ভীতুর ভূত দর্শন (পর্ব-১)
ভীতুর ভূত দর্শন (পর্ব-২)
ঐ রাতে আবার ভালো করে স্নান করে আমরা প্রবীরের ঘরে শুয়ে পড়ি।এরই মধ্যে কোন এক সময় সুপর্ণাকে পাশে পেতেই জিজ্ঞেস করি,
-তোমার কি তখন ও ভাবে হাসা ঠিক হয়েছিল?
-স্যরি দাদা। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে তোমরা সত্যিই অতটা ভয় পেয়েছো। প্লিজ দাদা কিছু মনে করো না। সত্যিই তখন ওভাবে হাসাটা আমার ঠিক হয়নি।
নতুন করে শোয়ার আগে সুপর্ণা আরও দুবার ঢুঁ মেরে গেল। তবে আমার আর ওসবের প্রতি মন ছিলোনা। আতঙ্ক তখন এতটাই গ্রাস করেছে যে এই ঘরেও ভূত আসতে পারে ভেবে হ্যারিকেনের নভটা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ বাদে অনেকটা দূর থেকে মোরগের ডাক কানে এলো। আরও কিছুক্ষণ বাদে পূর্বাকাশে রক্তিম আভা দেখা দিল।
পরেরদিন সকালে আমরা তখন সবে বিছানা ছেড়ে উঠেছি। এমন সময় মাসিমা-মেসোমশাই দুজনাই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। প্রবীরের হয়ে দুজনেই আবার আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। এবার গোরা মুখ খুললো,
-ভূল তো আমাদেরই হয়েছে মাসিমা। আমরা ভূত দেখবো বলেই এখানে এসেছিলাম। আর এজন্যই মাঝরাতে আপনাদের না জানিয়ে ঘর বদল করি। তাই ক্ষমা যদি চাইতেই হয় তাহলে আমাদেরই চাওয়া উচিত।
-হ্যাঁ বল কি! তোমরা ভুত দেখবে বলে এসেছিলে? অথচ প্রবীর তো আমাকে কিছুই বলেনি?
আমাদেরকে সামনে রেখে ছেলেকে আরও একপ্রস্থ বকাবকি করলেন।
-শোনো তাহলে তোমাদেরকে আসল ঘটনাটা খুলে বলি,বলে মেসোমশাই যা বললেন....
-দুই ছেলে-মেয়ে, মা ও তোমার মাসিমাকে নিয়ে ছিল আমার সুখের সংসার।ওদের ছোটবেলায় তেমন সমস্যা না হলেও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়। সংসার চলানো তখন খুব সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছিল । গ্রামে থেকে সামান্য এক ফসলি জমির উপর নির্ভর না করে, আরও একটু ভালো কাজের আশায় আমি গুজরাতে স্বর্ণ শিল্পের কাজে গেছিলাম। প্রথম দিকে সব ঠিকঠাক চলছিল।ভেবেছিলাম ঠাকুর বুঝি এবার আমাদের প্রতি সুপ্রসন্ন হয়েছেন।কিন্তু কিছুদিন পর থেকে কেমন যেন সব গড়মিল হয়ে যায়। ঠিকমতো মজুরি না পাওয়ায় বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ওদিকে গ্রাম থেকে শুনি বাড়িতে মা ভয়ানক অসুস্থ। যার অধীনে কাজ করতাম, এবার ভাবলাম মায়ের অসুস্থতার কথা জানিয়ে যদি বকেয়া টাকাটা দেয়। কিন্তু না। না দিল টাকা বা না দিল ছুটি। টাকা বা ছুটি না মিললেও আমার ধারণা ছিল, তোমার মাসিমা যে করেই হোক সংসারটা সামলে নেবেন। এরইমধ্যে আচমকা একদিন মায়ের মৃত্যুর খবর পেলাম। কিছু টাকা পেয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ি এসে শুনলাম মা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। প্রথমে পুরোহিত মহাশয় রাজি না হলেও পরে শাস্ত্রমতে মায়ের সৎকার ও শ্রাদ্ধশান্তির ব্যবস্থা করি। সেদিন রাতে বাড়িতে লোকজন বেশি হওয়ায় কয়েকজনকে মায়ের ঘরে থাকার ব্যবস্থাও করেছিলাম। উল্লেখ্য ঐ ঘরটি আমাদের পুরানো বাড়ি। পরে আমি এই নুতন বাড়িটি করলেও মা ঐ বাড়ি ছেড়ে কোনোদিন এখানে আসেননি।যাইহোক রাত তখন দুইটা/আড়াইটা নাগাদ হঠাৎ সকলে চিৎকার করে উঠে। আমি তখনও জেগেই ছিলাম। ছুটে গিয়ে শুনলাম, ওরা মাকে ঝুলতে দেখেছে । ভাবলাম মায়ের ঘর ছিল বলেই, একটি ফোবিয়া থেকেই হয়তো এমন আশঙ্কা করছে।
এদিকে এখবর চাউর হতেই স্থানীয় যুক্তিবাদী মঞ্চের কয়েকজন, একদিন সকালে আমাদের বাড়িতে আসে।কুসংস্কার বা বুজরুকি বলে তারা ঘটনাটা বর্ননা করে এবং এমন ঘটনা অপপ্রচার না করতেও সতর্ক করে দেয়। আমার কিছুই বলতে হয়নি কিন্তু প্রতিবেশী কয়েকজন তাদেরকে চেপে ধরে, যদি কিছুই না থাকে তাহলে এখানে রাত কাটিয়ে তারা তাদের দাবির সত্যতা প্রমাণ করুক। যদিও আমার পরিবারের উপর যে ঝড় বয়ে গেছে তাতে নতুন করে এসব বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উভয় পক্ষের কাছে আমার যুক্তি ধোপে টিকলো না। যুক্তিবাদী দলের দুজন সভ্য ঐ ঘরে একদিন রাত কাটিয়ে কিছু পায়নি। তখন ভেবেছিলাম, সত্যিই তাহলে ওই ঘরে তেমন কিছু নেই। কিন্তু কয়েকদিন পর আবার একই সমস্যা দেখা দেয়। সেবার কিছু আত্মীয় কুটুম্ব ছিল। যুক্তিবাদী মঞ্চের কাছে আবার খবরটি যায়। তখন তারা দুটি দলে ভাগ হয়ে পালা করে ওখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কি আশ্চর্য! প্রথম দল যে অভিজ্ঞতায় পড়েছিল, পরের দলটিও সেই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় । তার পর থেকে এই ঘরে আমি আর কাউকে থাকতে দিই না। আজ তোমরা কেন যে আমাকে লুকালে? তবে উপরওয়ালার রক্ষে যে তোমাদের কারো তেমন কিছু হয়নি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেসোমশাই মাসীমার দিকে একবার তাকিয়ে আবারো বলতে লাগলেন,
-মায়ের মৃত্যুর কারণ নিয়ে আমি তোমার মাসিমার কাছে সত্য ঘটনাটা জানতে চেয়েছিলাম। মিনতি তার অপরাধ স্বীকার করে যে ঘটনাটা বলেছিল...
মাকে মিনতি নিয়মিত খেতে দিতনা। দিনের পর দিন মা এক হিসাবে না খেয়ে থাকতো। জলের পাত্রগুলি সব লুকিয়ে রাখতো। ঘরে সন্ধ্যাবাতি দিতোনা। মায়ের ঘর মা পরিষ্কার করতে না পারায় চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও অবহেলায় থাকতে মা একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল।
হঠাৎ উচ্চস্বরে ক্রন্দনে পরিবেশটি আরও থমথমে হয়ে যায়। লাল মেঝেতে বসে দুপায়ের মধ্যে মাথা গুঁজে মাসিমা উচ্চস্বরে বিলাপ করতে করতে বলতে লাগলেন।
-ভগবান যেন আমাকে ক্ষমা না করে।আমি যে অন্যায় করেছি তার যথাযথ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার আত্মাও শান্তি পাবে না।
মেসোমশাই একজন দায়িত্বশীল স্বামীর মতই মাসীমার মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
-শান্ত হও মিনতি। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আর নতুন করে ওসব কথা ভেবে মন খারাপ করোনা।
চূড়ান্ত নিরবতার মধ্যে আঁচল দিয়ে ঘন ঘন চোখের জল মুছতে মাসিমার হাতের নুরা পলা শাঁখার মিশ্রণে তৈরি শব্দই আমাদের সকলের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করেছিল। প্রবীর আমাদের পাশেই ছিল। দূরে দরজার কাছে সুপর্ণা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মুখ নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর মাসিমা ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন।
আমরা বুঝতে পারছি না এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি?
মাসিমা একটু শান্ত হতেই মেসোমশাই আবার বলতে লাগলেন,
-সব দোষ তোমার মাসিমার নয়, দোষ আমারও ছিল।এদিকে আমি টাকা না পাওয়াই সময়মত টাকা পাঠাতে পারিনি। ফলে সংসার চালাতে মিনতির খুব অসুবিধা হচ্ছিল। এমতাবস্থায় চূড়ান্ত অবহেলায়, দীর্ঘদিন অনাহারে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সহ্য করতে না পেরে মা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে ।
এই ঘটনার পরে আমার বন্ধু গোরা অসম্ভব রকম ভূত বিশ্বাসী হয়ে পড়লো । আর আমি তো রাতের বেলা বাইরে বের হওয়া বন্ধই করে দিলাম।গত রাতের ঘটনা এবং সকালে মেসোমশাই এর সরল স্বীকারোক্তির পর চূড়ান্ত বিষন্নতার মধ্যেই আমাদের বাকি সময়টা কেটেছিল।ফেরার সময় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে প্রবীরের সঙ্গে গল্প করতে করতে তখন বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছি। এমন সময় দূর থেকে সুপর্ণার চিৎকারে পিছন ফিরে দাঁড়ালাম। দূরে বাড়ির সামনে আমারই একটি পেন উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একবার ভাবলাম পেনটি না হয় ওর কাছেই থাক। কিন্তু প্রবীর বাঁধা দিল। ও বোনের কাছে পেন আনতে উদ্ধত হলে আমিই এবার ওকে বাঁধা দিলাম। সেকেন্ডের মধ্যে নিজেই ছুটে গেলাম পেনটি নিতে। পেনটি নেওয়ার সময় সুপর্ণার নরম হাতের স্পর্শ পেলাম। আমি সরি বলতেই, ও মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে জানালো,
-ভাগ্যিস দাদা আসেনি।
-কেন দাদা এলে কি হতো?
-সব কথা কি মুখে বলতে হয়?
সাথে আরও জানালো প্লিজ হিরণদা দাদা যেন না জানে। পেনটি আড়ালে খুলবে,বলেই সুপর্ণা জোরে পা চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
আমি গতকালের সমস্ত ঘটনা ভুলে গিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলেও পরে সে আর পিছন ফিরে তাকালো না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমিও ছুটে চলে এলাম যথাস্থানে। বোট ঘাট থেকে প্রবীর বিদায় নিতেই জল বিয়োগের নামে কিছুটা দুরে গিয়ে পেনটির মুখ খুলতেই দেখি ভিতরে কোন রিফিল নাই। একটা সাদা চিরকুট সুন্দর করে সাজানো। লেখা আছে,
-পারবেনা হিরণদা ভুতের অভিজ্ঞতাকে দূরে সরিয়ে রেখে আমাকে হৃদয়ে ধারণ করতে? যদি পারো, তাহলে তোমার আগমনের অপেক্ষায় রইলাম।
পাগলি মেয়েটি! এতঝড় তুফানের মধ্যেও হৃদয়ের এতোখানি গভীরে যে ঢুকতে পারবে তা যে আগে বুঝতে পারিনি। সেদিন ফেরার পথে প্রতিটি পদধ্বনির মধ্যেই সুপর্ণার মায়াবী চাহনি আমার হৃদয়ে যে দুন্দুভি বাজিয়েছিল তাকে অস্বীকার করি কেমনে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-রিপোস্ট। একটু ঘসা মাজা করেছি ঠিকই। সেদিন যারা মন্তব্য করেছিলেন-@চাঁদগাজী @কাওসার চৌধুরী @নীলপরী @রাজীব নুর @শামচুল হক @ব্লগার প্রান্ত @আখেনাটেন @নূর মোহাম্মদ নূরু @প্রামানিক @খায়রুল আহসান @রাজীব নুর।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ৯:০৬