ছোট্ট অপূর্বর শৈশব
নোয়াখালীর এক শান্ত গ্রামে জন্মেছিল অপূর্ব। গ্রামের মেঠোপথ, ধানক্ষেতের সবুজ, আর পুকুরের স্বচ্ছ জলে ভরা ছিল তার শৈশব। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় অপূর্ব ছোটদের আগলে রাখত। গাছে চড়া, নদীতে ঝাঁপ দেওয়া, পুকুরে মাছ ধরা—এসব নিয়েই দিন কাটত। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসে না। স্কুলের বেঞ্চে বসেও মন পড়ে থাকত বাইরে—মাঠের খেলার মাঝে।
তার বাবা ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। পরিবার চালানোর তাগিদে বাবাকে বিদেশে যেতে হয়েছিল। অপূর্বর মনে একটাই আশা জন্ম নিল, “একদিন আমিও বাবার মতো বিদেশ যাব।” অষ্টম শ্রেণি পাশের পর বাবার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অপূর্ব পা রাখল এক অজানা গন্তব্যের পথে—ইতালি।
ইতালিতে নতুন জীবন: স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন?
২০১৮ সালের শেষ। রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দরে প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে পা রাখে অপূর্ব। চারপাশের আলোর ঝলকানিতে মনে হয়েছিল, “এটাই বুঝি স্বপ্নের দেশ।” কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই বাস্তবতার নিষ্ঠুর চেহারা ধরা পড়ল।
বাবার পরিচিত এক রেস্টুরেন্টে কাজ জুটলো। দিনরাতের পার্থক্য ভুলে কাজ করতে হতো—প্লেট ধোয়া, রান্নাঘরের গরম চুলার পাশে দাঁড়িয়ে কাটাকুটি করা, আর টেবিল মোছা। বাংলার সেই সবুজ মাঠের জায়গায় এখন সিমেন্টের এক বিশাল জঙ্গল। রেস্টুরেন্ট থেকে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত। ঘুমাতে যাওয়ার আগেই মায়ের ফোন আসত:
• “বাবা, কেমন আছিস?”
• “ভালো আছি মা।”
কিন্তু ফোনের ওপারে কখনো সে বলতে পারত না—“মা, ভালো নেই। প্রতিদিনের কাজের চাপ, একাকিত্ব, আর ব্যর্থতার ভয় আমাকে পিষে ফেলছে।” সেই মুহূর্তে অপূর্বর মনে হত, সে যদি আবার ফিরে যেতে পারত তার গ্রামের সেই সহজ জীবনে।
প্রেমের আশা, বিশ্বাসঘাতকতার কষ্ট
রেস্টুরেন্টের একজন নিয়মিত গ্রাহক ছিল সোফিয়া। অপূর্বের সৌজন্য আর হাসিমাখা মুখ দেখে মেয়েটি ধীরে ধীরে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। একসময় তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, আর সেই বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্ক। অপূর্বের মনে হতে লাগল, সোফিয়াই হয়তো তার একাকিত্বের অবসান।
কিন্তু একদিন সোফিয়ার গোপন সত্য জানলো অপূর্ব—সে বিবাহিত। অপূর্বের বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সোফিয়া তার ভুল স্বীকার করে কেঁদে বলল:
• “আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার জীবনের জটিলতাগুলো তোমার বোঝার কথা নয়।”
সেই রাতটা অপূর্ব একা কাটিয়েছিল রোমের সড়কে হাঁটতে হাঁটতে। ভেতরের হতাশা আর দুঃখ যেন তার সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছিল। সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নিল, প্রেমের জন্য নয়—নিজের জন্য বাঁচবে।
লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সাফল্যের সন্ধান
২০২২ সাল। অপূর্বর জীবনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। রেস্টুরেন্টের সাধারণ কর্মচারী থেকে ম্যানেজার হয়ে ওঠে সে। ইতালিয়ান ভাষা শিখে ফেলে চমৎকার দক্ষতায়, আর নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা দিয়ে অর্জন করে মালিকের আস্থা।
এই সাফল্যের মধ্যেই বাবার পাঠানো টাকাগুলো থেকে কিছু জমিয়ে অপূর্ব রিয়েল এস্টেটের দিকে ঝুঁকল। একসময়, ২০২৪ সালে, রোমের প্রাণকেন্দ্রে নিজের প্রথম ফ্ল্যাট কিনে শুরু করলো “অপূর্ব প্রোপার্টিজ” নামে ব্যবসা।
একদিন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করল অপূর্ব:
“যে মাটিতে হোস্টেলের বিছানায় কেঁদেছি, আজ সেই মাটিতেই নিজের ছাদ দাঁড় করিয়েছি।”
অপূর্বর জীবনের শিক্ষা
অপূর্বর জীবনের কাহিনি শুধু তার নিজের নয়, বরং প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের জন্য একটি শিক্ষা।
১. স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকুন: ব্যর্থতা চূড়ান্ত নয়। অষ্টম শ্রেণি পাস অপূর্বর সাফল্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
২. বেদনাকে শক্তিতে পরিণত করুন: প্রেমে ব্যর্থ হয়েও অপূর্ব ভেঙে পড়েনি। বরং সেই কষ্টই তাকে আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।
৩. পরিশ্রমই আসল: বিদেশের মাটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ধৈর্য্য আর কঠোর পরিশ্রমই ছিল তার মূল শক্তি।
শেষ কথা
জীবন কখনোই মসৃণ নয়। পাহাড় ডিঙানোর শক্তি যারা রাখে, তারাই চূড়ায় পৌঁছায়। অপূর্বর গল্প আমাদের শেখায়—সংগ্রাম আর অধ্যবসায় ছাড়া জীবনের সৌন্দর্য অনুভব করা যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:৫৫