ভীতুর ভূত দর্শন (পর্ব-১)
গোরার আশ্বাস মত শুয়ে পড়লেও শুরুতে ঘুম আসছিল না। চার হাত-পা এককরে গুটিসুটি মেরে চোখ বন্ধ করেই শুয়েছিলাম। যদিও চোখে নিদ্রালু ভাব ছিল। একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ বালিশে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম।কেমন যেন একটা ভেজা ভেজা বলে মনে হচ্ছিল। তবে আরও কিছুক্ষণ পরে সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম।
বেশিক্ষণ তখনও ঘুমাই নি, হঠাৎ পেচ্ছাপের কটুগন্ধে ঘুম গেল ভেঙে।যদিও প্রথমে পাত্তা না দিয়ে শুয়ে ছিলাম। কিন্তু পরে আর সম্ভব হলো না। অথচ আমরা আসার সময় কোনো গন্ধ-টন্ধ পাইনি । গোরাকে ডাকলাম। ও সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসলো। মুখে কিছু না বললেও আমার শোবার জায়গাটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। প্রথমটা আমি বুঝতে পারিনি। যাইহোক কিছু না পেয়ে,ওই প্রথম মুখ খুললো।
-পেচ্ছাপের গন্ধ আসছে কোথা থেকে রে হিরণ? আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো প্যান্টে করে ফেলেছিস।
আমিও ওর সঙ্গে সমানে গলা মেলালাম। খানিকবাদে গন্ধটা মিলিয়েও গেল। আমরা আবার শুয়ে পড়লাম।
এ সময়েও অনেকক্ষণ ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকলেও ঘুম আর আসছিল না। বাইরে হাজারো ঝিঁঝিঁপোকা সহ নানা রকম পতঙ্গের ডাক কানে আসছিলো।তার মধ্যে বিভিন্ন খুট-খাট শব্দ গুলি যেন কানের পর্দায় ধাক্কা দিচ্ছিল। বালিশে একদিকে কান চেপে অপরদিকে হাত দিয়ে মাথা চেপে পড়ে রইলাম। এভাবেও পার হলো বেশ কিছু সময়। আরও অনেক পরে সবে তন্দ্রা তন্দ্রাভাব এসেছে । এমন সময় প্রচন্ড শব্দে ঝড় বইতে লাগলো। দূর থেকে বয়ে আসা শাশা শব্দে মনে হল যেন কোন উন্মত্ত ষাঁড় ছুটে আসছে। মুহূর্তেই ঝড় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো।দপ করে কেরোসিনের কুপিটি গেল নিভে। গাঢ় অন্ধকার মুহূর্তেই ঘরটিকে গ্রাস করে ফেললো। বুঝতে পারলাম চারিদিকে লন্ডভন্ড অবস্থার উপক্রম। গোরা এর মধ্যেই চুপচাপ শুয়ে ছিল। আমি চোখ খুলতেই,
-প্রচন্ড ঝড় উঠেছে রে হিরণ।
আমি বললাম,
-তাতো বুঝতে পারছি। তবে জানালাগুলো তো সব বন্ধ। তাহলে ঘরে হাওয়া ঢুকছে কেমন করে?
ও আমার কথা শুনেছে কি শোনেনি তা না ভেবে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে,গেলাম জানালাটা খুলতে।
গোড়া বাঁধা দিল
-পাগল হয়েছিস? এখন কেউ জানালা খোলে?
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি,
-খুলবো না তাহলে?
-না।খুলিস না। এমনিতে এসব এলাকায় বাঘের উপদ্রব আছে। সঙ্গে আছে সাপেরও আনাগোনা। কাজেই জানালা খোলা ঠিক হবেনা । ওর
এমন কথা শুনে আমি অনেকটা হতোদ্যম হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। ওদিকে অমন ভয়াল অন্ধকারে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। খানিকবাদে ঝড়ও থেমে গেল। পাশে থাকা বোতল থেকে দুঢোক জল খেয় আবার শুয়ে পড়লাম।
সবে তখন ঝিমুনি এসছে, এমন সময় গোরা বলে উঠলো,
- ধুৎ শালা! কোনোভূত ফুত নেই, কেবল যা তা।
ওর বলার ধরণ দেখে আমার সাহস তিড়িং করে লাফিয়ে অনেকটাই বেড়ে গেল । মনে মনে বললাম, সেটাই যেন হয় ভগবান। গলায় মা কালীর তাবিজটিকে চুমু খেয়ে ও কয়েকবার মাথায় ঠেকিয়ে, বারে বারে মা কালীকে ডাকতে লাগলাম।
-মা মাগো তুমি কোথায় আছো উদ্ধার কর মা।
শান্তি মতো মাকে ডেকে কিছুটা খুশি হয়ে, আবার ঘুমিয়ে গেছি। উল্লেখ্য আমি বরাবরি ঘুম কাতুরে । বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও আমি ঘুমাতে পারি । কাজেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লে বা চোখবন্ধ করলেই আমার ঘুম চলে আসে। কিন্তু আজ যেন সব হাতের বাইরে চলে গেল । তবে এক্ষেত্রে অবশ্য সেটাই হল। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে গেলাম।আচমকা গোরা আমাকে মারলো সজোরে এক লাথি। লাথি খেয়ে যাচ্ছিলাম চৌকি থেকে পড়ে। কোনক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে আমি একটা চাপা শব্দ করে ওঠি। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার কিয়দংশও বাইরে বার হলনা। কিন্তু কি আশ্চর্য! আমাকে লাথি মেরে গোরা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। রাগে গজরাতে গজরাতে আমি ওর গায়ে হাত রেখে সামান্য ধাক্কা দিতেই, ও টোটালি অস্বীকার করলো । উল্টে আমাকে,
-কি যা তা বলছিস? ভূলবকা বন্ধ কর, নে শুয়ে পড়।
শালা! লাথি খেলাম আমি, আর বলে কিনা ভুল বকছি...। এবার আমার রাগোতো মূর্তি দেখে কিছুটা নরম হয়ে আমার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকে,
-ভূতের নাম শুনে তুই স্বপ্ন দেখছিস বোধহয় ।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, ওর আচরণে। যদিও মুখে কিছু না বলে গোরার ধমক খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর এবারও আমার গায়ে হাতদিয়ে ডাকতেই ঘুম ভেঙে গেল।
- আমাকে লাথি মারলি কেন? তুই শালা স্বপ্নে লাথি খেয়ে আমার উপর শোধ তুললি?
আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,
- বিশ্বাস কর ভাই,আমি তোকে মারিনি। তখন এরকম লাথি আমিও খেয়েছিলাম।
এবার গোরা বিশ্বাস করলো,
-হ্যাঁ তাহলে তেনারা চলে এসেছেন বুঝি।
আমি ওর তেনারা বলার ধরন শুনে আৎকে উঠলাম।
-অ্যাঅ্যাঅ্যা.... মানে! ভূত চলে এসেছে?
ও আমাকে মুখে হাত চাপা দিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
-চুপকর শালা! চিৎকার করিসনা। পারলে আবার শুয়ে পড়।
আমি আবার শুয়ে পড়লাম। গোরা বসে ছিল। ঐ ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমার তখন মৃতপ্রায় অবস্থা। এবারে আমি মা কালীর সঙ্গে সমানে রাম রাম বলে চলেছি। চোখ বুঁজেই ছিলাম । কেন জানি মনে হল, যা হয় হোক আমি আর চোখ খুলবোই না। কিন্তু নাহা! দম ধরে থাকতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে পুরো চৌকিটা দমাদম নড়ে উঠলো। এবার আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে ভূতব্যাটাই চৌকিটা নাড়া দিচ্ছে । আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে, গোরা পাল্টা আমার গায়ে হাত দিয়ে বললো,
-ভয় পাস না, আমি আছি।যাই ঘটুক তুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক।
কিন্তু শুয়ে থাকা বললেই কি আর শুয়ে থাকা যায়? কিছুক্ষণ পরে ঢকঢক করে জল খাবার শব্দে আবার চোখ খুললাম। অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। নাহ! কারো কোনো চিহ্ন নেই । যদিও গোরার তখন বোধহয় কিছুটা ঘুম চলে এসেছে। দেখলাম কিছুটা ঝিমিয়ে আছে। ওর ঘুমানো দেখে, আমিও চোখ বন্ধ করলাম। তবে ঘুম কিছুতেই আর আসছিল না । উপরন্তু প্রায় সারারাত বারংবার এভাবে ঘুম ব্যাহত হওয়ায়, একটা অস্বস্তি শুরু হলো । তবুও চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম ।
এবার কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। হঠাৎ মনে হল বুকের উপর কে যেন বরফ চাপা দিয়েছে। ঘুমের মধ্যেই বুকের কাছে হাত দিতেই চিরিক করে উঠলো। ঠান্ডা বরফের মত কারো পায়ে আমার হাত ঠেকলো । চোখ খুলে তাকাতেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া । আমার বুকের উপর বাঁশের আড়াতে গলায় দড়ি দিয়ে কে একজন ঝুলছে । ওরে বাবারে! বলে চিৎকার করতেই গোরার ঘুম ভেঙে গেল । সেও এই দৃশ্যদেখে চিৎকার করে উঠলো । আমাদের যৌথ চিৎকারে প্রবীরের বাবা-মা হ্যারিকেন নিয়ে ছুটে এলেন। পিছন পিছন সুপর্ণাও ছুটে এল । আমরা তখন দুজনেই ভয়ে কাঁপছি। গোরাতো রীতিমত গোঁঙাতে শুরু করলো। সুপর্ণা, বাবার পিছনে গিয়ে মাথা নিচু করে খেক খেক করে হাসছে। আমি বাস্তবে কাপড়ে পটি করে ফেললাম। মাসিমা মেসোমশাই প্রবীরকে প্রচন্ড বকা দিলেন। তার কৃতকর্মের জন্য বারবার আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলেন । কিন্তু ক্ষমা যে আমাদেরই চাওয়া উচিত, তা বলার মত ভাষা তখন আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- আগামীকাল শেষ পর্ব দেওয়ার ইচ্ছা আছে।
যেহেতু রিপোস্ট; সেদিন যারা মন্তব্য করেছিলেন-@কাওসার চৌধুরী @চাঁদগাজী @নতুন নকিব @বিএম বরকতউল্লাহ @শামচুল হক @আখেনাটেন @ফরিদ আহমেদ চৌধুরী @ব্লগার প্রান্ত @গিয়াস উদ্দিন লিটন @রাজীব নুর @খায়রুল আহাসান।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ৯:০১