গতকাল রাতে মা বলছিল, “বাবা আজকে তো ২৪ তারিখ, তুমি আমাদের ছেড়ে গিয়েছ আজ এক মাস”। আসলেই, ভুলে গিয়েছিলাম। আর আজ ২৫ অক্টোবর, জাপানে আমার এক মাস পূর্ণ হল। ব্যস্ততা আমাদের এইসব দিনক্ষণ মনে রাখতে দেয়না, ছেড়ে আসার কষ্টটাও হয়ত সয়ে গিয়েছে। কিন্ত, মায়েরা মনে হয় আঙুলে গুনে রাখে, কতদিন হল, ছেলেকে আবার কবে চোখের সামনে দেখবে…!!
তবে প্রযুক্তির কল্যাণে দেখা অবশ্য প্রায়ই হয়। মা’কে আসার আগে স্মার্টফোন কিনে দিয়ে এসেছিলাম। আর ভাইয়া মোটামোটি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার নামাজ পড়েই আমাকে ফোন দেয় আর বলে, “বাবা, ভিডিওটা অন করতো… তোমাকে দেখি!” । তারপর কলটা কাটার ঠিক আগে স্ক্রিনে একটা চুমু দিয়ে রাখে। ছোট ছেলেটাকে একটু ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করে হয়ত……
মায়ের চিন্তার শেষ নেই, কেমন আছে ছেলে… দূরদেশে?
আমি অবশ্য ভালই আছি। আলহামদুলিল্লাহ্। আসার পর কোন সমস্যা হয়নি। আমাকে স্টেশন থেকে রিসিভ করে ডরমে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন, পোস্টঅফিস, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স, ল্যাব, শপিং সবসময় ছায়ার মত সাথে ছিল আমার চাইনিজ সাপোর্টার মিঃ হুয়াং। গুল্লগাল্লু দেখতে এই ভদ্রলোক আমার ল্যাবেরও সিনিয়র। আর ছিল বাংলাদেশী কমিনিটি। এই ক্ষেত্রে যার কথা না বললেই নয়, সে হল শাহজাহান ভাই। এই লোকটার সাথে আগে আমার কখনো দেখা হয়নি। পরিচয়ের মাধ্যম, আমার হলের রুমমেট। এতটুকুই। কিন্তু আসার পর থেকে কি পরিমাণ সাহায্য যে করছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথম দিনই উনাকে এক জায়গার কথা বলে ভুলে অন্য জায়গায় বসে ছিলাম... । বিশাল ক্যাম্পাস ঘুরে আমাকে উনি খুজে বের করেছেন। তারপর লাঞ্চ থেকে শুরু করে পরের দুই দিনের খাবার পর্যন্ত উনার দেয়া। আর, আমি আসার আগেই আমার জন্য সাইকেল থেকে শুরু করে ফ্রাইপ্যান পর্যন্ত ম্যানেজ করে রেখেছেন। আর কি লাগে... আবার আসার একদিন পরই বাংলাদেশী তিন ভাই খুজে খুজে আমার ডরমেটরীতে এসে হাজির। আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে। অর্থাৎ, এখানে বাংলাদেশী ভাইদের সাহায্য মাত্র এক ম্যাসেজ দূরত্বে (এখনো সিম নেইনি)।
আসার পর অরিয়েন্টেশন হয়েছে তিনটা। ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি আর স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের। এখানের শিক্ষা ব্যবস্থা, জাপানি নিয়ম কানুন আর কালচার সম্পর্কে। আমাদের দেশ থেকে অনেক আলাদা। সব কিছুরই আইন আছে বটে, কিন্তু গুছানো, ঝামেলাহীন। আর কারো কাছে কিছু জানতে চাইলে, ও তার ভাঙ্গা ইংরেজীতে যতক্ষণ আপনাকে বুঝাতে বা সাহায্য করতে না পারবে ততক্ষণ ক্ষান্ত হবে না।
এবার আসি আমার ল্যাব সম্পর্কে। প্রথম দিন যখন প্রফেসরের সাথে দেখা করতে গেলাম, অনেকটা ভয়ে ছিলাম। কেমন জানি হয়। উনার সাথে কথা বলে এক নিমিষেই আমার সব ভয় দুর হয়ে গেল। অমায়িক একজন মানুষ। সদা হাস্যোজ্জল। দেখা হতেই আমাকে বলে... Mamudurrr… welcome,,, I was eagerly waiting for you, its been long we know each other। since 2016, right?? ওয়েলকাম পার্টিতে জিজ্ঞেস করে, অ্যালকোহল অর নো অ্যালকোহল? তারপর নিজ হাতে জুস সারভ করে। বিজনেস ট্রিপে গেলে ল্যাবের সবার জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসে। বাকিটা আল্লাহ জানে, ল্যাবের কাজতো এখনো শুরু করিনি। আমার কোন ক্লাসও নেই, শুধু জাপানিজ ভাষার ক্লাস। বিরক্তির ব্যাপার হল, ওদের অক্ষর তিন ধরণের, হিরাগানা, কাতাকানা আর কাঞ্জি। কাঞ্জির আবার আছে জাপানে ব্যবহৃত ৩০০০ শব্দ!! কৃতিত্বের সাথে ফেইল করব আশা করি। মজার ব্যাপার হল, ওদের বলার ধরণ তিন রকম। চলিত, ভদ্র আর অতিভদ্র ধরণ। এত ভদ্রতা যে ওরা কই পায়!!
তবে, এখানের সবচেয়ে ভাল বিষয় হল পরিবেশ। শান্ত, সুন্দর, গুছানো আর জ্যাম ছাড়া রাস্তা। রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই। লাল হলুদ আর সবুজ বাতিতেই যদি সব হয়, পুলিশের আর কি দরকার? রাস্তার পাশে কারা যেন ফুলের বাগান করে যায়, অদ্ভুত সব সুন্দর ফুল।
এখন অবশ্য কাঙ্ক্ষিত ফল সিজন চলছে। ক্যাম্পাস অসম্ভব সুন্দর এখন। মাঝে মধ্যে সাইকেল নিয়ে চক্কর দেই, হোক্কাইডোর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র, এই ক্যাম্পাস। অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ এখনো হয় নাই। তবে, দেখতে যাব নিশ্চয়ই... অতি শীগ্রই...
চলবে..
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪৯