপনি যতই উপকার করেন না কেন এরা এদের প্রয়োজন শেষ হলে ঠিক আপনাকে ভুলে যাবে। শুধু দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করাই বেঈমানি নয়, বরং রাসুলে করিম (সাঃ) বলেন, ‘চারটি দোষ যার মধ্যে পাওয়া যাবে সে খাঁটি মুনাফিক হবে। আর যার মধ্যে এর একটি পাওয়া যাবে তার মধ্যে মুনাফিকের একটি চরিত্র পাওয়া গেল, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওই অভ্যাস ত্যাগ না করে—যখন আমানত রাখা হয় সে খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিজ্ঞা করে তখন বেঈমানি করে আর যখন ঝগড়া করে তখন গালি দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক ওয়াদা ভঙ্গকারীর জন্য কিয়ামতের দিন একটি নিদর্শন থাকবে তার বেঈমানির পরিমাণ অনুযায়ী তাকে উচ্চ (বৃহদাকার) করা হবে। তবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণাকারী শাসকের চেয়ে বড় বেঈমান আর কেউ হবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩২৭২)
অঙ্গীকার পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্ব বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল : ৩৪)। অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো।’ (সুরা : মায়েদা : ১)। আরো ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করো।’ (আল আনয়াম : ১৫২) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।’ (সুরা : রাদ : ২০) আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ করো।’ (সুরা : নাহল : ৯১)। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হারাম এবং মুনাফেকি। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘চারটি দোষ যায় মধ্যে থাকবে সে পরিপূর্ণ মুনাফিক। আর যার মধ্যে এসবের একটি দোষ থাকবে, তার মধ্যে মুনাফেকির একটি উপাদান থাকবে, যতক্ষণ সে তা বর্জন না করে, কথা বললে মিথ্যা বলে, আমানত রাখলে খেয়ানত করে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে এবং ঝগড়া করলে সীমা ছাড়িয়ে ফেলে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। ১. যে ব্যক্তি অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে এবং ৩. যে ব্যক্তি কোনো কর্মচারী নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না’ (সহিহ বুখারি)। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো নেতার আনুগত্যের অঙ্গীকার করে, তার উচিত সাধ্যমতো তার আনুগত্য করা (সহিহ মুসলিম)।
কবীরা গুনাহের এমনই বৈশিষ্ট্য যদি কোনো মানুষের একটিমাত্র কবিরা গুনাহ থাকে (অন্য কোনো গুনাহ না থাকলেও), ওই কবীরা গুনাহ থেকে যদি সে তওবা না করে এবং আল্লাহ ক্ষমা না করেন, তবে সে ব্যক্তিকে মাত্র ওই একটি কবীরা গুনাহের জন্য জাহান্নামে যেতে হবে। যদিও নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত শাস্তি ভোগের পর ইমানের কারণে ক্ষমা পেয়ে আল্লাহর দয়ায় জান্নাতে প্রবেশ করবে। কবীরা গুনাহ তওবাহ দ্বারা ক্ষমা পাওয়া যায়। কারণ হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ভিন্ন মাবুদ নাই বলবে; সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়)। কবীরা গুনাহের শাস্তির বিষয়ে পবিত্র কোরআনে যেসব স্থানে জাহান্নামে ‘চিরস্থায়ীভাবে’ থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোর বিপরীত বিবরণও কুরআন–সুন্নাহতে বিদ্যমান থাকায় মুজতাহিদগণ বলেছেন, ‘চিরস্থায়ীভাবে’ অর্থ হবে দীর্ঘকাল; অনন্তকাল নয়। (তাফসিরে মাআরিফুল) নবী করিম (সাঃ) বলেন, ‘আমার উম্মতের কবিরা গুনাহওয়ালার জন্য আমার সুপারিশ থাকবে।’ (বুখারি, আল মুসনাদ)। নবীজি (সঃ.)–এর সুপারিশ অবশ্যই গ্রহণ করা হবে। আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘আর অচিরেই আপনার রব আপনাকে এমন দান দেবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।’ (সুরা-৯৩ দুহা, আয়াত: ৫)। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মুমিনের পাপ হয়ে থাকে। ফলে কেউ নিষ্পাপ নয়। একমাত্র নবী-রাসুলরাই গুনাহ থেকে মুক্ত। পাপ করা থেকে বড় অপরাধ হলো পাপ করার পর তা থেকে তাওবা না করা, ফিরে না আসা, অনুতপ্ত না হওয়া এবং বারবার পাপ করা। আল্লাহর প্রেমিকরা পাপ করার সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে ফেলেন। সবারই জানা উচিত যে পাপের অবশ্যই একটা শাস্তি আছে। যদিও আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল। মুমিনের কর্তব্য হলো ছোট–বড় সব গুনাহের বিষয়ে সতর্ক থাকা, বিশেষত কবীিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বেঈমানী করা থেকে বিরত রাখুন। আমিন
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:৪২