সম্প্রতি মিডিয়া জগতের নাট্য ব্যাক্তি মামুনুর রশীদ বলেছেন- "আমরা একিটা রুচির দূর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মত একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও।"

তাঁর এই মন্তব্যের পরে নেটিজেনদের মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। সেই আগুন উস্কে গেছে যখন হিরো আলম এই মন্তব্যের জবাবে বলেছেন "তাঁর (মামুনুর রশীদের) মত বড় মানুষ আমাকে নিয়ে কথা বলেছেন, এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। সে নেগেটিভ বলুক আর পজেটিভ বলুক। আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই। তাঁর মত একটা লোক আমাকে চেনেন।"
হিরো আলম আরও বলেন "আমি নাকি দেশের রুচি নষ্ট করে ফেলছি। সমাজ নষ্ট করে ফেলছি। তাই যদি হয়, দেশে এত রুচিশীল মানুষ আছে, তাঁরা কেন সমাজের রুচি ফিরিয়ে আনতে পারছেন না? আজ আমার জন্য কে দায়ী? আপনারা আমাকে নিয়ে কথা বলেন। একদিন এমন লাইভ করে পৃথিবী থেকে চলে যাব। আপনারা রুচি নিয়ে থাকেন। আমি যদি আত্মাহত্যা করি, এর জন্য দায়ী থাকবেন আপনারা। সব কিছুতেই টচারিং করতেছেন।"
হিরো আলমের এমন আত্মাহত্যা মূলক বক্তব্যে নেটিজনদের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ লেগে গেছে। তর্ক-বিতর্ক হাউকাউ ক্যাচালে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন হিরো আলম যা বলেছে, ভুল বলেনি। কেন রুচিবানরা মানুষের রুচি ফেরাতে পারছে না, সেটা তাঁদের ভাবা উচিৎ। নিজেদের ব্যার্থতার দায় হিরো আলমের উপর দিলে হবে না। সে দায়ভার তাঁদেরকেই বহন করতে হবে। কিন্তু প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদ বলে গেছেন "দুই শ্রেণীর মানুষ জ্ঞানের কথা বলে। এক সাধু, দুই পাগল।" আপনারা কার কথা শুনবেন, কারটা মানবেন সেটা আপনাদের উপর।
হিরো আলমের এমন বক্তব্যের পর মামুনুর সাহেবের একটা ছবি যেখানে সেখানে শেয়ার হচ্ছে, বলা হচ্ছে তিনি নাকি মদ খেয়ে মেয়েদের গায়ে ঢলে পড়েন।

ছবিটি ভালো করে দেখলে বোঝা যায় তিনি যথেষ্ট রুচিবান (বুঝলে বুঝপাতা না বুঝলে তেজপাতা)। যদি এমনটা করেও থাকেন তবে এটা তাঁর রুচির সমস্যা নয়, চরিত্রের সমস্যা।
পাবলো পিকাসো নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন। যিনি অসংখ্য নারীদের সাথে শুয়েছেন। কথিত আছে তিনি শুধু নারীদের সাথে সঙ্গমই করেননি, তাদের নানা ভাবে অত্যাচার ও করতেন প্রতিটি পেইন্টিং করার আগে। তাজমহলের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। শাজাহান প্রতিটি শ্রমিকের হাত কেটে দিয়েছিলো। কিন্তু তাতে যেমন তাজমহলের সৌন্দর্যের কোন কমতি হয়নি, তেমনি ম্লান হয়ে যায়নি পিকাসোর আঁকা অসাধারণ সব চিত্র গুলো। আমরা যদি তাজমহল বা পিকাসোর চিত্র বহিস্কার করি, তাতে পিকাসোর বা শাজাহানের কিছু যায় আসবে না। বরং আমরা কিছু অসাধারণ সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হব। আমরা যেমন তাজমহল বা পিকাসোর চিত্র দেখে প্রসংশা করবো, ঠিক তেমনি ব্যাক্তি পিকাসোর জীবন এবং শাজাহান কে ততটাই ঘৃণা করবো।
সাকিব আল হাসান কে আমরা সবাই চিনি, অসাধারণ প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার। কিন্তু ব্যাক্তি সাকিব? একজন নীচ, হীন, অর্থলোভী, স্বার্থান্বেষী মানুষ। কিন্তু তাতে সাকিবের খেলার প্রতিভা কিন্তু ম্লান হয়ে যায় না।
হিরো আলমের প্রসঙ্গ আসলেই তার সাপোর্টাররা একটা কথাই বকে- "হিরো আলমের কেবল চেহারা খারাপ আর অশিক্ষিত বলেই তাকে হেয় করা হয়।" আপনাদের কি সত্যি এমন মনে হয়?
তাহলে অন্তত জলিল, জায়েদ খান কে কেন করা হয়। বাদ যায় না শাকিব খান ও। হাসান মাসুদ, আমাদের নাটকেই এক সময় অভিনয় করতো। এখোনো করে, তবে খুব কম। তার মত কালো তো হিরো আলম নয়। ফজলুল রহমান বাবুর চেহারাও কোন হিরো মাফিক না। যদি আমাদের পাশের দেশেই যাই, যেখানকার প্রায় সব কিছুই আমরা ফলো করি। সেখানে নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকী, কে কে মেনেন, ওম পুরি, আচ্ছা এই লোকটাকে দেখেন-

"সৌরভ শুকলা।" কালো, মোটা, টাক, বেটে। অসুন্দরের যত গুলো নমুনা আমরা বুঝি। কই এঁদের কে তো কেউ কটাক্ষ করে না। বরং যারা এঁদের কাজ দেখে, অভিনয় দেখে, যারা এঁদের ফ্যান তাদের রুচিবান বলা হয়৷কারণ এঁরা নিজেদের কাজে নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। অথচো টাইগার স্রোফ, সালমান খান ফ্যানদের ও রুচিহীন বলা হয়। তাদের কটাক্ষ করা হয়, ট্রল করা হয়।
হিরো আলম কথায় কথায় বকে "সে তার নিজের যোগত্যায় এসেছে। হিরো আলম কে কেও তৈরী করেনি।" অবশ্যই সে তার নিজের যোগত্যায় এসেছে। হিরো আলমের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হল তার "অযোগ্যতা"। হিরো আলম যে কাজে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে, সে কাজে সে সবচেয়ে বড় অযোগ্যতার নমুনা।
অবশ্য চারপাশে যখন অযোগ্য লোকের বাস, সর্বোচ্চ পদ গুলো যখন অযোগ্যরাই ধরে রেখেছে, যেখেনে একজন মন্ত্রী বলেন- ডাক্তার হতে পারিনি কিন্তু ডাক্তারদের মন্ত্রী হয়েছি। সেখানে "অযোগ্যতাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা" এবং হিরো আলম তার যোগত্যায় এসেছে৷
মামুনুর রশীদ কিন্তু হিরো আলম কে বলেননি- যে হিরো আলমের রুচি খারাপ। তিনি আমাদের বলেছেন, আমাদের রুচি খারাপ। মূলত এই কারণেই নেটিজনরা রোষে গিয়ে ফুসে উঠেছেন। আমার রুচি খারাপ সেটা তো আমি মানবো না। মূলত যারা হিরো আলমের পক্ষে বলছে তারা কিন্তু হিরো আলমের পক্ষ নিচ্ছে না, তারা তাদের নিন্ম মানের, অসুস্থ রুচিবোধ কে ডিফেন করছে।
আপনাদের রুচি কতটা খারাপ তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি ৷ হিরো আলম কে বাদ দেন। কিন্তু রিপন ভিডিও, সেফুদা, রোদ্দুর রায়? নাম করলে শেষ হবে না। একটা মেয়ের খাবারের ভিডিও আপনারা ভাইরাল করেছেন। আপনাদের রুচি এতটাই নিম্ন মানের, একটা গার্মেন্টস কর্মীর কয়লা দিয়ে দাত মাজার ছবি পর্যন্ত ভাইরাল করেছেন, যেখানে তার মুখ দিয়ে কয়লার কালি মাখানো কালো থুতু গড়িয়ে পড়ছে। আরে, আজ যদি হিরো আলম নাও থাকে কাল আপনারা শুয়োরের মত কাদা ঘেটে আর একজন টেনে তুলে আনবেন।
হিরো আলমের মত লাইম-লাইট তো দিলদার, টেলিসামাদ ও পায়নি। কাজল, হারুন কিসিঞ্জার আর ভাদাইম্যা তো আগেও ছিলো। কিন্তু আগে এদের নিয়ে কথা বলতে মানুষের রুচিতে বাধতো। কিন্তু এখন ট্রল, রোস্টের নামে সস্তার হিউমার দেখিয়ে বিনোদন বলা হয়। যত বস্তাপঁচা মুভি খুঁজে খুঁজে বের করে নিজে দেখে, সেগুলো নিয়ে রোস্টের নামে আবোলতাবোল যা ইচ্ছা বলে হিউমারের নামে যে বিনোদন বিলানো হচ্ছে হিরো আলম তার ফল। আসলে তাদের রুচি এগুলোই। নর্দমার কীট তো নর্দমায় দেখবে। কিন্তু সমস্যা হল কীট গুলো খোলস পড়ে নিজেদের এলিট দাবি করতে গিয়ে নর্দমায় বসে নর্দমা ঘেটে নর্দমার নামেই গন্ধ ছড়াচ্ছে। যেমন এই পোস্টের মাধ্যমে আমি ছড়াচ্ছি। ট্রল, রোস্টের নামে যারা এই সস্তার বিনোদন ছড়াচ্ছে, তাদের রুচি মূলত এটাই। এই উনাদের কেই পরিকল্পনা মন্ত্রী কচুরিপানা খেতে বলেছেন।
পাগলেরা পাগলামি করবেই। তাদের পাগলামি নিয়ে যত কথা বলা হবে তত পাগলামি বেড়ে যাবে। নর্দমা যত ঘাটা হবে তত গন্ধ ছড়াবে। হিরো আলম শুধু রুচির দূর্ভিক্ষ নয়, দূর্ভিক্ষের চরমতম প্রকোপ এবং এক অসুস্থ রুচির চরমতম মহামারি যে চলছে তা অনস্বীকার্য।
দেশে যত গরু-ছাগলের সংখ্যা বাড়ছে তত কাঠাল পাতা কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় উদ্দেগ্যে কিছু কাঠাল গাছ লাগানো উচিৎ কারণ আমাদের তো মাংসের বদলে কাঠাল খেতেই বলা হয়েছে।
মামুনুর রশীদ যদি হিরো আলমের নাম না নিয়ে শুধু রুচির দূর্ভক্ষের কথা বলতেন তাহলে আর তাকে এত সমালোচিত হতে হত না। বরং তিনি প্রসংসায় কুড়াতেন। নাম নিয়ে হিরো আলমের তো কোন ক্ষতি হয়ইনি, আরও পাকাপোক্ত অবস্থান হয়েছে। এরা যত নিষিদ্ধ হবে তত প্রসিদ্ধ হবে।
হিরো আলমও কথাটা ভুল বুঝেছে, হিরো আলম আসলে রুচির দূর্ভিক্ষের কারণ নয়। হিরো আলম হল ফলাফল। অনেক গুলো ফলের মধ্যে একটা ফল। কিন্তু সমস্যা হল হিরো আলম সর্বোচ্চ পর্যায় গেছে। আর যে যত উঁচুতে উঠবে সে তত বেশী চোখে পড়বে।
এদের কে আপনি বন্ধ করতে পারবেন না, আবার নিষেধ ও করতে পারবেন না। কারণ ঠিক শিল্প মাপার তো কোন রিখটার স্কেল তৈরী হয়নি। সুতারং তাতে তাদের স্বাধীনতা খর্ব হবে। তাদের যেমন এসব করার স্বাধীনতা আছে, আপনার ও তেমন এসব না দেখার স্বাধীনতা আছে। ঠিক যেমন আমার কবিতা লেখার অধিকারী আছে, আপনাদের ও না পড়ার অধিকার আছে।
সুতরাং তাদের কে তাদের কাজ করতে দিন, আপনারা আপনাদের কাজ করেন।
এদের কে নিয়ে কথা বলতে দেখলে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্'র ঐ লাইন টা মনে পড়ে যায়
"খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়
খুঁজে এবার পেয়েছ ঠিক দিক ঠিকানা।"
এরচেয়ে আমার একটা কবিতা পড়ুন-
"উপলব্ধি"
ভাবতাম আমিই সবচেয়ে বড় গাধা,
না আছে জ্ঞানের ভর আর না দুর্জন বিদ্যা
শুধুই অজ্ঞতা আর মূর্খতা।
কিন্তু একি? আশেপাশে তাকিয়ে দেখি
চারপাশে সব গরু-বাছুর, বলদ
রামছাগল আর ভেড়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১১:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



