somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাবিশ ভেরিফিকেশন...

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“হ্যালো, আমি সাব-ইন্সপেক্টর অমুক বলছি। আপনি সৈয়দা রহিমা আক্তার রুমি বলছেন?”
“জ্বি বলছি।”
“আপনি পাসপোর্টের জন্যে আবেদন করেছিলেন। আমি ভেরিফিকেশনে আসতে চাচ্ছি। আপনি এখন বাসায় আছেন?”
“জ্বি আমি বাসায় আছি, চলে আসেন।”...
এক বছর আগে হজ্বের জন্যে আম্মার নতুন পাসপোর্ট করা হয়েছিল। সেই হিসেবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম ও ৫০০ টাকা হাতে রাখলাম। ঘন্টাখানেক পর বেল শুনে দরজা খুলে একের জায়গায় ৩ জনকে দেখতে পেয়েই ঝামেলার গন্ধ পেলাম। সেইসাথে মনে মনে ব্যর্থ হিসেব কষলাম একজনের জন্যে বরাদ্দকৃত নাস্তাপানির টাকা (ঘুষ!) ৩ জনের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করার। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন!
হাস্যকর ব্যাপার, একজন সাব-ইন্সপেক্টরের মুখে একটা প্রশ্ন শুনে ভীষণ অবাক হলাম। আমি একজন ইন্টার্ন ডাক্তার, ফর্মের সাথে আমার সনদপত্রও দেয়া আছে আর সে কিনা আমাকে প্রশ্ন করে আমার পড়াশুনা কদ্দূর! যাহোক বিভিন্ন সহজ রুটিনমাফিক প্রশ্নের পর সচরাচর সেই প্রশ্ন এলো, “এটাতো আপনাদের নিজের বাসা?” উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ।” পরবর্তী প্রশ্ন, “বাসার বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিলের কোন কাগজ দেখাতে পারবেন?” উঠে গিয়ে নিয়ে আসলাম কারণ এই কাজটা আগেরবারও করতে হয়েছে আম্মার পাসপোর্টের বেলায়। বিলের কপি দেখেই তারা আবিষ্কার করল বাসাটা আমার বাবার নামে না, আমার চাচার নামে। আবার মুখোমুখি হলাম জীবনের সবচে কঠিন সত্যের আর আমার বাবার সবচে বড় ভুলের। যাহোক যথারীতি তাকে ব্যাখ্যা করে বললাম আমরা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। যেহেতু গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকেনা তাই যাবতীয় অফিসিয়াল কাজে এই ঠিকানাই ব্যবহার করা হয়। এতক্ষণে তারা ঝামেলার হেতু খুঁজে পেল আর তাই হয়তোবা তাদের চোখটাও চকচক করে উঠেছিল অথবা আমার চোখের বা মনের ভুলও হতে পারে। সবকিছু দেখার পর তারা আমাকে জানিয়ে দিল যে পাসপোর্ট পেতে হলে আমাকে গ্রামের ঠিকানা দেখিয়ে নতুনভাবে ব্যাঙ্ক ড্রাফট করে আবার নতুন ফর্ম জমা দিতে হবে। আমি সাথে সাথে বললাম কিছুদিন আগে আম্মার পাসপোর্ট করার কথা। শুনে বলল, “হয়তো খালাম্মা হজ্বে যাবেন বলে ঐ অফিসার একটু শিথিল করে নিয়েছিলেন ব্যাপারটা।” মুখ দিয়ে বের হয়ে আসছিল আমি কি পাসপোর্ট বানিয়ে তামাশা করতে যাব? অনেক কষ্টে দাঁত চেপে বললাম আমার খুব বেশি দরকার এই মূহুর্তে পাসপোর্টটা আর আমার পক্ষে বারবার ডিউটি ফাঁকি দিয়ে পাসপোর্টের জন্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি করা সম্ভব না। আমাকে যেন একটু কনসিডার করা হয়। তখন তারা তাদের মোক্ষম অস্ত্র ছুঁড়ে দিল যে তাদেরকে ৫,০০০ টাকা দিলে তারা আমার সব কাগজপত্র ঠিক করে দেবে (যেগুলো আদতে ঠিকই ছিল!)।
আমার আম্মা বললেন তার পক্ষে এখন এতগুলো টাকা খরচ করা সম্ভব না আর আমাদের বাসায় এসব নিয়ে ঝামেলা করার মত কোন মানুষ নাই আমি বাদে। তারা আমাদেরকে ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলল যে সব ঝামেলা তারাই মিটিয়ে দেবে যদি ঐ টাকা দেয়া হয় কারণ তাদেরকেও বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। শুরু হল আমার আর আম্মার অনুনয়ের পালা। কিন্তু তারা টলতে নারাজ। আম্মা ৫০০ টাকা বের করে দিতেই একজন জিভ কেটে লজ্জায় শেষ! আম্মা আমাকে বললেন আরও ৫০০ টাকা দিতে। না, তাতেও তারা লজ্জা পান। কারণ তাদের লজ্জার মূল্য ৫০০০ টাকা। এক পর্যায়ে বললাম, “দেখুন আমি একজন ডাক্তার এবং আমাকে এভাবে হ্যারাস করা উচিত না।” সে ঝট করে আম্মাকে বলল, “৫০০০ টাকা দিলেই আপনাদের ঝামেলাটা মিটে যায় আর আপনার মেয়েতো কিছুদিন পর ডাক্তার হয়ে...” কথাটা সে শেষ না করলেও আমি তার মনের কথা পড়ে নিতে পেরেছিলাম যে কিছুদিন পর আমার মায়ের ডাক্তার মেয়ে টাকার পর্বতের শৃঙ্ঘে অবতরণ করতে যাচ্ছে! অবশেষে “খালাম্মা, আপনার মেয়ে পাসপোর্ট পাবেন না” কথাটা বলে তারা বের হবার উপক্রম করতেই আম্মাও দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যান অনুরোধ করতে। এতক্ষণ ধরে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছিলাম। অবশেষে মুখ খুললাম, আম্মাকে টেনে এনে বললাম, “অনেক হয়েছে, আমার পাসপোর্ট লাগবেনা” আর তাদের দিকে তাকিয়ে অনেক চেষ্টায় মুখে হাসি এনে বললাম, “ধন্যবাদ, আপনারা আসতে পারেন।” আসলে ঠিক তখন আমি কি করেছিলাম বা কেন করেছিলাম তা জানিনা কিন্তু সেই সাব-ইন্সপেক্টরের ঐ হতভম্ব চেহারা আমি জীবনেও ভুলবনা। আম্মা কয়েক মিনিট পর প্রথম কথা বলেছিলেন, “কাজটা তুমি ভাল করনি, এরা মানুষের জাত না।” ঠিক-বেঠিক জানিনা কিন্তু এসব অমানুষের কাছে নিজেকে আর নিজের মাকে আর ছোট করতে পারছিলাম না। একটা পাসপোর্ট না করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? হয়তোবা বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যেতে পারবনা, ভবিষ্যতে হানিমুনে বালি বা ফুকেট যেতে পারবনা, ৫০০০ টাকা হয়তো খুব বেশি না এগুলোর কাছে কিন্তু আমার তৃপ্তি এটুকুই একজন মানুষ হিসেবে, আমি আপোষ করিনি এবং করবনা ইনশাআল্লাহ। মনকে সান্ত্বনা দেই এই ভেবে, যে দেশে হাজার মানুষের জীবন টাকার কাছে জিম্মি হয়ে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে সে দেশে আমার মত একজন মাত্র ১০,০০০ টাকা বেতনের ইন্টার্ন ডাক্তারের পাসপোর্টতো নিতান্তই খেলনা!
আজ সকাল থেকে পত্রিকা দেখে একটা কথা মাথার মধ্যে কাজ করছিল। এই যে এতগুলো মানুষ আজ সাভারে বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে বা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে। তাদের পাশে যে সকল শত শত ডাক্তার নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা যদি এসব আহতদের গায়ে হাত দেবার আগে হাজার টাকা সামনে রাখতে বলত তখনতো তাদের জাত-গুষ্ঠি উদ্ধার করতে সবাই উঠে পড়ে লাগত। সবার চোখে এরা কসাই কারণ এরা রোগীর গায়ে হাত দেবার আগে তাদের চাহিদা জানায় না। হয়তো একটা পাসপোর্ট চিকিৎসা সেবার মত গুরুত্ব বহণ করেনা কিন্তু কারও কাছে হয়তো জীবন্মরণের মতই গুরুত্বপূর্ণ।

পুনশ্চঃ যদি কপালগুণে ৩৩তম বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় টিকে যাই এই তথাকথিত পুলিশ (রাবিশ) ভেরেফিকেশন নামক পরীক্ষায় কিভাবে উতরে যাব জানিনা। আর তখন কত হাজার বা লাখ টাকার ভর্তুকি দিতে হবে তা ভেবেও আমি শঙ্কিত! একটি দেশের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় এসব তৃতীয় শ্রেণীর মানসিকতার অমানুষ দ্বারা ভেরিফিকেশন নিতান্তই প্রহসন!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৫০
২২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×