somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃকার্নিশ -নুরুন নাহার লিলিয়ান

১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হররগল্প: কার্ণিশ

#নুরুন নাহার লিলিয়ান

উনত্রিশ বছর আগের কথা। তখন ১৯৯০ সাল।আসফিরা তখন বাংলাদেশে নতুন করে সংসার শুরু করেছে। আসফির স্বামী ফাহাদ তখন একটি সরকারি গবেষনাগারে বৈজ্ঞানিক হিসেবে চাকরি করতো । গবেষনাগারটি ঢাকা থেকে একটু দূরে। ঢাকা থেকে যেতে দেড় ঘন্টা সময় লাগে। ঢাকা শহর থেকে সোজা শ্রীনগর ।শ্রীণগরের আড়িয়ল বিল থেকে বিশ মিনিট।

বলা যায় জন মানবহীন বিচ্ছিন্ন জায়গা। গল্পটা এই গবেষনাগারে শেষ হলেও শুরুটা হয়েছিল সূদূর যুক্তরাষ্ট্রে। কারন এর পাঁচ বছর আগে ১৯৮৫ সালে আসফি ফাহাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ছিল। ফাহাদ তখন ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষনা করছিল একটি প্রজেক্টে। সেখানে প্রজেক্ট ডিরেক্টর ছিল মিসেস জেনিফার। বয়স তাঁর প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই ।

বেশ পরিপাটি গুছানো একজন নারী। মিসেস জেনিফার ছিল জন্মগত ভাবে কানাডিয়ান। পড়াশুনা আর চাকরি সুবাদে বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছে।

আসফির স্বামী সব সময়ই ব্যস্ত।

আসফিকে তেমন সময় দিতে পারছিল না। আসফিরা আমেরিকার যে বাড়িতে থাকতো সেটা ছিল এক জিউস সম্প্রদায়ের অবিবাহিত পুরুষের।

তাঁর নাম ছিল এলভিস। সে পেশায় ছিল একজন আর্কিটেক্ট। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িটা ছিল রাজপ্রাসাদের মতো। দুতলা বাড়ির উপরের তলায় থাকতো আসফিরা। আর নিচতলায় এলভিস একাই থাকে। এলভিস নিজের আইডিয়া খাটিয়ে বাড়িটা করেছে। দেয়ালে দেয়ালে যেনো কোন রহস্যময় জীবনের ইতিহাস ভীষণ স্পষ্ট। সে রহস্য উৎঘাটন যেনো একমাত্র আসফি করতে পারবে। আসফি অনুভব করতো বিয়ের পর পরই স্বামীর সাথে হঠাৎ আমেরিকা চলে আসা পুরোটাই যেনো অদৃশ্য কেউ পরিকল্পনা করে রেখেছিল। অদ্ভুত এই অনুভূতির কথা স্বামী ও বুঝাতে পারেনা।

মনেহয় কেউ একজন সব সময় আসফির সাথেই থাকে।

হাঁটে, খায়, ঘুমায়। চোখের সামনে মনেহয় কোন এক যাপিত জীবন অদৃশ্য রঙে আঁকা।

দিনে দুপুরেই যেনো নিঃসঙ্গতা কথা বলে উঠে।

তখন ভীষণ একটা ভয়ংকর অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরে।

একদিন সন্ধ্যায় জেনিফার ফাহাদকে দাওয়াত করে রাতের ডিনারের। তখন আমেরিকার পথে ঘাটে শরতের উৎসব। মানুষ গুলো মেতে আছে নানা আয়োজনে। আসফিদের বাড়ি থেকে দশ মিনিটের রাস্তা জেনিফারের বিলাশ বহুল ডুপ্লেক্স হোম।

সামনে সারি সারি দেশি বিদেশি ফুলের বাগান।

আসফি আর ফাহাদ গাড়ি থেকে নামার পর জেনিফার খুব আন্তরিকতা নিয়ে আসফিকে স্বাগত জানায়।

বুকে জড়িয়ে ধরে।

" ইউ আর ভেরি ইয়াং। ভেরি বিউটিফুল। ফাহাদ সো লাকি। "

" থ্যাংকস। "

আসফি আর ফাহাদের বয়সের পার্থক্য পাঁচ বছরের। কিন্তু ফাহাদ স্বল্পভাষী হওয়ায় বয়সের তুলনায় তাঁর ব্যক্তিতব অনেকটা ভারিক্কি মনেহয়।

ইংরেজিতে জেনিফার কতো কি বলে যায় ফাহাদের সাথে। আসফির সেদিকে মনোযোগ থাকেনা। আসফির মনোযোগ জেনিফারের বাড়ির মধ্যে একদম যেনো তাদের বাড়িওয়ালা এলভিসের বাড়ির মতো।

আসফি একবার কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে ফাহাদকে বাড়িটা দেখতে বলল।

"একদম আমাদের বাড়িটার মতো। এলভিসের নিজের ডিজাইনে করা বাড়ির মতোই এই শহরের সব বাড়ি।"

ফাহাদ উত্তর দেয় "এলভিস নিজের গুরুত্ব বাড়াতে তোমাকে এসব বলেছে ।কোন বাড়ির সাথেই কোন বাড়ির মিল নেই । ভাল করে দেখো । আসফি কেমন নিজেই নিজের দেখার জগত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল ।

রাতের ডিনার করার সময় আসফির দিকে জেনিফার অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিল।

চাহনিটা কেমন যেন ভীষণ চেনা।কিন্তু কোথায় যে দেখেছে মনে করতে পারছে না।

চাহনিটায় অনেক অর্থ বহন করে। আসফি ভেবেছিল হয়তো প্রথম কোন বাংলাদেশিকে দেখেছে তাই কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে।

সেদিনের পর থেকে জেনিফারের সাথে আসফির একটা সম্পর্ক হয়।

ফাহাদ তো বেশির ভাগ সময়ে ল্যাবেই কাজ করে। জেনিফার প্রায়ই আসফিকে ডাকে। মাঝে মাঝে আউটিংয়ে নিয়ে যায়। লং ড্রাইভে যায়। শপিং করতে কিংবা নতুন কোন রেস্তোরায় খেতে নিয়ে যায়।

এক সাথে সন্ধ্যার চা খায়। আসফিকে এমন মায়ের মতো আদর যত্ন করার কারনে ফাহাদ জেনিফারের প্রতি ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ থাকে।

দিন গুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল।কিন্তু মাঝে মাঝে জেনিফারের কিছু অদ্ভুত আচরন আর কাজ আসফির মনে নানা প্রশ্ন তৈরি করে ।

জেনিফার প্রায় আসফি কে বুকে চেপে ধরার সময় খুব জোরে চাপ দেয় । জেনিফারের বুকে চেপে ধরার বিষয়টা কেমন যেন অস্বস্তিকর। মাঝে মাঝে এমন ভাবে চেপে ধরে যে আসফির দম বন্ধ হয়ে আসে। আসফির শরীর হীম হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক তারে শক খেলে যেমন অনেকটা সময় ঝিম লেগে থাকে ঠিক তেমন।

কখনও তাঁর শরীর থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ বের হয় । যেনো অনেক দিনের পঁচা মাংস মাত্র খেয়ে এসেছে ।

একদিন সন্ধ্যায় আসফি টের পেলো ভয়ংকর এক সত্য। যে সত্যটা হয়তো তাঁর জীবনকে বিভ্রান্ত করবে।জেনিফারের ফুলে ফুলে সাজানো বারান্দায় বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। জেনিফার কোন দরকারি একটা ফোনে কথা বলছিল। আসফি বসে বসে আর কি করবে। বারান্দায় থাকা গাছ গুলোর বিচিত্র সৌন্দর্য দেখছিল।

হঠাৎ কিছু একটা দেখে সে আৎকে উঠে। বারান্দার ডান দিকের কার্নিশে মানুষের আঙুল। অনেক গুলো আঙুল। দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন আগে বিশটা আঙুল কেউ অর্ধেক খেয়ে এঁঠো করে ফেলে রেখেছে। এখন পিঁপড়া আর পাখিরা খাচ্ছে।

আসফির তল পেটে কিছু একটা মোচর দিয়ে উঠে। বমি বমি অনুভব হয়। এই বুঝি একদলা বমি পেট মোচর দিয়ে মুখে চলে আসছে। হাত পা থর থর করে কাঁপতে থাকে।

কথা বলার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে।আসফি যেনো মুহূর্তে অন্য ভুবনে হারিয়ে যায়। পুরো পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে ক্রমশ। আৎকে উঠে আসফি ।

এই সময় হঠাৎ সামনে এসে হাজির হয় জেনিফার। পুরো ঘটনাটা আসফিকে সত্য আর মিথ্যার মাঝের দাগ তুলে দেয়।

কোন রকমে সামলে নিয়ে আসফি সেদিন বাসায় ফিরে।

বেশ অনেক দিন আসফি অসুস্থ থাকে। কোন কিছু খেতে পারতো না। ঘুমাতে পারতো না।

শুধু তা নয় সে এলভিসকে প্রায় প্রতিদিন স্বপ্নে দেখতো। এলভিসের শরীরের গলা থেকে মাথাটা নেই। মাথাহীন গলার অংশটা জমাট বাঁধা রক্ত কেমন থল থল করছে। অনেক গুলো অদ্ভুত পোকা মাকড় গলার উপরের জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে কিলবিল করছে।প্রায়ই রাতে আসফি দেখে এলভিস ভয়াবহ ভাবে তাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। তাঁকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠে আসফি।

একা একটা নিঃসঙ্গ বাড়িতে নিজের স্ত্রীর এমন মানসিক অবস্থা ফাহাদকে অসহায় করে তোলে।

ফাহাদ আসফির জন্যই সেই এলভিসের বাড়ি ত্যাগ করে। নতুন বাসা ভাড়া নেয়। কয়েক মাস আসফি ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকে। কোন রোগ ধরা পড়েনা। সব রিপোর্ট নরমাল এলেও আসফি অসুস্থ থাকতো। অধিকাংশ সময়ে সে দূর্বলতা অনুভব করতো, খুব হতো না, অযথা ভয় পেতো। তারপর একদিন এক আমেরিকার এক ডাক্তার পরামর্শ দিলেন জায়গা পরিবর্তন করতে। ফাহাদ বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নিল।

সে জেনিফারের প্রজেক্ট শেষে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট শুরু করে।

নিজের রিসার্চ টার্গেট টাইম শেষ করে নিজ দেশে ফিরে আসে। যোগ দেয় ঢাকার অদূরে ভীষণ নিরিবিলি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শ্রীনগর গবেষনাগারে।

তখন ১৯৯০ সাল। আসফি আর ফাহাদ নতুন করে সংসার গুছায়। শ্রীনগরের ফাহাদের গবেষণারগারটি অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক আভিজাত্যপূর্ণ। এতো সব নাম না জানা ফুল, ফল ও মেডিসিন্যাল গাছ!

আসফি আমেরিকার সুখ ভুলে এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গবেষণারগারের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়।

এখানে নতুন পরিবেশ।নতুন জীবন।এবারও ফাহাদের ডিরেক্টর একজন নারী। ফাহাদ সিনিয়র বৈজ্ঞানিক। উনি একা থাকেন ডিরেক্টর হাউজে। বিয়ে করেননি। অনেক বছর পড়াশুনা করেছেন ইন্ডিয়ায়।

উনি মিসেস রামিজা হাসান হিসেবে পরিচিত।

আসফিরা সুন্দর একটা দুতালা সরকারি বাংলো বাড়ি পেলো। ডিরেক্টর হাউজের খুব কাছাকাছি। আসফির সাথে প্রথম পরিচয় হল অফিসের আয়োজনে এক পার্টিতে।প্রথম পরিচয়েই আসফি মনের মধ্যে বিশাল ধাক্কা খেল। রামিজার চেহারার সাথে জেনিফারের চেহারা প্রায় সত্তর ভাগ মিল। কথা বলার স্টাইল, মুদ্রা দোষ যেমন বার বার চোখে পাতা বন্ধ করা, গায়ে হাত দিয়ে, জড়িয়ে ধরে কথা বলা। পার্থক্য শুধু একটা রামিজা হাসান বেশ কাল। আরও একটা পার্থক্য আছে রামিজার মুখ থেকে প্রায়ই একটা দূর্গন্ধ বের।৷ যেটা জেনিফারের শরীরে পাওয়া যেতো। গন্ধটা ঠিক কেমন ছিল আসফি মনে করার চেষ্টা করলেও মনে করতে পারেনা। ব্যাখ্যাহীন সেই গন্ধটার কথা মনে এলেই আসফির পেটের ভেতর কিছু একটা মোচর দিয়ে উঠে। গা গুলায়। প্রেসার বেড়ে যায়।

ঠিক সে সময় থেকেই জেনিফারের মতো রামিজা ও আসফিকে মেয়ের মতো আদর করে।রামিজা হাসানের বয়স ও অনেক জেনিফারের মতোই। প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। কিন্তু রামিজা হাসানের লাইফ স্টাইল ছিল একটু আলাদা। সে মুসলিম হলেও ভারতীয় লাইফ স্টাইলে অভ্যস্থ ছিল। দীর্ঘদিন ভারতে থাকার কারনে তাঁর জীবনে সে ছায়া রয়ে গিয়েছে। তার রুমে নাম না জানা নানা রকমের মূর্তি ছিল। তিনি নাকি বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছে।

সে সব সময় সাজ গোজ করে থাকতো। এমন ঠোটে লিপস্টিক আর কপালে টিপ নিয়েই সে ঘুমাতো। সে মাংস খেতো না। সে ছিল নিরামিষভোজী।আসফি নতুন সংসারে ভাল মন্দ রান্না কাজের লোক দিয়ে রামিজা হাসান কে পাঠায়। এই গভীর অরন্যে ভাল থাকার একটাই উপায়। নতুন কিছু রাধো, খাও আর গল্প করো। গবেষণারের চারিদিকেই বিল আর বিল। যে দিকে চোখ যায় শুধু জমি আর জমি। এমন করেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। তিন মাস পর। এক সন্ধ্যায় রামিজার আচরণে সেই জেনিফারকে খুঁজে পেলো। রামিজা ও আসফিকে চেপে ধরে বুকে নেয়। মা ও সন্তানের মধ্যে যে ভালোবাসা সেই পবিত্র মাতৃস্নেহ ও কিছু কিছু বিষয়ের কারনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। কথা বলতে বলতে এক সময় মাথায় হাত দেয়। তারপর চুলের ঘ্রাণ নেয়। এক সময় ভয়ংকর ভাবে গলা চেপে ধরে। জোর করে কাছে ডাকে। সময়ে অসময়ে আসফি ফাহাদের সংসারে অনধিকার চর্চা করে।রামিজা ফাহাদের মহিলা বস হওয়ার কারনে আসফি নিরুপায় ছিল। কিছুই বলতে বা এড়িয়ে থাকতে পারতো না। একটা মানুষের ভেতর দ্বৈতসত্তা কাজ করছে। অথচ কোন ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে না। কিন্তু দিনের পর দিন ভয় আর আতংক আসফির মনকে সংকুচিত করে দেয়। আসফি মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়ে। প্রচন্ড মানসিক জটিলতা আর অস্থিরতায় ভুগতে থাকে।

একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে আসফি কেঁদে উঠে। আর সেই দূর্বল মূহুর্তে আসফি ফাহাদকে সব বলে দেয় ।তারপর জেনিফার আর রামিজার আচরণের ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে।সহস্র পথ দূরত্বে থাকা দুজন মানুষ। যারা দু'জনেই ফাহাদের বস আর শুভাকাঙ্ক্ষী। অথচ দুজনের ভেতরেই আসফিকে মেরে ফেলার প্রবণতা।

এসব বিষয় ফাহাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে। আসফির এমন সব অসুস্থতার কারনে ফাহাদ বাচ্চা ও নেওয়ার চিন্তা করতে পারে না।পাল্টে যেতে থাকে আসফি আর ফাহাদের সংসারের গল্প। পৃথিবী খ্যাত চিকিৎসক আর মনোবিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ করে।

চেনা পৃথিবীর বাইরেও আরেকটা পৃথিবী আছে।এমন কি সেই আধ্যাত্মিক জগতের বিজ্ঞজনের পরামর্শ নেয়। কিন্তু আসফির আয়ু ফুরাতে থাকে। আসফির শারিরীক শক্তি ও সৌন্দর্য হারায়,কারও সাথে মিশতে চায়না। সব সময় একা একা থাকতে চায়।

এমনি নির্জীব আর নির্বিকার সময়ের সাথে বন্ধুত্ব করে সময় কেটে যেতে লাগল।

আসফির অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। কেউ তাঁর রোগ ধরতে পারেনা। সব সময় মেডিকেল রিপোর্ট সব নরমাল আসে।

কিন্তু সময় স্বার্থপরতার নিয়মে ধাবমান। মানুষের জীবনের কোন পথে সে কোন কিছুর জন্য বাঁধে না।

একদিন দুপুরে ফরহাদ বাসায় আসে। দুপুরের খাবার না খেয়েই আসফিকে নিয়ে একজন পরহেজগার হুজুরের কাছে নিয়ে যায় ফুপাতো ভাইয়ের পরামর্শে।

শ্রীনগরের বাজার থেকে একটু ভেতরেই ফাহাদের ফুপুর বাড়ি । ফুপাতো ভাই ও ফুপুকে সাথে করে নিয়ে যায়। ফুপুর বাড়ি থেকে বাম দিকে ভাগ্যকুল স্কুল। ভাগ্যকুল স্কুলের পেছনে ছোট একটা মরা পুকুর আছে। সেই পুকুরের বাম দিকে একটা বড় বটগাছ আছে। এমন নিরবিলি পরিবেশ। দিনে দুপুরেই গা ছমছম করে। সেখান থেকে বাম দিকে একটা রাস্তা ধরে প্রায় আধা ঘন্টা ড্রাইভ করলে একটা কবরস্থান। সেটা ঘেঁষে একটা ঘন কলাগাছের বাগান। তারপর একটা ছোট্ট কাঠের তৈরি ঘর।সে ঘর থেকেই বের হয় ইয়াকুব আলী। বাম হাতে এক বালতি কাঁচা দুধ।

বাইরে বাশের তৈরি বেঞ্চিতে বসতে বলল।

ঠিক দশ মিনিট পর লোকটা ফিরে আসে। আর ফাহাদকে আলাদা ডেকে নেয় কিছু নিয়মকানুন বলার জন্য। এরপর দুজন মহিলা আসে আসফিকে নিয়ে যায়। নতুন সূতি কাপড় পড়ানো হয়। বাড়িটির পেছনে একটা কাঠের পিড়িতে বসানো হয়। এরপর মহিলা দুটো চারিদিকে কলাগাছের পাতার তৈরি বেড়া দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর ভেতর থেকে একজন হুজুর বের হয়। তার হাতে একটা কাল কুচকুচে সাপ। ফাহাদ নিজেও কিছুটা ভরকে যায়। মানসিক দূর্বলতা তাকেও ঘিরে ধরতে শুরু করে। কাল সাপটা দিয়ে আসফির মাথা চুলে স্পর্শ করায়। তারপর মহিলা দুটো

কাঁচা দুধ, দূর্বা ও ধান দিয়ে কিছু একটা তৈরি করে গোসল করায়। তাকে নতুন আরও একটি শাড়ি পড়ানো হয়। আসফিকে ভেজা শরীরে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। ফাহাদ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। যে নতুন শাড়ি পড়িয়ে গোসল করানো হয় তা বাড়ির পাশের খালের স্রোতের পানিতে ফেলে দেয়।

ফাহাদ একজন বিজ্ঞানের মানুষ। অথচ কি অদ্ভুত এক বিভ্রান্তির মধ্যে তার জীবন। একটা বিভ্রান্তি ফাহাদকে কেমন অদৃশ্য ভাবে ভেঙে ফেলেছে।

জীবনের অদেখা পথে সব মানুষই কেমন অসহায়!এরপর আসফিকে নিয়ে এক রাত ফুপুর বাড়ি থাকে।

এই চিকিৎসার একটা শর্ত ছিল। চিকিৎসা করানো পর বসবাসের জায়গা থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে রাখতে হবে।

ফাহাদ বাংলাদেশের চাকরিটা ছেড়ে দেয়।ফের আমেরিকার মেরিল্যান্ডে ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে গবেষক হিসেবে চাকরি নেয়।বছর ঘুরতেই আসফির এক জোড়া জমজ ছেলে হয়। আসফিকে ঘিরে

ফাহাদের চোখে ঘটনা কোনদিন কাউকে প্রকাশ করেনি। আসফিও কোনদিন তা মনে করেনি। কিংবা ভুলে গেছে। ফাহাদ ও আর জিজ্ঞেস করেনি।

উনত্রিশ বছর পর।২০১৯ সাল।

আসফি ফাহাদের দুই ছেলে নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে পড়াশুনা করছে। এছাড়া ও তারা দুজনেই ভিন্ন দুই বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে। ভিন্ন দুই পেশায় চাকরি করছে। বর্তমানে শখের বসে ফিল্ম নিয়ে কাজ করছে।নতুন একটি সিনেমা তৈরি করবে।

আমেরিকার পথে ঘাটে সেপ্টেম্বর মাসের প্রকৃতির রঙের পরিবর্তন ।অদ্ভুত সুন্দর আবহাওয়া আকাশে বাতাসে!

এক সন্ধ্যায় মেরিল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক শহরের দিকে প্লেন ছেড়ে যাচ্ছে। ফাহাদ ও আসফি যাচ্ছে ছেলেদের সাথে দেখা করতে। ফিল্ম একাডেমিতে পড়াশুনা করার জন্য নিউইয়র্কে এক বাঙালির দু'তলা বাড়ির নিচতলার দুটো রুম ভাড়া নেয় দুই ভাই। এক বছর থাকবে বলে চুক্তি করে।

আসফি ফাহাদ দু'জনেই ছেলেদের ভাড়া করা বাড়িটি দেখে আতৎকে উঠে।কিন্তু কেউ কারও সাথে বিষয়টি শেয়ার করেনা।

এক সপ্তাহ পর। সেদিন সকালে আসফি ফাহাদ বসে বসে চা খাচ্ছিল। বাইরে মিষ্টি বাতাস বইছে। শীত বা গরমের তেমন বৈরীতা নেই। সেপ্টেম্বরে আমেরিকা সেজে উঠে ভিন্ন রঙে।

হঠাৎ একটা গাড়ি নিচতলার বাম দিকে থামল। আর আসফি ফাহাদের জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার আনন্দ ও থেমে গেলো। দুজনের চোখ বিস্ময়ে ভরে গেলো।

যে বাঙালি লোকটা গাড়ি থেকে নামল ঠিক সেই এলভিসের মতো চেহারা। শুধু চামড়ায় পার্থক্য।

আসফির হাত ফসকে চায়ের কাপ পড়ে গেলো। ফাহাদ একটু এগিয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করল।

ভেতর থেকে ছেলেরা বেড়িয়ে এল। বাবা মায়ের সাথে বাড়িওয়ালার পরিচয় করিয়ে দিল। ফাহাদ করমর্দন করে পরিচিত হল।

আসফি নির্বাক তাকিয়ে রইল।ছোট্ট একটা জীবন! অথচ কতো বড় বড় বিস্ময় নিয়ে বেঁচে থাকা। মানুষের বাইরের দেহটা সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকে ঠিকই। কিন্তু হৃদয়ের কার্নিশে জমে থাকা রহস্য কোনকালেই শেষ হয়না।যেমন শেষ হয় না বেঁচে থাকার যুদ্ধ। তাই মেনে নিতে হয় মৃত্যু অবধি সব মানুষই অদৃশ্য রহস্যের কাছে বন্দী।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×