"জানু, চা বানাচ্ছি আমার জন্য। তোমাকেও এক কাপ দেবো?" রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আনিকা। আনিকা বলাটা ঠিক হচ্ছে না। আনিকা না ঐ জিনিসটা।
হ্যাঁ, দেখতে আনিকার মত বটে। সেটার জন্য ওদেরকে বাহবা দিতেই হয়। এতটা মিল, পার্থক্য বুঝার কোনও উপায়ই নেই। সবাই কি আমার মতন এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব লক্ষ্য করে নাকি? নিশ্চয়ই বহু কষ্ট করে, অনেকটা সময় আর অর্থব্যয় শেষে আনিকার মতন হুবহু এই জিনিসটা বানানো হয়েছে। আমার মতন একজন ছাপোষা মানুষকে খুন করতে এত চেষ্টা, পরিশ্রম, ধৈর্য খরচ করছে কেউ - ভাবা যায়?
"হ্যাঁ, দাও। রং চা দিও। আদা কুচি আর লেবু দিয়ে। আবার মশলা দিও না কিন্তু," একটু জোড়েই উত্তর দিলাম আমি। একদম সন্দেহ জাগাতে চাইছি না, তাই স্বাভাবিক আচরণ করছি। এরকম আরও কত পরিবারে, কত বাসায়, কত মানুষের জীবনে এই জিনিসগুলো অনুপ্রবেশ করেছে কে জানে? রাস্তায় হাঁটতে গেলেও ভাবি আমি, এই যে আশেপাশে এতো এতো মানুষ; এর মধ্যে কয়জন আসলেই যাকে বলে হোমো স্যাপিয়েন্স। বুঝাটা কিন্তু খুব কঠিন। আমার মতন হাতেগোনা কিছু মানুষই পারে ওদের বিছানো ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে।
আনিকা বের হয়ে আসলো রান্নাঘর থেকে। দুই হাতে দুটো মগ ধরে রেখেছে। ধোঁয়া উঠছে গরম চা থেকে। "অনেক অনেক ধন্যবাদ, মাথাটা যা ধরেছিল না," হাত বাড়িয়ে আমার মগটা নিতে নিতে বললাম আমি।
"আমারও। আর বলো না। কালকে একটা নতুন প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। কাজ করতে আর ভালো লাগছে না। কম্পিউটারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে। অসহ্য।"
"আহারে, আমার জানপাখিটার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?" অভিনয় সব! পাকা অভিনেতা হয়ে উঠেছি আমি! আনিকার চোখ এড়িয়ে চায়ের গন্ধ নিলাম। আদা-লেবু মেশানো টাটকা চা-র সুঘ্রাণ বুকের ভেতরে ঢুকে গেল। নাহ, জিনিসগুলো নিজেদের কাজে একদম পাকা। এই যে কালচে জিনিসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। দেখে কিন্তু আপনার মনে হবে চা। দেখতে, গন্ধতে কোন অমিল খুঁজে পাবেন না আপনি। কিন্তু, ভুলেও যদি চুমুক দিয়েছেন তো মরেছেন। এর মধ্যে বর্ণ-গন্ধহীন এমন কোনও বিষ হয়তো মিশিয়ে রেখেছে যে আপনি নিজেই নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করবেন খাওয়ার সাথে সাথে।
"তাড়াতাড়ি খাও। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমাবে না। কালকে একটু বাইরে খাবো কিন্তু রাতে, কেমন?" নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমার দিকে ফিরে আদুরে গলায় বলে উঠলো জিনিসটা। কি ঢং। যেন আমি কিচ্ছু বুঝি না।
"অবশ্যই। সিক্রেট রেসিপিতে যাই চলো কালকে। অনেকদিন যাওয়া হয় না।" একদম সন্দেহ জাগাতে চাইছি না। চায়ের মগটা ঠোটের কাছাকাছি তুলে রেখেছি। কিন্তু ভুলেও চুমুক দিচ্ছি না। সন্দেহ জাগালে হয়তো এত রাখঢাক না রেখে গলা টিপে বা ছুড়ি ঢুকিয়েই আমাকে মেরে ফেলবে জিনিসটা। তাই এই সতর্কতা।
অবশ্য আজ রাতের পর থেকে এত চিন্তা করতে হবে না আমার। তার, প্রসেসর আর নাট-বল্টু দিয়ে বানানো রোবটই হোক কিংবা সবুজ রক্ত, পিছলা দেহের কোন ভিনগ্রহের প্রাণীই হোক - আজ রাতেই জিনিসটার পরিচয় জেনে যাবো আমি।
সোফার সামনের টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভিটা চালু করলো আনিকা নামের জিনিসটা। আমার দিকে পিছন ফিরে আছে। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলাম আমি। সোফার কুশনের নীচে লুকিয়ে রাখা ধারালো চাপাতিটা বের করে হাতে নিলাম। এখনই প্রমাণিত হয়ে যাবে, আমার সন্দেহটাই যে ঠিক।
(বিদ্রঃ ছবিটা অনুমতি ব্যতিরেকেই হরর-মাঙ্গার কিংবদন্তী আঁকিয়ে জুনজি ইতোর - 'টু ফেইসেস' - মাঙ্গার প্যানেল থেকে নেয়া।)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪৩