somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাহাড়ি - বাঙালি সংঘর্ষ ?

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাংগামাটিতে জাতিগত সন্ত্রাস গতকাল রাঙামাটিতে কি ঘটেছিল? আজকের প্রায় সব পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’। বেশীর ভাগ পত্রিকাতেই খবরটি পরিবেশিত হয়েছে গুরুত্বের সাথে। [আমি আজ সকালে একটা নিউজ স্ট্যান্ডে গিয়ে চোখের সামনে যে ক’টা পত্রিকা পেয়েছি, নিয়ে এলাম বাসায়, দেখার জন্য কিভাবে সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে। হাতের কাছে হার্ড কপি নেই, এরকম (নীচে *-চিহ্নিত) দু’একটি পত্রিকার শিরোনামগুলোও এক নজর দেখে নিলাম ইন্টারনেটে]। ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’ কথাগুলি আছে বেশীর ভাগ পত্রিকার শিরোনামেই – আমাদের সময়, আমার দেশ, ইত্তেফাক, ইনকিলাব (*), জনকন্ঠ, নয়া দিগন্ত (*), বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তর, সকালের খবর, সমকাল, সংবাদ (*), bdnews24.com/বাংলা (*)। কালের কন্ঠে শিরোনামে না থাকলেও ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’ কথাগুলো আছে খবরের বিবরণে। এদিক থেকে প্রথম আলোর শিরোনাম বা বিবরণে যা একটু ভিন্নতা আছে - পত্রিকাটির চোখে ঘটনাটি ছিল ‘বাঙালি-আদিবাসী সংঘর্ষ’। তবে সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটা সংঘর্ষ যে ঘটেছিল, যার ভেদ রেখা ছিল জাতিগত পরিচয়ের সীমানা, এই ভাষ্যই সব বাংলা পত্রিকার খবরে উঠে এসেছে। ইংরেজি পত্রিকাগুলোর বেলাতেও অনেকটা তাই, যেখানে এক পক্ষের পরিচয় দেওয়া হয়েছে আলাদা আলাদা শব্দে, hill people (New Age), indigenous people (Daily Star, Daily Sun), tribal (Independent), Pahari (bdnews24.com), তবে অন্য পক্ষের পরিচয় বর্ণনায় ‘বাঙালি’ শব্দটা ব্যবহার করা হলেও (Bengali, Bengalee দুই রকম বানানে) প্রথমোক্ত তিনটা পত্রিকাতেই এই পক্ষের পরিচয় আরো সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করা হয়েছে ‘settler’ হিসাবে।



টেলিভিশনের খবর আমি দেখি নি। সেখানে সংবাদ পরিবেশনে কোন ভিন্নতা বা বিশেষত্ব ছিল কি না জানি না। ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ (বা আদিবাসী-বাঙালি) ভেদরেখার বাইরে গিয়ে কোন চ্যানেল যদি সংবাদ পরিবেশন করে থাকে, তবে সেটাই একটা খবর হতে পারত। তেমন খবর, কারো জানা থাকলে, আমি শুনতে আগ্রহী।



অনেক বছর আগে (সালটা ঠিক মনে নেই, আশির দশকের শেষ দিকে হতে পারে, বা আরো কিছু পরে। পুরানো ডায়েরি ঘাঁটলে উদ্ধার করা যেত, তবে সেটা এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না।) একবার নিজের চোখে দেখেছিলাম কিভাবে আসলেই তুচ্ছ একটি ঘটনা ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের (বা তেমন বর্ণনার আড়ালে কিছু সংঘবদ্ধ চক্রের পরিকল্পিত সন্ত্রাসের) রূপ নিতে পারে। খাগড়াছড়িতে আমাদের বাড়ির অদূরে বেশ ঢালু এবং বাঁক খাওয়া একটা রাস্তা বেয়ে নামতে গিয়ে একটা রিকশা উল্টে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে রিকশাচালক ছিল একজন বাঙালি, এবং রিকশা আরোহী দু’জন ত্রিপুরা তরুণ। তাদের একজন রাগের মাথায় রিকশাওয়ালার গায়ে হাত তোলে, অমনি আশপাশে থাকা দোকান ও বাড়িঘরের বাঙালিরা তেড়ে আসে। আমি পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে বেরিয়েছিলাম মাত্র। ‘মার মার’ রব শুনে ও ছোটাছুটি দেখে কিছু তরুণ বন্ধুসহ আমরা সাহস করে এগিয়ে যাই, এবং সৌভাগ্যবশতঃ স্থানীয় একজন সুপরিচিত (ত্রিপুরা) নেতাও তখন মোটর সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। আমরা সবাই মিলে ঘটনাটার নিষ্পত্তি করতে পেরেছিলাম সেদিন বড় ধরনের কোন সহিংসতা ছড়ানোর আগেই। তবে এখানে উল্লেখ করা দরকার, বাতাসে সেদিন আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ভেসে বেড়াচ্ছিল, কারণ রামগড় না কোথায় একটা বড় ধরনের সহিংসতা ঘটে গিয়েছিল দু’একদিন আগেই। যথারীতি সেই ঘটনার বয়ানও ঘুরছিল ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ ভেদরেখাকে ঘিরেই।



আমি প্রায় এক যুগ আগে (২০০১ সালে) আমার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলাম, “যে সমস্যাকে ‘পাহাড়ী-বাঙালী দ্বন্দ্ব’ হিসাবে আমরা প্রায়ই উল্লেখ করে থাকি, তাতো আসলে ছিল রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট জাতিগত আগ্রাসন, বা সরাসরি রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন (অন্ততঃ অধিকাংশ পাহাড়ীর দৃষ্টীকোণ থেকে)।” এতদিন পরে পড়তে গিয়ে নিজের বিশ্লেষণের একটা সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ছে। উক্ত উদ্ধৃতিতে যে বাস্তবতাকে ‘ছিল’ বলে অতীতের খাতায় লিখে দিয়েছিলাম, বিগত এক যুগের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমরা জেনেছি যে এটি মোটেও আমাদের পিছু ছাড়ে নি।



তবে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রকে, বা রাজনীতিবিদসহ রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানদের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়াই বোধ হয় আর যথেষ্ট নয়। এদেশের মিডিয়া আমাদেরকে সংবাদ শিরোনামের পেছনের বাস্তবতা অনুধাবনে কতটা সহায়তা করছে? নাকি তাদের সংবাদ পরিবেশনার মধ্যেও একই সমস্যা শেকড় গেড়ে ফেলেছে? পরিবেশিত সব খবরেই কমবেশী বলা হয়েছে, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার সূত্রপাত একটা ‘তুচ্ছ’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই সহিংসতার স্বরূপ কি ছিল? এটা কি আসলেই ‘সংঘর্ষ’ ছিল নাকি ‘আক্রমণ’? বাঙালি আক্রমণকারী কি সবাই প্রচলিত অর্থে ‘সেটলার’ ছিল? আর সহিংসতায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা যদি বেছে বেছে শুধু জাতিগত ভিন্নতার ভিত্তিতেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু খোঁজে, তাহলেও কি সেটাকে ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’ বলা যায়? এই শিরোনামে ঘটনার খবর পরিবেশনের মাধ্যমে আমরাও কি অন্য একটা পর্যায়ে সহিংসতার প্রসারে অংশ নিচ্ছি না? এখানে আমি ঘটনার বিবরণ-অনুধাবন-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মানুষের সাধারণ মানবিক চেতনাকে ভেঙে ফেলার কথা বলছি। ধরা যাক, রাঙামাটি শহরে পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে মোট ৬০,০০০ মানুষ বাস করে। এদের মধ্যে কতজন সহিংসতা চায়, বা জাতিগত ভিন্নতার কারণে আরেকজনের গায়ে চাপাতির কোপ মারতে প্রস্তুত? যারা অপরাধী কর্মকান্ডে সরাসরি লিপ্ত, বা নেপথ্যের মদতদাতা, তাদের সংখ্যা কত হবে: ৬? ৬০? ৬০০? বা বড় জোর ৬০০০? যতই হোক, ৬০,০০০-এর তুলনায় অতি নগণ্য সংখ্যা। তাহলে তাদের আচরণের দায় কেন বাকী সবার উপর চাপানো হবে ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’ হিসাবে? এ ধরনের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বা ভেঙে ফেলা পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ির সংখ্যা দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিরূপণ করা হয়। কিন্তু আসল ক্ষতিটা অন্য জায়গায় – মনের ভেতরে আমাদের মানবিক চেতনা মরে যায়, আমরা আস্থাহীনতায় আরো ডুবে যেতে থাকি, এবং চেহারা, পোশাক বা ভাষার ভিন্নতা দিয়েই আরেকজনের দিকে তাকাতে থাকি সন্দেহের চোখে। অন্যদিকে যে ভ্রান্ত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কারণে এমন অবিশ্বাসের বিষবৃক্ষ শেকড়-ডালপালা ছড়িয়ে আরো জেঁকে বসে পড়ছে, তার দিকে তাকানোর অবকাশ মেলে না মনের বাঘগুলো নিয়ে সবাই ত্রস্ত থাকাতে।



গতকাল রাঙামাটির ঘটনা ফেসবুকে প্রথম দেখার পর আমি মাঝে মধ্যে আপডেট জানার জন্য বিভিন্নজনের পোস্ট পড়ার চেষ্টা করেছি। অনেকেই ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ (বা আদিবাসী-বাঙালি, জুম্ম-বাঙাল ইত্যাদি) ভেদরেখাকে স্বতসিদ্ধ ধরে নিয়েই পরিস্থিতির বিবরণ-বিশ্লেষণ চালিয়ে গেছে। তবে দু’একজন ঠিকই মূল কারণগুলোর দিকেও নজর দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হোক, এমন শিরোনাম যে আমাদের চোখে আঁটা ঠুলিগুলোকেই আরো মজবুত করে, তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের সংবাদকর্মীরা, সম্পাদকরা, আরো দায়িত্বশীলভাবে বিষয়টির প্রতি নজর দেবেন, তা অবশ্যই কাম্য।



আর আমাদের চোখের ঠুলিগুলো খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এদেশের বিদ্বৎ সমাজ কি ভূমিকা রাখছে, সেটিও ভাববার বিষয় ।

Courtesy : Prashanta Tripura
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ২:০০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×