নাটক ও ফিল্ম নিয়ে কনফিউশন দীর্ঘদিনের। সেই কনফিউশনের গদাই নাড়া দেয় দীপঙ্কর দীপনের ব্যাঙ্গাতক স্ট্যাটাস। নড়েচড়ে ওঠে সবাই। এই নিয়ে অনেকেই অনেক পোস্ট দিয়েছে, অনেক যুক্তি-তর্কও হয়েছে। আমিও এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। সে কারণেই পোষ্টটা লিখতে দেরী হয়ে গেল। ঘেটে যা জেনেছি তাই আপনাদের সাথে শেযার করছি। তার আগে চলুন চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে আসি।
১৮২২ সালে জোসেপ নাইসপোর নিপসের প্রথম অপরিচ্ছন্ন হলেও স্থায়ী ছবি (স্টিল পিক) তোলেন। ১৮২৪ সালে পিটার মার্ক 'The persistence of vision with respect to moving object" নাম একটি মতবাদ দেন। প্রায় সাথে-সাথেই ইউরোপীয় বিজ্ঞানীগণ উল্লেখিত মতবাদ সংক্রান্ত পরীক্ষা শুরু করেন। তাঁদের খেলনার মত পরীক্ষা-যন্ত্র এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করল যে, চোখের এক অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য যে-কোন প্রতিচ্ছবি রেটিনায় তার উপস্থিতির চাইতে এক ভগ্ন সেকেন্ড সময় বেশী অবস্থান করে। মূলত চলচ্চিত্র (সাধারণত ৩৫কিংবা১৬ মিলিমিটার বা এম.এম.)সেলুলয়েডে সারিবদ্ধভাবে সাজানো স্থিরচিত্রের সন্নিবেশ, প্রতিটি ছবি যন্ত্রের আলোর সামনে মুহূর্তের জন্য থামানো হয়। সাদা পর্দায় প্রতিচ্ছবি এবং পরমুহূর্তেই পরবর্তী ছবি একে-একে যুক্ত হয়ে এক ধাঁধার সৃষ্টি করে যা সহজেই আমাদের চোখ কে ফাঁকি দেয়। এর উপর ভিত্তি করেই শিল্প মাধ্যমের নতুন এই সৃষ্টি চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু।
১৮২২ সালে তোলা স্টিল ছবিকে চলতে সময় লেগেছে ৬৩ বছর।১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করে। তখনকার সব মুভিকেই বলা হত নিঃশব্দ চলচ্চিত্র। কারণ তখন চলচ্চিত্রে দৃশ্যের সাথে শব্দ ধারণ করা যেত না, দেখানোও যেত না। তাই চরিত্র গুলোর মুখে কোন সংলাপ থাকতো না। বলা যায় বোবার ভূমিকায় অভিনয় করত সবাই। কেবল জেনারেটরের এক ঘিয়েমি শব্দ আর দর্শক যেন বোর না হয় এজন্য আলাদা ভাবে বিভিন্ন ধরনের মিউজিক বাজানো হত। ১৮৯০ সালে বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক জর্জ মিলিয়েস এডিটিং এর পরিবর্তন আনেন। তিনি একটি মাত্র শর্টের পরিবর্তে কয়েকটি শর্টের মাধ্যমে গল্প বলা শুরু করেন। নির্মাণ করেন "সিন্ডারেলা"। নিঃশব্দ চলচ্চিত্রকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন বৃটিশ নির্মাতা জি, এস, স্মিথ।১৯০০ সালে তিনি প্রথম ক্লোজআপ ব্যবহার করেন। ১৯০৩ সালে এডিসন-কোম্পানীর পরিচালক এড উইন পোর্টার নির্মাণ করেন নিঃশব্দ যুগের প্রথম কাহিনীচিত্র 'দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি'। তার বারো বছর পড়ে নির্মিত হয় ডি. ডাব্লিউ. গ্রিফিথের 'দ্য বার্থ অফ এ নেশন'। নিঃশব্দ যুগের উল্লেখ যোগ্য চলচ্চিত্র গুলির মধ্যে 'ইনটলারেন্স গ্রিড','ব্যাটনশিপ পটেমকিন','আর্থ' এবং 'নেপোলিয়ন' অন্যতম। এই চলচিত্র গুলিতে নিঃশব্দ যুগের নির্মাণ পদ্ধতির প্রচন্ড শৈল্পিক বোধ ও আবেগের প্রমাণ পাওয়া যায়। নিঃশব্দ যুগের নির্মাতারা দৃশ্য নিয়ে খেলা করতেন।
নিঃশব্দ চলচ্চিত্রকে শব্দ পেতে অর্থাৎ চরিত্র গুলো ভাষা পেতে সময় লেগেছে ৩৪ বছর। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এ কথা সত্যি যে, যান্ত্রিক উপায়ে চলমান ছবি পর্দায় দেখানোর বেশ আগেই যান্ত্রিক উপায়ে শব্দ পুনুরুপাদন করার কৌশল আবিষ্কার হয়েছিল। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে ছবির সাথে শব্দকে একত্রিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৮৮৯ সালে এডিসন শব্দ ও চিত্র কে পাশাপাশি যুক্ত করেন। তিনি ফনোগ্রাফ ও কিনেটোস্কোপ যন্ত্র দুটি পাশাপাশি চালিয়ে দেন। এতে ইমেজের সাথে-সাথে শব্দও শোনা যেত। ১৮৯২ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে Edison, Pathe zecca, Henry Joly and Leon Gaumont ফনোগ্রাফ এবং ফিল্ম প্রজেক্টরের মধ্যে চলার ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। বিশ শতকের শেষের দিকে চূড়ান্ত সাফল্য আসে। তথ্য থেকে জানা যায় ওয়ার্নার-ভাতৃদ্বয় ১৯২৬ সালে 'ডন জুয়ান' নামের চলচ্চিত্রটির সঙ্গে শব্দ ব্যবহার করেন। ১৯২৭ সালে আংশিক সশব্দ চলচ্চিত্র 'দ্য জ্যাজ সিঙ্গার' তৈরি হয়। প্রথম পূনাঙ্গ সশব্দ চলচ্চিত্র নির্মিত হয় আমেরিকায় ১৯২৯ সালে যার নাম ছিল 'লাইটস অফ নিউইয়র্ক'।
গোড়ার দিকের সশব্দ চলচ্চিত্র নাটকের বিকল্প-পরিপূরক ভূমিকা পালন করত। নাট্যকার পরিচালক সার্গেল প্যাগনল তো বলেই বসলেন যে, আমাদের আর রাতের পর রাত শো না- করলেও চলবে-- একবার নাটকটির চলচ্চিত্রায়ন হয়ে গেলে কাছের এবং দূরের সব দর্শকই নাটকটি দেখতে পাবেন। এতে করে বারবার নাটকটি মঞ্চায়নের ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
ফরাসি পরিচালক রেনেক্লেয়ারই প্রথম চলচ্চিত্রে শব্দের প্রয়োগ নিয়ে ভাবেন। তিনি সংলাপের চেয়ে চিত্রের প্রতি বেশী জোর দেন। তাঁর মতে চলচ্চিত্রকে ফিতা-বন্ধী নাটক করে রাখাটা ঠিক না। এই ধারণা থেকে তিনি নির্মাণ করেন 'Sous les toits de paris (1929)','Le millien(1931)' and 'Anous la libarte(1931)। তিনি চলচ্চিত্র গুলোতে অনেক কম সংলাপ, কম বিজিএম, কম সঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন এই জন্য যে, যাতে তাঁর চলচ্চিত্রে যে দৃশ্যের সমাহার আছে সেগুলিকে জীবন্ত করে তোলা যায়। তিনি বলেছিলেন 'Talkie is no longer photographed theater. It is now film. Sound film.' তাঁর মতে শব্দ নয়, ইমেজ-ই পর্দাকে জীবন্ত করে তোলে। শব্দ ইমেজকে জীবন্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
১৯২৯ সালে আর্নেস্ট লুবিৎসে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। তিনি বলেন 'চলচ্চিত্র কথা বলতে শিখেছে বলে সব সময়েই কথা থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। আর চিত্রায়িত দৃশ্যের পটভূমিতে উৎপন্ন সব ধরনের শব্দকে ধারণ করতে হবে এটাও কোন কথা হতে পারে না।' এই ধারণার বশবর্তী হয়েই তিনি নির্মাণ করলেন 'দ্য লাভ প্যারেড (১৯২৯)' এবং 'মন্টি কার্লো (১৯৩১)' । সেসময় পরিচালক কিং ভিডর 'হ্যালেলুইয়া' চলচ্চিত্রটি নির্মাণে সময় আবিষ্কার করলেন যে, দৃশ্য ধারণের পর শব্দ সংযোজনে সুবিধা বেশী। পরে, পরিচালক লিউইস মিলারটোন ১৯৩০ সালে এই ধারণা বা অভিঙ্গতাটিকে 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' চলচ্চিত্রটি নির্মাণপদ্ধতিতে আরো সম্প্রসারিত করেন। ফলত চলচ্চিত্র-মাধ্যমটি শিল্প মাধ্যমে পরিণত হতে শুরু করে। তার মানে এই নয় যে, নিঃশব্দ চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যম ছিল না। নিঃশব্দ যুগে ভয়ংকর সব শিল্পত্তীর্ণ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আসলে বলা উচিত সশব্দ চলচ্চিত্র তার চিত্রভাবটি এই সময়ে অর্জন করতে থাকে।
তথ্যসূত্রঃ Sound in a silent era (চলচিত্রের শব্দকথা) বই।
উপরে বর্ণিত এই ইতিহাস থেকেই চলচ্চিত্র ও নাটকের মধ্যকার পার্থক্য পাওয়া যায়।
চলচ্চিত্র হবে সম্পূর্ণ দৃশ্য নির্ভর। সংলাপ শুধু গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আর Bgm দৃশ্য কে জীবন্ত করে তুলবে।
নাটক হবে সম্পূর্ণ সংলাপ নির্ভর। যেখানে সম্পূর্ণ গল্পই বলবে চরিত্র গুলো। আগেকার দিনের নাটক গুলো দেখলে লক্ষ্য করবেন সেখানে, যতক্ষন ক্যামেরা চলত ততক্ষন সংলাপ থাকত।
সুতরাং বলা যায় যে, চলচ্চিত্র মূলত চরিত্রায়ণ নয়, চিত্রায়ণ আর নাটক চিত্রায়ণ নয় মূলত চরিত্রায়ণের নির্ভর।
আপনারা যারা কালার গ্রেডিং আর Bgm এর উপর নির্ভর করে নাটক ও ফিল্মের মধ্যে পার্থক্য করছেন, আপনাদের জন্য সমবেদনা। কারণ, যেভাবে ওটিটি মুভি নামে ১ ঘন্টার মুভি বের হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি নাটকে সেই কালার গ্রেডিং এবং bgm পেয়ে যাবেন আপনারা। তখন পরিচালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। পরিচালক যদি বলেন নাটক, তাহলে নাটক আর পরিচালক যদি বলেন ফিল্ম তাহলে ফিল্ম।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন? চলচ্চিত্র শুরুর ইতিহাসে কোথাও কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে কিছু ছিল না। পুরোটাই ছিল আর্ট, শিল্প। চলচ্চিত্র সম্পূর্ণই একটি শিল্প মাধ্যম। অথচ, আজ বাজার এমন জিতে গেছে যে- আমরা চলচ্চিত্রের গর্ভাশয় থেকে শিল্পটাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে চলচ্চিত্র কে বাজারে বেশ্যা বানিয়েছি। বাজার টাও তুলে দিয়েছি দালালদের হাতে। শিল্পকে এক ঘরে করে ভিন্ন ধারার ছবি নাম দিয়ে সাইডে রেখে তথাকথিত কমার্শিয়াল মুভিকে মেন স্ট্রীম বলি। যখন কেউ বলে, মুভিতে মাথা খাটাবার কি আছে? শিল্প না খুঁজে বরং বিনোদন নিলেই তো হয়। কথাটা আমার কানে লাগে, ও মাগীর কাছে মনসত্য, মূল্যবোধ, মানবতা, বিবেক খুঁজো লাভ নেই- ওতো একটা বাজারে বেবুশ্যে। মজা লুটে ছেড়ে দাও।
যে কোন ধরনের বিপ্লব আসার আগে সংকটময় সময় আসে। সংকটে যারা টিকে থাকতে পারে তারাই বিপ্লবের পরিবর্তনের ফল ভোগ করে আর যারা সংকটে টিকতে পারে না তারা বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের এখন সংকটময় সময়, দেখা যাক আমরা বিপ্লবী হতে পারি না বিপর্যয়ে ধ্বংস।