পূর্বতন নদীয়া, তৎপর কুষ্টিয়া এবং হাল মেহেরপুর জেলা ও থানাধীনে দুদিকে কাজলা আর একদিকে ছেউটে নদী ঘিরে রেখেছে আমঝুপী গ্রাম, এই আমঝুপীর পথেই একদিন মোঘল সেনাপতি মানসিংহের বিজয় রথ ছুটেছে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবদ্দী খা-র মৃগয়ার স্মৃতিও রয়েছে এই আমঝুপীতেই।
এ গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় নদীর কিনার ঘেঁসে গড়ে উঠেছে আমঝুপী নীলকুঠি। যার পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছেউটে নদী। শত বছরের ইতিহাস ধারণ করে নীলকুঠি এখনও বর্তমান। অতীতে এ নীলকুঠি জেনারেটরের আলোয় ঝলমল করত, ঘোড়াশাল, কুকুর-শালা, হাঁস-মুরগীর খামার ছিল, ছিল ফুলের বাগানসহ ইংরেজদের জন্য আধুনিক আরাম আয়েসের সকল উপকরণ। অনেক অত্যাচার, নিপীড়নের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও বর্তমান আমঝুপী নীলকুঠি।
জনশ্রুতি আছে যে, পলাশীর পরাজয়ের নীলনকশা এ নীলকুঠিতেই রচনা হয়েছিল, এখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে ষড়যন্ত্রীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল। কুঠিয়াল কেনী-সিম্পসন-ফাগু্সন ও তাঁদের সহযোগীদের অত্যাচার- শোষণ-নির্যাতনের স্মৃতি নিয়ে আজও দাড়িয়ে আছে এই আমঝুপী নীলকুঠি। নীলচাষ রহিত হবার পর সাহেবরা এ নীলকুঠি পরিত্যাগ করে। এরপর, আমঝুপী নীল কুঠির ঘটে হাতবদল, সাহেবদের পর হাতবদল হয়ে আমঝুপী নীলকুঠি মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানির কাচারিতে পরিণত হয়। কিন্তু দেশ ভাগের পর জমিদারী উচ্ছেদের সাথে সাথে সে অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে নীলকুঠি অযত্ন আর অবহেলায় প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৮ সালের ১৩ই মে, খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের “ আমঝুপী অধিবেশন ”-এ আমঝুপী স্বীকৃতি পায় পর্যটন কেন্দ্র রূপে। তৎকালীন খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের তদারকি ও অর্থায়নে প্রায় আঠার লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয়ে এ কুঠি বাড়ির সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। বর্তমানে নীল কুঠির যে আমগাছগুলি তা ওই সময়েই লাগান। পরবর্তীতে ২৬ শে জুন, ১৯৮০ সালে দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য নীলকুঠিতে একটি পিকনিক কর্নারের উদ্ভোধন করেন তৎকালীন খুলনা বিভাগের কমিশনার জনাব মোঃ আবু হেনা।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, অযত্ন আর অবহেলায় নীল কুঠির অধিকাংশ সৌন্দর্য আজ কাল গর্ভে বিলীন, আগের মতো দর্শনার্থীর ভিড় এখন আর দেখা যায় না। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নীল কুঠির অধিকাংশ জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে, সীমানা প্রাচীরের অভাবে গরু, ছাগল যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় যা দর্শনার্থীদের বিরক্তির উদ্রেক করে। নীলকুঠির সেই বিখ্যাত ফুল বাগানটি আজ মৃতপ্রায়। অযত্ন আর অবহেলায় নীলকুঠির আজ বেহাল দশা। এখন দর্শনার্থীও নেই আগের মতন। নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নীল কুঠি ও এর সোনালী অতীত। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে নীলকুঠিকে তুলে ধরতে এর যত্ন ও সংস্কার করা একান্ত আবশ্যক। তবেই নীল কুঠি ফিরে পাবে তার পুরাতন রূপ, আবার নীলকুঠি ঝলমল করবে দর্শনার্থীদের ভিড়ে।
পরিশেষে আমঝুপী নীলকুঠীর গায়ে শ্বেত পাথরে উৎকীর্ণ লিপিতে তৎকালীন কুষ্টিয়ার সুযোগ্য জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান ভুঁইয়ার লেখা লাইনগুলো মনে পড়ে যায়, “তার ( আমঝুপী নীলকুঠি ) এই আলোকাভিসার আজ যদি ইতিহাসের সরণি বেয়ে স্বকাল ও ভাবীকালের মানুষকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে তবেই তার এই পুনঃজন্ম সার্থক হবে- সফল হবে এর ( আমঝুপী নীলকুঠি ) স্বপ্নদ্রষ্টা ও পরিকল্পকদের শ্রম ও সংকল্প”। তাই নীলকুঠির দিকে নতুন মনোযোগই পারে এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও পরিকল্পকদের শ্রম ও সংকল্প সার্থক করে নতুনভাবে স্বকাল ও ভাবীকালের মানুষকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করতে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৩২