somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বর্ণ সমাচার : জানুন আপনি কতটা ধনী!

১৭ ই জুন, ২০১৬ রাত ৮:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানব সভ্যতার ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে ধাতুর অবদান অসামান্য। প্রস্থর যুগ থেকে ধাতু ব্যবহারের যুগে প্রবেশের মাধ্যমেই মূলত: আধুনিক সভ্যতার সূচনা ঘটে। স্বর্ণ ধাতু হলেও, সভ্যতা বিকাশে এই ধাতুর অবদান অনেকটা 'বেগুনের' মতোই! আধুনিক সভ্যতা বিকাশে লৌহ, তাম্র বা ব্রোঞ্জের যে অবদান, স্বর্ণের অবদান তার সিকি ভাগ ও নেই। ইদানিং অবশ্য, ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পে যৎসামান্য স্বর্ণের ব্যবহার হচ্ছে; যদিও তা পরিমাণগত দিক থেকে খুবই নগন্য।

ধাতু হিসেবে 'অপদার্থ' হলেও আমাদের সমাজে স্বর্ণের কদর সবচেয়ে বেশী। স্বর্ণের প্রধান ব্যবহার গহনাতেই। স্বর্ণের প্রাচুর্যতা ধনী সমাজের মাপকাঠি। এমন কোনো রমনী নেই যে স্বর্ণের গহনা গলায় পরে খুশি হয় না। ধাতব সমাজে যে স্বর্ণের কোনো অবদান নেই, সেই স্বর্ণই আমাদের কাছে এতো দামী বা মূল্যবান কেন? কেন আমরা ইস্পাতের অলংকার পরে অহংকারী হতে পারি না? এটা কি শুধু স্বর্ণের সৌন্দর্য্য নাকি অন্য কিছু, যা স্বর্ণকে পরিণত করেছে এক মহামূল্যবান ধাতুতে?

এতক্ষনে হয়তো বুঝতে পেরেছেন কেন স্বর্ণ এতো মহা মূল্যবান। হ্যাঁ, ঠিক তাই। স্বর্ণ মহা মূল্যবান কারণ এর অপ্রচুর্যতা। এই পৃথিবীতে স্বর্ণ সবচেয়ে বিরল ধাতুদের মধ্যে বিরলতম। গোটা পৃথিবীর সব খনি থেকে সমস্ত স্বর্ণ উত্তোলন করলে যে পরিমান স্বর্ণ পাওয়া যাবে তা দিয়ে শুধু তিনটি অলিম্পিক-সাইজের সুইমিং পুল ভর্তি করা যাবে! সুতরাং, আপনার কাছে যদি ৫০০ গ্রাম স্বর্ণ থাকে, জেনে নিন আপনি কতটা স্বর্ণের মালিক!

মজার ব্যাপার হলো, স্বর্ণ পৃথিবীর খনিতে আপনা আপনি তৈরি হয় না। পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে যেটুকু স্বর্ণ ছিল, আজও সেটুকু স্বর্ণই রয়ে গেছে। পরিমানগত দিক দিয়ে, এক ভরি স্বর্ণও নতুন করে এই পৃথিবীর ভাণ্ডারে যোগ হয়নি! সুতরাং, আপনার যদি ৫০০ গ্রাম স্বর্ণ থাকে, জেনে নিন আপনিই এই গোটা পৃথিবীর সীমিত স্বর্ণ ভান্ডারের একজন গর্বিত মালিক!

শুধু পৃথিবী নয়, এই গোটা বিশ্বব্রম্মান্ডেই স্বর্ণের প্রাচুর্যতা খুবই সীমিত। অন্যদিকে প্রতিটি, গ্রহ এবং নক্ষত্রের কেন্দ্র ভাগ লোহা দিয়ে ঠাসা। আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্র ভাগ যদি লোহা দিয়ে ঠাসা না থেকে সোনা দিয়ে ঠাসা থাকতো তাহলে কিন্তু আমাদের কাছে স্বর্ণের এতো কদর থাকতো না। আমরা হয়তো লোহার অলংকার পরে তখন অহংকার করতাম।

এই পৃথিবীতে আমরা যত ধাতু বা অধাতু দেখি তা সবই কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে প্রকান্ড ধরণের তারকার সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এ ধরণের বিস্ফোরণের জন্য যেনতেন তারা হলেই চলবে না। তারার আকৃতি হতে হবে আমাদের সূর্যের আকৃতির কমপক্ষে নয়গুন বড়। এর চেয়ে ছোট তারকার বিস্ফোরণে লৌহ ধাতু তৈরি হলেও স্বর্ণ তৈরি হবে না।

সূর্য্য বা তারকার অভ্যন্তরে একধরণের ফিউশন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট মৌল থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো মৌল সৃস্টি হয়। যেমন দুটো হাইড্রোজেন মিলে তৈরি হয় হিলিয়াম, তারপর, অক্সিজেন, কার্বন ইত্যাদি। আমাদের শরীরে কার্বন এবং কার্বন যৌগের পরিমান প্রায় ৯০ ভাগ। আর এই সব কার্বন কিন্তু তৈরি হয়েছে ঐ কোনো তারকার সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমেই। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা বলে: 'উই আর প্রোডাক্ট অফ স্টার ডাস্ট'! সূর্য বা তারকার অভ্যন্তরে ফিউশন বিক্রিয়ার জন্য দরকার হয় প্রচন্ড তাপ। আমাদের সূর্য নিয়মিত হাইড্রোজেন জ্বালানি পোড়াচ্ছে আর তৈরি করছে হিলিয়াম। এর মাধ্যমেই আমরা আলো এবং তাপ পাচ্ছি। প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পরে, সূর্যের সকল হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাবে, তখন সূর্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবে হিলিয়াম এবং ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি করবে কার্বন এবং অক্সিজেন। এ ধরণের বিক্রিয়ায় মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্র দরকার। এভাবে চলতে চলতে একসময় সূর্য তার সকল জ্বালানি শেষ করে ফেলবে এবং গোটা সূর্যটাই তখন তার কেন্দ্র বিন্দুতে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে প্রচন্ড বেগে আছড়ে পড়বে। এই আছড়ে পড়ার কারণে এক মহা বিস্ফোরণ ঘটবে যাকে বলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এই সুপারনোভা বিস্ফোরণে মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রা তৈরি হবে, যে তাপমাত্রায় ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হবে লৌহ ধাতু। এই মহাবিস্ফোরণে সূর্য তার অস্তিত্ব হারাবে, ছড়িয়ে দিবে তার সকল মৌলিক ধাতু এই মহাবিশ্বে, এবং নিজে ছোট্ট একটি ব্ল্যাক হোল হয়ে টিকে থাকবে অনন্ত কাল।

মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সূর্য কিন্তু স্বর্ণ সৃষ্টি করতে পারবে না। স্বর্ণ অনেক ভারী ধাতু যার পারমাণবিক ভর ১৯৬.৯। অন্যদিকে লৌহের পারমাণবিক ভর মাত্র ৫৫.৮। ফিউশন রিএকশনের মাধ্যমে স্বর্ণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাপমাত্রা দরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস- যা কিনা সূর্যের মতো ছোট নক্ষত্রে তৈরি হতে পারে না। এই তাপমাত্র সৃষ্টির জন্য দরকার সূর্যের চেয়ে নয়গুন বড় কোনো নক্ষত্র। বৃহৎ নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণেই কেবল মাত্র স্বর্ণ সৃষ্টি সম্ভব। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বসবাস করি তার নাম মিল্কিওয়ে। এই মিল্কিওয়েতে প্রতি একশো বছর পর পর একটি করে নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যাতে তৈরি হতে পারে স্বর্ণ। আর এই বিস্ফোরণে স্বর্ণ তৈরি হওয়ার উপযুক্ত সময় থাকবে মাত্র ১৫ সেকেন্ড। এই ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে যেটুকু সম্ভব স্বর্ণ তরী হবে এবং বিস্ফোরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে মহাবিশ্বে। কোনো গ্রহের কেন্দ্রে হয়তো জমা হবে এই স্বর্ণ।

সুতরাং, আপনি যখন রাতের আকাশের দিকে তাকাবেন, আপনি যখন ঐ দূর আকাশে দেখবেন মিট মিট করে জ্বলছে কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্র; তখন ভাববেন আপনি গলায় যে স্বর্ণ জড়িয়ে রেখেছেন তার সৃষ্টি ঐ দূরের কোনো নক্ষত্রেই। প্রকান্ড ঐ নক্ষত্রের জীবন সায়াহ্নেই তৈরি হয়েছে এই স্বর্ণ।

[নোট: নক্ষত্রের মাঝে ফিউশন বিক্রিয়ায় যে নতুন ভারী মৌলের সৃষ্টি হয় তা প্রথম আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার ফ্রেড হয়লী। এই ফিউশন বিক্রিয়াকে বলে Stellar nucleosynthesis]

খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
লন্ডন, ১৭ জুন ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৬ রাত ৮:২৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×