বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সাহিত্যিক তথা উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সংকলনে হরর ফ্যান্টাসির উপর রচিত উপন্যাস দেবী'র উপর রিভিউ মানে আদার ব্যাপারীর জাহাজের গায়ে ঢুঁ মারার মতো দুঃসাহসীক প্রচেষ্টা। অমার্জনীয় অপরাধ জেনেও এমন একটি অপকর্মের জন্য পাঠককুলের কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রানু প্রায়ই তার আশপাশে অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করে। সদ্য বিবাহিতা রানুর অস্বাভাবিকতাকে দ্বিগুণ বয়সের পতিদেবতা মিস্টার আনিস সাহেব প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও অবশেষে তার অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে অফিসের সহকর্মী কমলেন্দু বাবুর পরামর্শে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন অধ্যাপক অসম্ভব যুক্তিবাদী মিস্টার মিসির আলি সাহেবের শরণাপন্ন হন, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সাইক্রিয়াট্রি পড়ান।
প্রথম দর্শনেই মিস্টার আলি রানুর মধ্যে এক্সট্রাসেনসরি পারসেপশনের সন্ধান পান। উল্লেখ্য বিশ্বে খুব নগণ্য সংখ্যক মানুষ এই বিরল প্রতিভার অধিকারী হন। এমন ক্ষমতার অধিকারীরা স্বপ্নে বা অনুমানের উপর নির্ভর করে কী ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটবে তা বলতে পারেন। সাইকোলজির একজন শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা করতে মিস্টার আলি ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দিয়েও এমন কারোর মধ্যে এক্সট্রাসেনসরি পারসেপশনের খোঁজ পাননি, সেখানে হঠাৎ রানুকে পেয়ে তিনি আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন এবং খোঁজখবর নিয়ে বুঝতে পারেন রানুর চরিত্রের মধ্যে দুটি বিষয় মিশে আছে। ইএসপির পাশাপাশি সারাক্ষণ অশরীরী উপস্থিতি প্রসঙ্গে তার অডিটরি হ্যালুসিনেশন ঘটেছে।যে বিষয়ে চিকিৎসার জন্য তার পূর্ববর্তী জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা জানাটা অত্যন্ত জরুরি।
রানুর কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের পর ঘটনার সত্যতা নিরুপনে মিস্টার আলি তাদের গ্রামে যান। উল্লেখিত ঘটনাগুলোর পাশাপাশি নতুন একটি রহস্যও তিনি উম্মোচন করেন। ছোটবেলায় এক আত্মীয়ের বিয়েতে নদীতে স্নানের সময় যে লাশ তার প্যান্ট টেনে ধরেছিল বলে রানু মিসির আলি সাহেবকে উল্লেখ করেছেন।পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে বাডিটিকে নিকটবর্তী নদীর চরে পুঁতে দেওয়া হয়। কিন্তু আসল ঘটনাটা হল বাড়ি থেকে সামান্য দূরে পরিত্যক্ত বিষ্ণু মন্দিরে একদিন দেবী মূর্তিকে দেখানোর নামে রানুকে নিয়ে গিয়ে জালালউদ্দিন তার প্যান্ট খুলে ফেললে, দেবী মূর্তিটি ছুটে এসে রানুর মধ্যে ঢুকে পড়ে। ফলে তার গা থেকে আগুনের হল্কা বেরোই। জালালউদ্দিন কোনোক্রমে পালিয়ে সেদিন নিজেকে রক্ষা করে। সে সময় থেকেই রানু অসম্ভব সুন্দরী হয়ে ওঠে। যদিও মিস্টার আলি বয়ঃসন্ধি থেকে যৌবনোত্তীর্ণ তরুণীর সুন্দরী হওয়াটা স্বাভাবিক বলে যুক্তি দেখান আর মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে বলেও মতামত দেন।
উপন্যাসের অন্য একটি দিকে রানুর ঘর মালিকের মেয়ে নীলু যে নিজের কুৎসিত রূপ নিয়ে রীতিমতো বিব্রত। বিজ্ঞাপন দেখে একাকীত্ব মেটাতে সে একটি ছেলের প্রেমের ফাঁদে পা দেয়। প্রথম দিনেই তার অমায়িক ব্যবহারে নীলু বিগলিত হয়ে পড়ে। তবে দ্বিতীয় ডেটিংয়ে প্রথমে ভালোবাসা অভিনয় করে গাড়িতে তুললেও ক্রমশঃ বহিপ্রকাশ করে ছেলেটি তার আসল চেহারার। নীলুকে সর্বনাশ করতে উদ্ধত হলে একসময় নীলু অসহায় হয়ে পড়ে। ওদিকে বাসায় রানু অতি প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা বুঝতে পারে নীলুর বিপদ আসন্ন। সে উদগ্রীব হয়ে আশপাশে উপস্থিত সকলকে উদ্ধারকাজে নামাতে ব্যর্থ হয়ে একসময় নিরুপায় হয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। গায়ে চলে আসে প্রবল জ্বর যেন পুড়ে যাওয়ার উপক্রম আরকি। আনিস বিহ্বল হয়ে অসুস্থ স্ত্রীর পাশে প্রতিবেশী ভাবিকে বসিয়ে ডাক্তার আনতে ছোটে। কিন্তু তার আসার আগেই রানু চলে যায় পরজগতে।
ওদিকে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করার সময় নীলু হঠাৎ দেখে একটা ফুলের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। একটি অপার্থিব শক্তি দুষ্টু লোকটির দিকে এগিয়ে আসছে। সমস্ত ঘর খিলখিল হাসিতে ভরে উঠলো। লোকটি চাপা গলায় 'আমাকে বাঁচাও' বলে চিৎকারও করলো। কিন্তু কোনো শব্দ করতে পারছে না।
ঘটনার পরে কোন একদিন ক্লাসে মিস্টার আলি অবিকল রানুর মত দেখতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বুঝলেন সে আসলে ওনারই ছাত্রী নীলু। যার রহস্যময়ী হাসিতে মিস্টার আলি ক্রমাগত ঘামতে লাগলেন....
পাঠকের প্রতিক্রিয়া:-
গল্পটি পাঠকালে যে প্রশ্নগুলি মনে জেগেছে-
১-রানু ও আনিসের বয়সের ব্যবধানটা দ্বিগুনের বেশি হওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না।
২-যেহেতু হরর ফ্যান্টাসির উপর উপন্যাসটি রচিত সেক্ষেত্রে মাঝরাতে টিপটিপ বৃষ্টি পড়া, দরজার পিছনে অশরীরি ঘুরে বেড়ানো, রান্নাঘরের টুংটুং শব্দগুলো মিলিতভাবেও যথেষ্ট হরর উপযোগী বলে মনে হলো না। তবে নিশুতি রাতে একা একা পড়লে ভৌতিক অভিজ্ঞতা হতে পারে বলে মনে হয়।
৩-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতা নীলুফার এতো সহজেই বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে জীবন সংকটে জড়িয়ে পড়বে-বিষয়টি খুব যুক্তিযুক্ত লাগলো না।
৪-মিস্টার আলির মুখে একাধিকবার মাথাব্যথার প্রসঙ্গটি অনাবশ্যক লাগলো।
৫-যেহেতু রানু ইএসপি ক্ষমতার অধিকারী সে ক্ষেত্রে তাদের গ্রাম মধুপুরে যাওয়ার খবরটি অনুফার কতৃক চিঠির মাধ্যমে অবগত হওয়াটাও খুব স্বাভাবিক লাগলো না।
৬-সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ। লেখকের সাহিত্য সৃষ্টির পিছনে নিঃসন্দেহে একটি মেসেজ থাকবে।সেক্ষেত্রে প্রখর যুক্তিবাদী মিস্টার আলি সাহেব যেভাবে তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার যুক্তিতে ঘটনার পরম্পরা নির্মাণ ও ব্যাখ্যা করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই আলি সাহেব যখন রানুর মৃত্যুর পর ছাত্রী নীলুফার মধ্যে অবিকল রানুর অবয়ব চাক্ষুষ ও রহস্যময়ী হাসি প্রত্যক্ষ করেন ও রীতিনীতি ঘামতে থাকেন, তখন প্রকারান্তরে মেনে নিতে হয় যে অতিপ্রাকৃত শক্তি যুক্তিবাদকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। পাঠক হিসেবে যেটা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়েছে। অথচ মিস্টার আলির যুক্তিকে সবশেষে প্রতিষ্ঠা করবেন, এমনটাই আশা করেছিলাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-
১ -পোস্টটি উৎসর্গ করা হলো ব্লগে আমার ভ্রাতৃপ্রতিম অনুজ রাজীব নূরকে, যিনি এই মুহূর্তে কলকাতা পরিভ্রমণে আছেন।
২-টাইপো থাকলে আগামীকাল সময় নিয়ে ঠিক করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:০৫