
গ্রামে যাদের ছোট বেলা কেটেছে, তাদের জীবনের সাথে একটা অংশ জুড়ে আছে কুসংস্কার । বিশেষ করে আমাদের বড়রা সেই সব কুসংস্কার আমাদের মাঝে সঞ্চালিত করেছেন । ছোটবেলায় আমরা সেই সব কুসংস্কার মেনে চললেও একটু বড় হয়ে গেলেই আমরা টের পেতে শুরু করি যে আসলে এসব বিশ্বাস করার কোন মানে নেই । আমার নিজেও এমন অনেক কুসংস্কার সংস্পর্শে এসেছি । আজকে সেই সবের কিছু অংশ তুলে দিলাম । আপনাদের অনেকের সাথেই মিলে যাবে !
১. বেড়ালের কাছে মাফ চাওয়াঃ ছোট বেলায় আমার গলায় কাঁটা বিধে যাওয়ার খুবই কম একটা ব্যাপার ছিল । মাছ খেতে গেলেই আমার গলায় কাঁটা বিধতো ! বেশির ভাগ সময়ে দেখা যেত যে খালি ভাত গিললে সেই কাঁটা চলে যেত । তবে কিছু কিছু দিন কোন ভাবেই সেই কাঁটা যেত না । তখন নানান ফন্দিফিকির করতে হত । তার ভেতরে একটা হচ্ছে বেড়ালের কাছে মাফ চাওয়া । কারণ হিসাবে বলা হত যে কাঁটা হচ্ছে বেড়ালের খাবার । আমি সেই খাবার খেয়ে বেড়ালের প্রতি অন্যায় করেছি । তাই তার কাছে মাফ চাইতে হবে ।
২. জোড়া কলাঃ কলা আমার পছন্দের একটা ফল । আমি ছোট বেলা থেকেই নিয়মিত কলা খাই । তবে ছোট বেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে যে জোড়া কলা খেতে নেই । এই জোড়া কলা খেলে নাকি জমজ সন্তান হবে । একসাথে দুইটা বাচ্চা হবে এটা আমাদের কাছে তখন অদ্ভুত লাগতো । তাই সব সময় জোড়া কলা এড়িয়ে চলতাম !
৩. চায়ের পরে পানি খেলে দাঁত পরে যায়ঃ সব কিছু খেয়েই আমার পানি খাওয়ার একটা অভ্যাস । কিন্তু চায়ের পরে পানি খেতে গেলেই আমাকে শুনতে হত যে চায়ের আগে পানি খেতে হয়, চা খাওয়ার পরে পানি খেলে দাঁত পরে যায় । একটু বড় হলে আমি ঠিক ঠিক বুঝে গেলাম যে আসলে চায়ের আগে কিংবা পানি খেলে দাঁতের কিছুই হয় না । সেই তখন থেকেই আমি সব সময় চা খাওয়ার পরেই পানি খাই । আজও আমার দাঁত পরে নি ।
৪. রাতে বীন/বাশি বাজালে সাপ আসেঃ বীন বাজালে যে সাপ আছে- এই থিউরী আসলে মানুষ কোথা থেকে পেয়েছে কে জানে । আমাদের বাংলা সিনেমাতে আমরা দেখেছি সাপুড়ে বীন বাজিয়ে নাগিনকে নাচিয়েছে । এমন কী আমাদের এলাকাতে যদি সাপ খেলা দেখাতে আসতো কোন সাপুড়ে সেখানেও দেখেছি বীন বাজিয়ে সাপের খেলা দেখাতে । পরে জেনেছি যে এই বীনের সাথে সাপের আসা না আসার কোন সম্পর্কে নেই ।
৫.একা শালিক দেখাঃ যখনই আমরা কোন শালিক পাখি দেখতাম তখনই তার সঙ্গী শালিক খুজতাম । যদি না খুজে পেতাম তাহলে সেটা দেখে সালাম দিতাম ।আমাদের এলাকাতে কুসংস্কার ছিল যে একা শালিক দেখলে যদি সালাম না দেওয়া হয় তাহলে বউ(স্বামী) মরে যাবে । ভবিষ্যতের বউয়ের জীবন রক্ষার জন্য এই কাজ করতে হত !
৬. দাঁত ইদুরের গর্তে ফেলাঃ দাঁত পরার অভিজ্ঞতা তো আমাদের সবারই আছে । আমি আমার সব দাঁতই বলতে গেলে ইদুরের গর্তে ফেলেছি । আমাদের গ্রামে প্রচলন ছিল যে যদি দাঁত ইদুরের গর্তে না ফেলা হয় তাহলে ভাল দাঁত উঠবে না ।
৭. পরীক্ষার সকালে ডিম খাওয়া যাবে নাঃ সকালের নাস্তা হিসাবে ছোট বেলা থেকে ডিম একটা কমন খাবার ছিল । সকালে বেলার খাবার ছিল, গরম ভাত, আলু ভর্তা/ডাল চচ্চরী আর সাথে ডিম ভাজি । কিন্তু পরীক্ষার সকালে আমি কোন দিন ডিম খেতে পারি নি । এটা আমার মা খুব ভাল করে খেয়াল রাখতেন । এমন কি এখনও আমার ভাতিজার পরীক্ষার সময় সকালে তাকে ডিম দেওয়া হয় না ।
৮. রাত নখ কাটা যাবে নাঃ এই নিয়ম এখনও চলে । গ্রামের বাসায় গিয়ে রাতের বেলা আমি নেইল কাটার খুজলেই আমাকে শুনতে হয় যে রাতে নখ কাটতে হবে না ।
৯. সন্ধ্যা বেলা চুল খোলা রাখলে ভুতে ধরেঃ এটা অবশ্য আমার সাথে হয় নি তবে আমার চোখের সামনে হয়েছে। এবং এখনও হয় । সন্ধ্যা কিংবা দুপুর বেলা যদি চুল খোলা রেখে কোন মেয়ে বাইরে যায় তাহলে তাকে শুনতে হয় যে জ্বীন ভুতে ধরবে !
১০. কালো বেড়ালঃ এটা তো সব থেকে বেশি প্রচলিত কুসংস্কার । আমি সব সময় বেড়াল পছন্দ করি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমি বাসায় গেলেই আমার খাওয়ার সময় কয়েকটা বেড়াল এসে হাজির হয় । আমি তাদের খাবার দিই সব সময় । তবে কালো বেড়াল এলে বাসায় মানুষ জন সেটা ঠিক পচন্দ করে না । কালো বেড়াল মানেই অশুভ । অথচ একটা কালো বেড়াল সাদা বেড়াল আলাদা কোন ব্যাপার না ! এই সহজ স্বাভাবিক কথাটা মানুষ বোঝে না ।
১১. পেছন থেকে ডাকাঃ ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি যে বাবা যখন অফিস যাওয়ার জন্য বের হত হত পেছন থেকে ডাক দিলে খুব রেগে যেত । পেছন থেকে ডাক দেওয়া মানে হচ্ছে অশুভ কিছু ঘটা !
১২.হেঁচকি উঠলে কেউ তোমাকে মনে করছেঃ এটা আপনারা শুনে থাকবেন । খাওয়ার সময় যখনই হেঁচকি উঠে এর মানে হচ্ছে তোমার কথা কেউ মনে করছে ।
১৩. সাঁতার শিখতে হলে পিপড়া খাওঃ একদম ছোট বেলার কথা । সাঁতার শিখতে হলে নাকি পিপড়া খেতে হবে । পিপড়া যেমন মরে গেলে পানিটে ভাসে তাই পানিতে ভাসতে হলে এই পিপড়া খেতে হবে । অবশ্য আমি কোন দিন এই পিপড়া খাই নি । না খেয়েই সাঁতার শিখে গেছি ।
১৪. স্বামীর নাম মুখে আনা যাবে নাঃ এটা তো এখনও আমাদের সমাজে খুব ভাল ভাবে প্রচলিত । মেয়েরা কখনই তার স্বামীর নাম মুখে আনে না । তাদের বিশ্বাস যে স্বামীর নাম মুখে আনলে তার অমঙ্গল হবে । আমার মা সব সময় আমার বাবাকে সম্মোধন করেছে আমার বড় ভাইয়ের আব্বা বলে । অন্য দিকে আমার ভাবী ভাইয়াকে সব অয়নের আব্বা বলে সম্মোধন করে, আমার সাথে কথা বলতে গেলে বলে তোমার ভাই এই করেছে ঐ করে !
১৫. বই খোলা রাখলে শয়তান পড়ে ফেলেঃ এটা খুব মজার একটা ব্যাপার । আমরা যখনই ছোট বেলায় পড়তে বসতাম, যদি এমন কোন দরকারে বাইরে যাওয়া লাগতো কিংবা অন্য রুমে যেতে হত, যদি বইটা খোলা রাখা অবস্থায় যেতাম তখন মা বলতো যে বই খোলা রেখে গেলে সেই পাতার পড়া শয়তানে পড়ে ফেলে । পরে সেই পড়া আর মুখস্ত হয় না ।
আরও আছে ভাঙ্গা আয়নাতে মুখ দেখা যাবে না, ভাঙ্গা চিরুনী দিয়ে চুপ আচড়ানো যাবে না ইত্যাদী । উপরের বর্ণনা গুলোর ছাড়াও আরও অনেক কুসংস্কার রয়েছে আমাদের গ্রাম বাংলাতে । আপাতত আমার এই গুলোই মনে পড়ছে যেগুলোর সরাসরি সংস্পর্শে আমি এসেছি । পরে আরও কিছু মনে পড়লে যুক্ত করে দিবো । আপনারাও আপনাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন ।
ছবিটা মিডজার্নি এআই দিয়ে আঁকা
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




