somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সন্তাপে সন্তান

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভারী কাঠের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। রহিমা খাবার নিয়ে বার দু'য়েক ডেকেছিল। শেষ পর্যন্ত অনন্যার ধমক খেয়ে তার নিজের কাজে ফিরে গিয়েছে। এখন দুপুর দুটো বাজে। রাত বারটা বাজার আগেই সেই যে অনন্যা তার ঘরে ঢুকেছে, এখন পর্যন্ত বের হ্য়নি। কারন, আজ অনন্যার জন্মদিন।
জন্মদিনের জন্য প্রতিটি মানুষ অপেক্ষা করে, আর অনুর এদিনটির কথা মনে হলেই কান্না পায়। এই দিনটা এলেই সে সারাদিন দরজা বন্ধ করে কাঁদে। তার বাবা অফিসে যায় না, একলা নিজের ঘরে থাকে। দাদু ওনার প্রকান্ড এলবামটা বের করে পুরোনো দিনের ছবি দেখে আর চোখের জল ফেলে। প্রতি বছর এই দিনে একই রকম ঘটনাই দেখা যায়।
একটা মেয়ের জন্মদিন, যে কিনা বাবা-মার একমাত্র মেয়ে, তার জন্মদিনে এমন টা যেন ভাবাই যায় না। এর কারন খুব অস্বাভাবিক কিছু নয় - একই দিনে তার মায়ের মৃত্যু। অনন্যার জন্মের সময় ওর মা মারা গিয়েছেন। বাবা ওকে জন্মদিনের উপহার দিতে কখনো ভুল করে না, দাদু দেয় মায়ের আদর, কিন্তু সে নিজেই মেনে নিতে পারে না এইদিনটাকে। কেবলই মনে হয় তার জন্ম না হলে তো এখন মা বেঁচে থাকত। মায়ের প্রতি বাবার অকৃত্তিম ভালোবাসা তার প্রায়ই চোখে পড়ে। তখন নিজেকে আরও বেশি অপরাধি মনে হয়।
দুপুর দুইটা বাজে। অনন্যা একটা নীল শাড়ি পরে খাটে বসে আছে। কখন থেকে এভাবে বসে আছে কে জানে? চোখ দুটো রাঙা। ফর্সা গালে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার দাগ। আগের দিন দেওয়া চোখের কাজল ধুঁয়ে গিয়ে শেষ চিহ্নটুকু রেখে গিয়েছে। আজ তার ঘরে কেউ আসবে না। সবাইকে বারন করা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনন্যা এদিনটাকে শুধুই তার মায়ের জন্য তুলে রেখেছে। সে মনে করার চেষ্টা করে সেই দশ মাস সময়কে যখন সে তার মায়ের সাথে ছিল। সেই সময়ে মায়ের গাওয়া গানগুলো যা ছিল কেবলই তার জন্য গাওয়া। কিন্তু তা যে কারোরই মনে থাকে না।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
-"অনু দরজা খোল।"- ফাহিমের গলা।
-"আজ আমার কাছে এস না। কাল তোমার সাথে কথা বলব।"
-"আমি বলছি দরজা খুলতে।"
ফাহিম অনন্যার বড় খালার ছেলে। ওর চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়। খালুর চাকরির সুবাদে ছোট থেকেই কানাডায় ছিল। মাস খানেক হল দেশে এসেছে। অনন্যা আগে কখনো তাকে দেখেনি, তাই একটু ভয় পায়। অবশেষে অনন্যা দরজাটা খুলে দিয়ে আবার আগের জায়গায় এসে বসে।
ফাহিম ঘরে ঢুকে ওকে ভাল করে দেখে নিল। কোন সাজের বালাই নেই, অনন্যা যেন আর দশটা মেয়ে থেকে কিছুটা আলাদা। ওর পাশে এসে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে।
-"আমার সাথে এক জায়গায় যেতে পারবে?"
-"আজ না। অন্য কোন দিন।"
-"আমার আজই যেতে হবে। সাথে তুমিও যাবে। আমি খালুজানের সাথে কথা বলে এসেছি। তুমি রেডি হয়ে নাও, আমি ড্রয়িং রুমে বসছি।"
অনন্যাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফাহিম বের হয়ে যায়।
-"কোথায় যাবে?"- গাড়িতে উঠে অনুর প্রশ্ন।
-"প্রথমে কোন রেষ্টুরেন্টে, আমি দুপুরে খাইনি।"
-"বাসায় খেলে না কেন?"
-"আজ কি তোমাদের বাসায় রান্না হয়েছে? দেখে তো মনে হল না!"- বলে ফাহিম মৃদু হাসে।
-"তাহলে লেকের ধারে চল। জায়গাটা বেশ শান্ত।"
দুপুরের খাওয়ার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গিয়েছে। তাই খদ্দের খুব একটা নেই। খাওয়ার পর ওরা লেকের পাশে এসে বসে।
-"তুমি কি জান আমি কেন এদেশে এসেছি?"-হঠাৎ ফাহিম প্রশ্ন করে।
-"কেন আবার, আগে কখনো দেশে আসনি তাই!"
-"তার চেয়েও একটা বড় কারন আছে।"
-"কি সেটা?"
-"খালা মারা যাওয়ার সময় মা খালাকে কথা দিয়েছিল- তোমার সাথে আমার বিয়ে দিবে। আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নেই। তবে তোমার যদি থাকে, আমায় বলতে পার।"
অনন্যা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। কি বলবে ও? মা চেয়েছিল ওর ফাহিমের সাথে বিয়ে হোক? কই কেউ তাকে তো কখনো কিছু বলেনি! দাদুও তো বলতে পারত! দাদুকে তো ও সবই বলে। কোন ছেলে কবে কখন ওকে কি বলেছে, তার সবকিছুই তো তার জানা। অনু যদি কারো সাথে জড়িয়ে পড়ত, তাহলে?
-"কোন সমস্যা?"-ফাহিম ওর হাতটা ধরে জানতে চায়।
অনু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। ফাহিমের চোখে অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। ওর জন্য কি আছে ঐ চোখে? ভালো লাগা, ভালোবাসা নাকি কেবলই কর্তব্যবোধ? কিছু জানা যায়, অধিকাংশ প্রশ্নেরই জবাব মেলে না।
-"কিছু না। চল বাড়ি যাই।"
চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
তার কিছু দিন পরেই ডিসেম্বর মাসের কনকনে শীতের মাঝে ফাহিমের সাথে অনন্যার বিয়ে হয়ে গেল। পাশে থাকা দাদু ও বাবা আর অন্যলোক থেকে মায়ের আশির্বাদ নিয়ে সে বরের সাথে চলে গেল নতুন স্বপ্নের ঊর্ণাজাল বুনে। কয়েক দিন পরেই কানাডায় পারি জমাল ওরা।

অনুর বিয়ের দুই বছর পূর্ণ হল কিছুদিন আগে। ফাহিম ওকে খুব ভালোবাসে। ওর প্রতিটি প্রয়োজন আগে থেকেই বুঝে নেয়। একটা মেয়ে ঠিক যে ধরনের বরের প্রত্যাশা করে ফাহিম যেন তার চেয়েও বেশি কিছু।ফাহিমর প্রচন্ড ভালোবাসায় ওর জীবন পূর্ণ হয়ে ওঠে।
কয়েক দিন ধরে অনন্যা নিজের মধ্যে সেই সবচেয়ে আকাঙ্খিত পরিবর্তন অনুভব করছে। ডাক্তারের কাছ থেকে নিশ্চিত হবার পর থেকেই তার আনন্দ যেন আর ধরে না। ফাহিম সারাক্ষণ ওর খেয়াল রাখছে। ওর মা-বাবা মানে অনন্যার খালা-খালুও তো ওদের সাথেই থাকে। সবসময় ওর দিকে কড়া নজর ওনাদের।
-এটা কোরো না, ওটা কোরো না, ভারী জিনিস তুল না, ওয়াশ রুমে সাবধান, আরও কত কি!
এখন থেকেই সে ছোট্ট বাবুর জন্য জামা-কাপড়, কাঁথা-তোয়ালে সব কিছুই সংগ্রহ করে রাখছে। যদি প্রয়োজনের সময় কোন কিছু না পাওয়া যায়!
সারাদিন সে তার ছোট্ট বাবুটার সাথে গল্প করে। তাকে গান শোনায়।
বই পড়ে জানার চেষ্টা করে তার বাবুটা ঠিক কত বড় হল। ওর কোন কষ্ট হচ্ছে কিনা এই ভেবে অস্থির হয়।
ফাহিম মাঝে মাঝে অভিমান করে।
-"এখন তো আমাকে তুমি আর ভালোবাস না। তোমার সব ভালোবাসা ঐ পুচকে টার জন্য।"
-"খবরদার! আমার সোনাবাবুকে পুচকে বলবে না।" অনন্যা চোখ পাকায়। এরপর আরও কিছুক্ষণ খুনসুটি, তারপর গল্প, আদর, ভালোবাসা। নতুন স্বপ্নে ওদের জীবন ভরে ওঠে।
দিনে দিনে অনুর বাবুটা বড় হয়ে ওঠে। আজকাল ও তার নড়া-চড়া বুঝতে পারে। মাকে কাছে না পাওয়ার হাহাকার মেটানোর জন্য অনু তার অনাগত সোনামনিকেই বেছে নেয়। তাকে বুকে নিয়ে আদর করার জন্য অস্থির হয়।
মাঝে মাঝে ফাহিম ওকে জড়িয়ে ধরে ওর সন্তানকে অনুভব করে।
অনুর শরীরটা ভালো নেই। এ মাসেই ওর বাবুটার পৃথিবীর আলো দেখার কথা। ফাহিমও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সব সময় ডাক্তার এসে চেক-আপ করছে। ফাহিমের মা-বাবা তো আছেই। এত সেবা-যত্নের মাঝে থেকে তো অনুর কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। তবুও সে তার মায়ের অভাব বোধ করে। যে মাকে কোন দিন চোখে দেখেনি, আজ তাকেই যে ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনে হয়!
ডেলিভারির দিন সকালে ডাক্তারকে খুব চিন্তিত মনে হল। অনন্যার ব্লিডিং নাকি নরমালের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। কিছুতেই তা কমানো যাচ্ছে না। ফাহিমকে অনু অনুরোধ করে ওর যা হয় হোক, ওর সন্তানকে যেন অবশ্যই সুস্থ রাখা হয়।
সারাটা দিন অবিরাম যন্ত্রনার পরিশেষে সেদিন সন্ধ্যাবেলা অনুর ছোট্ট মেয়েটা তার পৃথিবীতে আসার আগমন বার্তা জানাল। মেয়ের আগমনী কান্না শুনে ফাহিমের মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়।
ঠিক সেই সময় ডাক্তার ফাহিমকে জানায় অনন্যা আর নেই। সেও তার মায়ের অনুগামী হয়ে স্বামী, সংসার আর ওর সবচেয়ে আকাঙ্খিত সন্তানের মায়া ত্যাগ করে অন্যলোকে যাত্রা করেছে।।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ৮:৩১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×