প্রায় ৭০ শতাংশ পাহাড়ী অঞ্চল সমৃদ্ধ দেশ জাপান। আসার আগ থেকেই জানতাম যে, হোক্কাইডোর সাপ্পরো শহরের (আমি যেখানে থাকি) চারপাশেই পাহাড়। যাবার জন্য মনটা উসখুস করছিল অনেকদিন। অবশেষে গত মাসের ২৬ অক্টোবর সাইকেল নিয়ে একাই রউনা হয়ে যাই মাউন্ট আশিহিয়ামা মেমোরিয়াল পার্কের উদ্দেশ্যে। ভরসা তখন গুগল ম্যাপ। অনেকটা পথ যাবার পর পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আর সাইকেল চালিয়ে উঠতে পারছিলাম নাহ। শেষে, এক বাড়ির উঠানে নিশ্চিন্তে সাইকেল রেখে বাকি পথ পায়ে হেটে যেতে হল। এখানকার বাড়িগুলো, একেবারেই শহরের বাড়ির মত না। সাজানো-গুছানো ডুপ্লেক্স টাইপ। সামনের অংশে ফুলের বাগান অথবা বাহারি রঙের গাছের সমাহার। এককথায়, ছবির মত সুন্দর। খুব একটা মানুষজন চোখে পড়ল নাহ। দেখে মনে হল হয়ত অবসর কাটানোর জন্য বানানো। যাইহোক, আরও প্রায় ১ কিলোমিটারের মত হাটার পর পাওয়া গেল আশিহিয়ামা মেমোরিয়াল পার্ক। অদ্ভুত সুন্দর একটি এলাকা। পাহাড়ের উপরে পা দুলিয়ে বসার সারিসারি জায়গা, ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরের মত কনসার্ট করার উন্মুক্ত মঞ্চ। আর, দৃষ্টি প্রসারিত করলেই পুরো সাপ্পরো শহরটা এক নিমিষেই আপনার চোখের ফ্রেমে চলে আসবে। মনে হচ্ছিল যেন, আকাশ থেকে দেখছি শহরটাকে। বসে থাকলাম অনেকটা সময়। একা, নির্জনে। জাপানীদের দেখলাম। এখানে আসা বেশীরভাগ মানুষ হয় নিজের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে নয়ত বাবা-মাকে। বয়সে তরুণদের খুব একটা চোখে পড়ল নাহ। দুই বুড়োকে দেখলাম। হুইল-চেয়ারে বসা বাবা আর তার ছেলে, যাদের বয়স আনুমানিক ৯০ এবং ৬০ হবে হয়ত। বাবাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে পাহাড়ের উপরে। ছেলে মনে হয় হাঁপিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর বলল, এখন যাব বাবা? বাবা আরও কিছুক্ষণ থাকবে বলে জানাল। বৃদ্ধ বাবা প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার পাশাপাশি কিছু ছবি তুলল। তার মিনিট বিশেক পর বাবার নির্দেশে তাদের প্রস্থান। পিছনে বসে আমি আমাদের দেশের অবস্থা চিন্তা করছিলাম। আমরা কি বৃদ্ধ বাবা-মা'কে নিয়ে যাই কোথাও? কখনো? আমার খুব ইচ্ছে ছিল মাকে নিয়ে সেইন্ট-মারটিনে সূর্যাস্ত দেখব; দেখা হয়নি। হবে কিনা তাও জানি নাহ। ওইদিনের পর ইচ্ছাটা কেন যেন আরও প্রকট হয়েছে।
পরদিন মসজিদে গিয়ে তওফিক ভাইয়ের সাথে দেখা। উনার বাসায় যাবার আমন্ত্রণ জানান কফি খেতে খেতে। কিভাবে মানা করি বলেন!! বিদেশের মাটিতে প্রথম আমন্ত্রণ। পরদিন সন্ধ্যায়, সজল ভাইয়ের গাড়িতে করে আমি, ইমাম আর রাশেদ ভাই হাজির উনার বাসায়। গিয়ে দেখি ভাবি বিশাল আয়োজন করে বসে আছেন, আমরাসহ আরও তিন দেশের মেহমান আসবেন বলে। তওফিক ভাইয়ের বন্ধু সবই (কিন্তু, অন্তত ৩০/৪০ বছর বড় হবেন)। জম্পেস আড্ডা হল। সাথে ভুরিভোজ। খাবার পর, আবার আড্ডায় বসলাম। ৮০+ বয়স্ক জার্মান ভদ্রলোকের সাথে; যিনি কিনা গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন জাপানে। রাশেদ ভাইয়ের করা জার্মানিতে ফিরে যাওয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক অনেক কথা বললেন। যার সারমর্ম হচ্ছে... “I don’t feel like home there anymore, when I come back here, it feels like my home.” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখা ঐ ভদ্রলোকের মতে, উনি জার্মানির কয়েকটা জেনারেশন মিস করে ফেলেছেন। তাই এই অবস্থা...। মানুষের জীবন সত্যিই অদ্ভুত...!! নিজ জন্মস্থান, নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশকেও হোম মনে হতে পারে!! জানা ছিল নাহ।
তার পরের সপ্তাহে তাওফিক ভাইয়ের মেসেজ, “সামনের সপ্তাহে ফ্রী থেকো, আমি জানাব”। ব্যাস, রবিবার আবারো চেপে বসলাম সজল ভাইয়ের গাড়িতে। তিন গাড়িতে বিশাল বহর। পথিমধ্যে নাস্তা। তারপর মাউন্ট ইয়ুতই আর ফুকুদাশি পার্ক। ইয়ুতই উপত্যকার সুবিশাল সবজি খেতগুলো দেখতে গিয়ে আমি, ইমাম আর জুল্কারনাইন ভাই বড্ড দেরি করে ফেলেছিলাম। অগত্যা, আমাদের না খেয়েই রউনা দিতে হল পরবর্তী গন্তব্যে। হহেইকিয় ড্যাম। পাহাড়ের উপর থেকে মনুষ্য ও প্রকৃতি সৃষ্ট দুই স্থাপনার মিলবন্ধন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। অতঃপর, সবাই মিলে দুপুরের লাঞ্চ। একসাথে ছবি তোলা আর তারপর ঘরের পথ ধরা। বিদেশের মাটিতে প্রথম দিনব্যাপী ট্রিপের সফল সমাপ্তি।
গত সপ্তাহে দুইদিন ব্যাপি জয়েন্ট কনফারেন্সে ল্যাবের সবার সাথে গেলাম শিকতসু ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত এক রিসোর্টে। শিকতসু লেকের পারে দাড়িয়ে দূরের পাহাড়ের উপর জমা বরফে সকালের রোঁদের বিচ্ছুরণ মনে থাকবে অনেকদিন। বরফাচ্ছন্ন শীতের আগমনের আগে এটাই ছিল হয়ত শেষ ট্রিপ। ইতোমধ্যেই, স্নোফল শুরু হয়ে গিয়েছে। নিয়মিত বিরতিতে। বেসম্ভব ঠাণ্ডার পর্যায়ে যায়নি অবশ্য।
দিন গুনছি, আসন্ন মন খারাপ করা ঘরবন্দি শীতকালের...
পুনশ্চঃ আমার চাইনিজ সাপোর্টারের মতে, চাইনিজ এবং জাপানিজ মানুষজন তাদের পূর্বপুরুষ বা পিতা মাতাকে অনেক সম্মান করে, Sometimes even more than GOD। তাই হয়ত সবচেয়ে বেশি গড় আয়ুর দেশ জাপানে বৃদ্ধরা এতটা সাচ্ছন্দে তাদের জীবন কাটাতে পারছে। হহেইকিয় ড্যাম পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা রাস্তা মাউন্ট ইয়ুতইয়ে আমরা নিচে কি আছে খুঁজে দেখছেন দুই বিজ্ঞানী মাউন্ট ইয়ুতই পাহাড়ি বাড়ির সামনের অদ্ভুত সুন্দর ফুল মাউন্ট আশিহিয়ামা মেমোরিয়াল পার্ক থেকে সাপ্পরো শহর অবকাশ যাপনের জন্য ছোট্ট বাড়ি পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে শিকতসু লেকের পারে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৪৭