somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যাথাতুর বংশীবাদক

২৯ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৪:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কতদিন পর ভৈরবের শীতল আর ঘোলা জলে শরীর ডোবালাম ঠিক ঠিক হিসেব করে বলতে পারবো না। কম করে হলেও পাঁচ বছর তো হবেই। আমার হারানো শৈশব, স্নিগ্ধ বিকেল আর উদাস দুপুর গুলো লুকিয়ে আছে ভৈরবের তীর ঘেষে বেড়ে ওঠা বিস্তির্ণ জনপদ খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে। কত শত সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা যে এই নদীর জলে ডুব সাঁতার কেটে কাটিয়ে দিয়েছি তার সঠিক হিসেব আমার জানা নেই। উচ্চ শিক্ষার লোভে আমি এখন ঢাকায় থাকি। প্রতিনিয়ত ঢাকার যান্ত্রিকতা আমাকে গিলে খাচ্ছে। সীমাহীন যানজট, কাছের মানুষদের কৃত্তিম হাসি, ক্যাম্পাসের নোংরা রাজনীতি আর পঁচা-বাসি খাবার খেতে খেতে এক একবার মন চায় পালিয়ে যাই ভৈরবের তীরে। কিন্তু পালাতে পারিনা। বাস্তবতা নামক মাকড়সার জাল আমাকে আষ্টে-পিষ্টে বেধে ফেলেছে। মাঝে মাঝে প্রচন্ড মন খারাপের দিনে সূর্যসেন হলে যাই। কাজল ভাইয়ার সাথে মধ্যরাত পর্যন্ত নদীর পাড়, পুরনো বন্ধু আর প্রিয় স্কুলের গল্প করি, বলি একাকিত্বের কথা। কাজল ভাই সান্ত্বনা দেন আর আমার কান্ত দীর্ঘশ্বাসে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে জেগে ওঠে ৩২৫ নম্বর রুমের গাঢ় অন্ধকার। আমি শুধু প্রতীক্ষার নদীতে হাটুজল নেমে বড় কোন সুযোগের অপো করি। ছুটি পেলে ছুটে যাই খুলনায়, কোলাহলহীন মৃত শিল্প নগরীতে। যেভাবে ঈদের ছুটিতে এবার গিয়েছিলাম।
এতগুলো বছর পর যখন আমি পুনরায় নদীতে নামলাম, শত শত স্মৃতি আর অনুভূতি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল শৈশবের সোনামাখা উঠোনে। আহা ! তুলতুলে শৈশব আমার...। বদরুল কাকার দোতলা বড়ি আমাদের ভাষায় ‘টুইন-টাওয়ার’ এখনও দাড়িয়ে আছে ভৈরবের একেবারে কোল ঘেষে। মনে পড়ে নির্মাণ কাজ চলার সময় পালা করে আমি, দবির, মাহবুব, রাজ্জাক ভাই, রনি, সোহেল কত্তবার যে ছাদ থেকে ভরা যৌবনা ভৈরবের বুকে লাফিয়ে পড়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। প্রায় প্রতিদিনই পওয়ার হাউজে তেল দিতে বড় বড় জাহাজ নোঙর করত। আমরা বিকেলের ম্লান আলোয় বাজি ধরে তেলের জাহাজ ছুঁতে যেতাম। উত্তেজনা আর আনন্দের ঢেউয়ে ভেসে যেত ‘ভয়’।
বর্ষার দিনে ভৈরবের জলে বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দ আমার বোধের বন্দরে নাড়া দিত। আমার কেমন যে লাগত ! সারা রাত ঘুম হত না। কোথাথেকে যেন ঝাকঝাক কচুরি পনা ভেসে আসত একেকবার। আমরা ভেলা বানাতাম। মনে পড়ে একবার কচুরি পানার ভেলায় চড়ে ভাটির টানে চলে গিয়েছিলাম বহুদূরে। ফিরতে পারছিলাম না বলে সে কি কান্না...! মাঝে মাঝে গভীর রাতে নদীর তীরে বসে কে যেন বাঁশীতে করুণ সুর তুলত। ছোট্র আমার তখন সব কিছুতেই আনন্দ ছাড়া জাগতিক দু:খ বিষয়ক কোন জ্ঞানই ছিল না। তবু বাঁশীর সুরে নিদ্রাহীন কেটে যেত সারা রাত। শুধু বুঝতাম- ‘আমার মন কেমন করে !’
সবই আছে আগের মত। এখনও তেলের জাহাজ নোঙর করে দাড়িয়ে থাকে মাঝ নদীতে। এখনও বর্ষায় কচুরি পনার ঝাঁক এসে ঢেকে দেয় ভৈরবের ফর্সা বুক। এখনও নদীর বুকে বৃষ্টির ‘টাপুর-টুপুর’ শব্দে হয়তো কেঁপে ওঠে অচেনা কোন কিশোরের বুক। হয়তো এখনও ফাগুনের রাতে বাঁশীতে ‘মন কেমন করা’ সুর তোলে নামহীন বংশীবাদক...। শুধু নদীর তীর ছুঁয়ে দাড়িয়ে থাকা বয়সী বট গাছটার মত আমি নেই ! আমি নেই !
আমার অনুপস্থিতি তোমাকে কি কাঁদায় নদী, তুমি কি শুনতে পাও অভিমানী এ বালকের করুন প্রর্থনা ?

২.
ভৈরবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেনহাটির অনেক কিছুই বদলে গেছে। একেএকে মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের বেতন নেই, মুখে হাসি নেই। বাতাস কাঁপিয়ে ৬ ঘন্টা বিরতীতে বাজেনা আর শ্রমিক সাইরেন ! চায়ের দোকান গুলোতে ভীর নেই আগের মত। মিল বন্ধ তাই অসংখ্য মানুষ ভাগ্যের তাড়নায় চলে গেছে অন্যত্র। কালাম কাকা, ছালমা আপা, রকিব, শতরুপা, মুন্নি কিংবা নাম না জান হিন্দু পাড়ার মিষ্টি বউদি- তোমাদের সাথে আর কি দেখা হবে কোন কালে ? কথা হবে নদীর ঘাটে স্নাানরত রমনীর সাথে ? ...এ নদী সব জানে, সব বোঝে- শুধু বলেনা কিছুই। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ:।
আমার ভৈরব স্নানের দুরন্ত সঙ্গীরা এখন জীবনের টানে টালমাটাল। মনিকা ভ্যান চালায়, ফরহাদটা জুট মিলে কাজ করে, সেনাবাহিনীর চাকরী হারিয়ে রনি ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছে, রিয়াজ সারা দিন ঘুরে বেড়ায়, পলাশ বিস্কুট কম্পানীর ম্যানেজার, সোহেল রেরওয়েতে চাকরী করে আর আমি দেশসেরা বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র হয়ে সোনালী আগামীর স্বপ্ন দেখি, থাকি রাজধানীতে। নিজেকে বড্ড বেশী অপরাধী মনে হয়। ভিতর থেকে খসে পড়ে মেরুণ দীর্ঘশ্বাস।
...শীতের পাতার মত টুপটাপ ঝরে যায় সময়। মনে জাগে কেবল বিনিদ্র বিস্ময়- আচ্ছা মানুষ এত দ্রুত বড় হয় কেন, এত দ্রুত !!

৩.
কাশ শেষে হলে ফিরবার পথে কান্ত বিষন্ন এই আমার প্রায়ই খুলনা যেতে ইচ্ছা হয়। মন চায় হেমন্তের বিকেলে নদীর তীরে লাল-নীল ঘুড়ি উড়াই, ফুটবল খেলে কাদামাখা শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ি জলে, মায়ের বকুনি খেয়ে পৃথিবীর সবচে’ দু:খী মানুষটার মত নদীরপাড়ে বসে থাকি অথবা জোসনা রাতে ভৈরবের বুকে চাঁদের রুপালী প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে ভাবি কোন এক মেঘলা-পরীর কথা !
ইচ্ছে গুলো অধরাই থেকে যায়। ‘অক্ষমতা’কে সঙি করে রুমে ফিরি, মনে মনে করি অনন্ত প্রর্থনা- ভালো থেকো প্রিয়তম নদী আমার, ভালো থেকো ব্যাথাতুর বংশীবাদক...!
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×