ভীতুর ভূত দর্শন (পর্ব- ২)
ভীতুর ভূত দর্শন (শেষ- পর্ব)
সদ্য কলেজে ভর্ত্তি হয়েছি।কয়েকদিনেরর মধ্যে কলেজের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল।রবিবারের ছুটিতে বন্ধুদের জন্য মন খারাপ লাগত।কলেজের ক্লাসের ফাঁকে তপনদার ক্যান্টিনে চারটি চা সাতটি করে খাওয়া ও সঙ্গে চেন স্মোকারের শিক্ষা নেওয়ার মধ্যে আমার কলেজ জীবন বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।সঙ্গে ছিল ক্যান্টিনে আগত কোন মহিলাকে লক্ষ্য করে সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে বিভিন্ন রকম নক্সা বা রিং করে সদ্য পৌরুষত্ব জাহির করার এক অদ্ভূত প্রতিযোগিতা।আর চলতো দেশ ও জাতির মঙ্গলের লক্ষে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং স্মার্টনেস প্রদর্শনের জন্য একটু খিস্তি খেউর দেওয়াও প্রভৃতি।
এরই মধ্যে একদিন আমার বন্ধু প্রসেনজিৎ কোন একটা প্রসঙ্গে জানাল,
-ওসব ভূত-ফুত বলে কিছু নেই।সবই নাকি মানুষের কারসাজি।
আমি বরাবরি ভীতু প্রকৃতির।পড়াশোনায় ভাল না হলেও অন্তত হাবেভাবে ভাল ছেলে হবার চেষ্টার কসুর করতামনা।স্কুলে প্রদীপ্ত, অর্নব,নীলুরা যখন আড্ডা মারতো, আমি তখন নষ্ট হওয়ার ভয়ে,
-এমা!এসব নোংরা কথা বলতে আছে? বলাতে বেশ কয়েকবার বন্ধুদের কাছে ধমক খেয়েছিলাম।
ওরা আমাকে পাল্টা লেডিস বলে খ্যাপাত।
আমি,
-ধ্যৎ অসভ্য! বলে একটু মৃদু প্রতিবাদ করতাম।তবে ওরা মিশতে নেবেনা এই ভয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামিয়ে আবার ওদের পাশে ঘুরঘুর করতাম।
স্কুলেও একদিন ভূতের প্রসঙ্গ উঠেছিল জীববিজ্ঞানের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় তাপসবাবু স্যারের ক্লাসে। সকাল থেকে সেদিন অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছিল। টিফিনের পর পাঁচ পিরিয়ডের শুরুতে স্যার ক্লাসে এলে আমরা ওনার কাছে ভূতের গল্প শোনার বায়না করেছিলাম।স্যার সেদিন আমাদের এই সব অবাস্তব বিষয়কে মনে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং যুক্তি দিয়ে সবকিছু গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।তবুও মনের মধ্যে কেমন যেন ভূতের ভয় বরাবরি থেকে গিয়েছিল।
প্রসেনজিতের কথায়, কলেজের বন্ধু প্রবীর ওকে ভূত দেখানোর প্রস্তাব দিল।প্রসেনজিৎও সাহসী ছেলে। সহজে হার মানার পাত্র নয়। শুধু মুখের কথায় নয়, বাস্তবেও তা দেখাতে চায় কেন সে ওরকম বিশ্বাস করে।তবে ভূত দেখতে তো আর দল বেঁধে যাওয়া যায় না। কাজেই প্রবীর শর্ত বেঁধে দিল, প্রসেনজিৎ একজনের বেশি কাউকে সঙ্গে নিতে পারবে না।সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত শিবু, সুমিত,রাজু, সুদীপ সকলেই যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো।ওদের উচ্ছ্বাস দেখে আমারও সাহস বেড়ে গেল।উল্লেখ্য প্রসেনজিতের ডাকনাম গোরা।এবার আমিও বলে উঠলাম,গোরা তোর সঙ্গে আমিই যাবো। কলেজের এক অপরের ভালো নাম বাদ দিয়ে ডাকনাম ধরে ডাকাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। যে যুক্তিতে আমি হিরণ্ময় থেকে হয়েছিলাম হিরণ।প্রবীর যেন আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিল।ও তৎক্ষনাক প্রস্তাব দিল, -গোরা কতটা সাহসী সেটা পরীক্ষা করতে হলে অন্য কেউ নয় হিরণকেই সঙ্গে নিতে হবে।
আগেই বলেছি গোরা খুব সাহসী প্রকৃতির ছেলে। কাজেই প্রবীরের কথা গোরার সেন্টিমেন্টে আঘাত করলো।ও-ও চিৎকার করে বলে উঠলো,
-কোন শালাকেই আমি সঙ্গে নেব না। একাই যাব ভূতের ইন্টারভিউ নিতে।
উল্লেখ্য আমি না হয় একটু ভীতু, তাই বলে আমাকে নিয়ে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করায় আমিও বেশ ব্যাথা পেলাম।আমি গোরাকে জানালাম, -তোর আপত্তি থাকলে আমি যাবোনা।
একথা অস্বীকার করবোনা যে, আমি যেতে রাজী হলেও আমার গলা শুকিয়ে আসছিল।বুকের ভীতর আসন্ন ভয় দুরুদুরু করছিল। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি ওদের কাছে নিজেকে ধরা না দিতে। ওদিকে গোরা তখনো একা যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল।বাকিরা ওকে নানান ভাবে বোঝাতে লাগলো।শেষ পর্যন্ত ও আমাকে সঙ্গে নিতে রাজি হওয়ায় সকলে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।সুদীপ পাইন আমার হাত ধরতেই, বাকিরাও আমাকে নিয়ে একপ্রকার মাথায় তুলে নাঁচতে লাগলো।অথচ আমার ভেতর আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় যে চোরা স্রোত বইতে লাগলো তা কেবল অন্তর্যামীই জানেন।
নির্দিষ্ট দিনে বাসস্ট্যান্ডে গোরা ও প্রবীর আগে থেকেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।আমার দেরি হওয়াতে গোরা আমার পশ্চাদদেশে কষিয়ে দিল একটি লাথি।প্রবীরও কোন অংশে কম যায় না।সে একটি গালি দিয়ে বললো,
-ভাবলাম ভূতের নাম শুনে তোর** শুকিয়ে গেছে।
যাইহোক নিজের কৃতকর্মের জন্য এটুকু তিরস্কার আমার প্রাপ্য ছিল বলে মানসিক ভাবে তৈরী ছিলাম।কিছু পরে ওরা স্বাভাবিক হলে আমরাও গন্তব্যস্থানের উদ্দশ্যে রওনা দেই।
প্রবীরের বাড়ি যেতে আমাদের তিনবার নদী পাল্টাতে হয়েছিল।শেষবার ফেরি পার হতে হতে তখন বিকাল গড়িয়ে যায়।এখানে যোগাযোগের মাধ্যম একমাত্র পা-চালিত ভ্যান।কিন্তু এ অসময়ে সামনে একটাও না পাওয়ায় প্রবীরের নির্দেশ মতো আমরা হাঁটতে শুরু করি।ও জানালো,
- সন্ধ্যা নামলে এখানে আবার মামার আসার সম্ভাবনা থাকে।যেকারনে এই সমস্ত দ্বীপে বিকালের পর সাধারণত কেউ রাস্তায় থাকেনা।আর এজন্যই বাসস্ট্যান্ডে তোর দেরি করে আসাতে আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলাম।
নিজের ভুলের জন্য আরো একবার ক্ষমা চাইলাম।কিন্তু বাঘের নাম শুনতেই, এবার বুকে ঝোলানো মা কালীর মূর্তিটি বার কয়েক কপালে ঠেকাতে লাগলাম।আগে ছিল ভূতের ভয়।এবার আবার যোগ হল বাঘ মামা।মনে মনে নিজেকে অপরাধী করলাম,কেন এমন হিরোজিমের পরিচয় দিতে এমন অনিশ্চিয়তার মধ্যে নিজেকে টেনে আনলাম।
এখনকার মত এমন ফোনের যোগাযোগ তখন না থাকায় আমাদের আসার খবর প্রবীর বাড়িতে আগেভাগে দিতে পারেনি। যেমন দিতে পারেনি তার নিজের আসার খবরও।স্বভাবতই এরকম অসময়ে ছেলের সঙ্গে আমাদের দেখা পেয়ে, বাবা-মা বোন যেন চাঁদ হাতে পেল। ওদের চোখে মুখে ছিল উৎসুক দৃষ্টি।মুহূর্তে বাড়িতে যেন একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হলো। সেদিন ওখানে পৌঁছাতেই একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমরা সঙ্গের ব্যাগপত্রগুলো সবে ওদের বারান্দায় রেখেছি। মাসিমা মেসোমশায়ের সঙ্গে তখনও কুশল বিনিময়ের পর সামান্য কথাবার্তা চলছে। এরই মধ্যে একটা সুন্দরী মেয়ে আমাদের ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে।আমি প্রথমটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এমন একটা স্থানে অত সুন্দর একটা মেয়ে থাকতে পারে ভেবে। পরক্ষণেই মনে হলো ও-ই বা আমাদের ব্যাগে হাত দিতে যাবে কেন। অথচ এখানে আসার আগে প্রবীর জানিয়েছিল, তারা দুই ভাই। ভাইয়ের নাম সুপর্ণ।স্বভাবতই মেয়ে হওয়ার জন্য আগ বাড়িয়ে কথা বলতে ইতস্ততঃ করছিলাম। মেসোমশাই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভাই নয়, একমাত্র বোন সুপর্ণার সঙ্গে।কি অপূর্ব মায়াবী চাওনিতে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।সেও একবার আমার দিকে মিষ্টি করে হেসে মাথা নিচু করে রইল। প্রবীরের সঙ্গে চোখাচোখি হল।সে হো হো করে হাসতে হাসতে বলল,
- বোনটা আমার বড্ড সুন্দরীরে।ওকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা। তাই তোদের সঙ্গে অমনটি বলেছিলাম যে আমরা দুই ভাই।
প্রবীর আগে থেকে বাবা-মাকে আমাদের আসার কারণ বলতে নিষেধ করেছিল।কাজেই আমরা শহর থেকে ঘুরতে এসেছি,বলাই ওনারা খুব খুশি হলেন।
প্রবীরদের বাড়িটার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার।একদিকে আছে ইটের গাঁথুনির উপর টালির ছাউনি দেওয়া তিন কামরার একটি বাড়ি।পাশে আছে একটি ধানের গোলা, একদিকে তুলসিমঞ্চ। আর ঠিক তার উল্টো দিকে একটু দূরে আরো একটি ইটের গাঁথুনি ও টালি দেওয়া বাড়ি।গ্রামের বাড়ি হলেও বেশ ছিমছাম,সাজানো গোছানো। সুপর্ণাই আমাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালো।অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো এহেন ভিটে বাড়ি দেখে আমাদের মনটি বেশ ভরে গেল। তবে একথা অস্বীকার করবো না যে সারা দিনের ক্লান্তির সঙ্গে প্রচন্ড ক্ষিদেও পেয়েছিল।হাতমুখ ধুয়ে বসতে না বসতেই মাসিমা আমাদের খেতে ডাকলেন।খাওয়ার পরে আমরা প্রবীরের ঘরে শুয়ে পড়লাম।
দীর্ঘ রাস্তায় ক্লান্তির এক শেষ ছিলাম। কাজেই শোয়ামাত্র গেলাম ঘুমিয়ে।হাতে কোন ঘড়ি না থাকলেও আনুমানিক বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা নাগাদ প্রবীর ও গোরা আমাকে ডাকলো।ঠোঁটে হাত দিয়ে কথা বলতে বারণ করলো।চোখ ঘষতে ঘষতে প্রচন্ড বিরক্তের মধ্যে ওদের নির্দেশ পালন করলাম।বাড়ির বাকিরা তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অত্যন্ত সন্তর্পণে আমরা তিনজন ধানের গোলার পাশের ঘরটিতে ঢুকে পড়লাম।একটা কুপির আলো অবশ্য ঘরের মধ্যে জ্বলছিল।তবে তার আবছা আলোয় লক্ষ্য করলাম ঘরটি অপরিষ্কার, বলা চলে বেশ নোংরা বৈকি। ।ঘরে আসবাব বলতে কেবলমাত্র একটি বড় চৌকি ছিল। প্রবীর আমাদের দুজনকে পৌঁছে ওর ঘরে ফিরে গেল।ও ফিরতেই গোরা দরজা বন্ধ করে দিল। আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চৌকিতে আসন করে বসলাম। গোরাও আমার পাশে এসে বসলো।এই ঘরে এসে বুঝলাম, আমরা প্রকৃতই ভূতের সাক্ষাতের জন্য চলে এসেছি। নুতন করে আবার ভীতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল।গোরা আমার মনের ভাষা বুঝতে পারলো। মাথায় হাত দিয়ে বললো,
-ভয় পাস না হিরণ আমি আছি।
ও এমন আশ্বাস দিতেই আমি আবার শুয়ে পড়লাম।(চলবে)
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-রিপোস্ট করলাম। আজ কাভা ভাইয়ের ভূতের গল্পের লিংক দিতে ব্যর্থ হয়েই রিপোস্ট করা। আগামীকাল পরবর্তী পর্ব দেওয়ার ইচ্ছা আছে।
ওই পোস্টে যারা মন্তব্য করেছিলেন:-@সোহাগ তানভীর সাকিব @চাঁদগাজী @কাওসার চৌধুরী @ব্লগার প্রান্ত @তারেক ফাহিম @নিজাম উদ্দিন মন্ডল @সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই @মনিরা সুলতানা @বিএম বরকতউল্লাহ্ @মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন @রাজীব নুর @শিখা রহমান @সিগন্যাস @খায়রুল আহাসান প্রমুখ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২১ বিকাল ৫:৪৮