মিথ্যা গল্পে আপনারে সত্য কথা বলতে হইবো ক্যান? কারণ, আপনার দায়িত্ব পাঠকরে আলোরিত করা, তারে ধইরা একটা ঝাঁকি দেয়া। আর সেইটার জন্যই সত্য-মিথ্যার এই মিশেলটা দরকার। একজন পাঠক- ফার্মগেটে আধা ঘন্টা অপেক্ষা শেষে, ঠেলাঠেলি কইরা বাসে উইঠা, ঘামে ভিজ্যা লম্বা সময় জ্যাম আর সিট-ছাড়া দাঁড়াইয়া থাকার পেইন নিয়া বাসায় আইসা পৌঁছাইলো- সে যেন ঐ মুহূর্তে আপনার লেখাটা পইড়া আনন্দ পায়, তার কষ্টে ভরা জীবনের কথা ভুইলা যায়। একজন পাঠক- তার পরিবারের কাছে ব্ল্যাক শিপ, ফ্রেন্ডদের কাছে মজা নেওয়ার পাত্র, গার্লফ্রেন্ডের কাছ এটিএম মেশিন, বসের কাছে গালি দেয়ার মানুষ- সে যেন আপনার লেখাটা পইড়া ভাবে, নাহ, দুনিয়াটা অতটাও খারাপ জায়গা না। একজন পাঠক- তার বয়স তিরিশ পার হইছে, সরকারী চাকরির বয়স শেষ, বেসরকারী ছোট চাকরি করে, বিয়ার বয়স যাইতাছে গা, বাসায় ছোট বোন, বাপে করছে রিটায়ার- সে যেন আপনার বই পইড়া হঠাৎ উইঠা দাঁড়াইয়া বইলা উঠে ইটস টাইম টু ফাইট ব্যাক বেইবি।
মিথ্যা আর সত্যের মিশেল মানে ঠিক আর বেঠিক মিশানো, বাস্তব আর কল্পনারে মিশানো, পরিচিত আর অপরিচিতর মাঝখানের সুক্ষ্ম রেখার উপর দিয়া হাঁটা। আচ্ছা, কখনো ভাবছেন, যদি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে জিত্যা যাইতো তাইলে কি হইতো? মোটামুটি নিশ্চিত জাতিগতভাবে এই মুহূর্তে আমরা ভয়ানক সময় পার করতাম। সেইটা নিয়া যদি আপনি লিখতে যান তাইলে এখনের সময়, এই বাংলাদেশ নিয়াই লিখবেন, কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত আর অন্য সবকিছু হইবো ভিন্ন। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস - সওওওব অন্যরকম ভাবে ভাইবা, কল্পনার চোখ দিয়া দেইখা তারপর লেখতে হইবো আপনারে। এইরকম বইরে বলে 'অল্টারনেট হিস্ট্রি' জনরার বই। এইসব বই দুয়েকটা পড়লে আপনি বুঝবেন যে কল্পনার সাথে ঠিক কতটুকু বাস্তব, মিথ্যার সাথে ঠিক কতটুকু সত্য মিশাইতে হইবো। বাস্তবতা কতটা প্যাচানো, কতটা জটিল হইতে পারে তা বুঝা যায় এই বইগুলা পইড়া। যেমন -
দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসেল - ফিলিপ কে ডিক - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা গো-হারান হাইরা গেছে!
ফাদারল্যান্ড - রবার্ট হ্যারিস - হিটলারই দিন শেষে জয়ী!
আন্ডারগ্রাউন্ড এয়ারলাইনস - বেন উইন্টারস - এখনও দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় নাই আমেরিকা থেইকা!
"আপনি বই লেখার সময় ভাইবা নিবেন, রাস্তা দিয়া জন্মদিনের কাপড় পইড়া হাইটা যাইতে আপনার কোনো সমস্যা নাই। নিজেরে পাঠকের কাছে পুরাপুরি উন্মুক্ত কইরা, নিজের ভিতরটারে খুইলা দেখাইতে হইবো আপনার। নিজেরে নিয়া যতটা তিক্ত সত্য আপনি অনায়াসে কইতে পারেন তার চাইতে বেশি সত্য কথা বলার হ্যাডম আপনারে রাখতে হইবো।" - নিল গেইম্যান
এক কাজ করতে পারেন, একটা প্রবন্ধের বই নেন হাতে, সেইটা পড়েন। প্রবন্ধ হইলো ফ্যাক্টের উপস্থাপন, বা একজন লেখকের চিন্তার সলিড নির্যাসটা সেইটায় থাকে। পড়া শেষে ভাবেন। এইখানে কোন প্রবন্ধটা আপনার ভালো লাগে নাই, কেন ভালো লাগে নাই? তারপর সেইটারে কাউন্টার কইরা একটা প্রবন্ধ লেখেন, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সততা দিয়া। দেখবেন নিজেই বুঝতে পারবেন ফিকশনের সাথে এইটার তফাত-টা কই। বই বা লেখালেখি নিয়া দুইটা বইয়ের নাম দিলাম, নাইড়া-চাইরা দেখতে পারেন। পড়লেও দোষ নাই -
দ্য ওয়েভ ইন দ্য মাইন্ডঃ টকস এন্ড এসেজ অন দ্য রাইটার, দ্য রিডার এন্ড দ্য ইমাজিনেশন - উরসুলা কে লে গুইন
দ্য ভিউ ফ্রম দ্য চীপ সীটস - নিল গেইম্যান
আরেকটা কাজ করতে পারেন। এইটা খুব কষ্টের একটা কাজ। আমি এই এক্সারসাইজ করার সময় রীতিমত ট্রমায় চইলা গেসিলাম, কিন্তু কেন এইটা করতে বলা হইসে সেইটাও বুঝছি। একটা খাতা নেন। সেইটাতে নিজের জীবনের চারটা ঘটনা নিয়া বিস্তারিত লেখেন, ঐ দিন, আগের যেসব ঘটনা ঐ দিনে ভূমিকা রাখসে, আপনার সেই সময়ের বিশুদ্ধ অনুভূতি - সব লিখেন।
- জীবনে যেই ঘটনায় সবচাইতে বিব্রত বোধ করছিলেন।
- জীবনে যেই কাজটা করার জন্য এখন সবচাইতে হায়-আফসোস করেন।
- জীবনে যেই ঘটনায় সবচাইতে বেশি কষ্ট পাইসিলেন।
- জীবনের যেই গোপন কথাটা ফাঁস হইয়া যাওয়ার ভয় পান আপনে।
নিজের ভিতর থেইকা লিখেন, সত্যটা লিখেন, সেই রাজার মতন অদৃশ্য কাপড় পইড়া নেন তাতে যতই পিচ্চি চিল্লাইয়া উঠুক না কেন 'রাজা, তোমার কাপড় কই?!' আপনে একজন সাহসী মানুষ, কারণ সাহসী না হইলে আর যাই হোক, লেখক হওন যায় না। কাজেই, ভয়রে করেন জয়। নিজের লেখাটা নির্জনে জোড়ে জোড়ে পড়েন। শুনেন, মনোযোগ দিয়া। আপনার শারীরিক, মানসিক অনুভূতি কি হইতাসে পড়ার সময়, শুনার সময় মাথায় টুইকা নেন। এখন ভাবেন, আপনার লেখার এক চরিত্র এই একই ঘটনার মধ্য দিয়া যাচ্ছে। যেই অনুভূতি আপনার মাত্রই হইলো, সেই অনুভূতিটা যাতে পাঠকের মধ্যে আসে সেইটা আপনের দেখতে হইবো। আপনে পারবেন, নিশ্চয়ই।
"গল্পের একটা জিনিসের সাথেই পাঠক নিজের সবচাইতে বেশি রিলেট করতে পারবো, আর সেইটা হইলো কতটা সততার সাথে আপনে সেই গল্পটা লিখসেন। বাকী সব ঝুট হ্যায়।" - নিল গেইম্যান
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৫৬