আমি বোধহয় জাপানে যাপিত জীবনের গত পর্বগুলোতে শুধুমাত্র আংশিক এবং ইতিবাচক দিকগুলোই বর্ণনা করতে পেরেছি। বন্ধুদের কথায় বা অন্যদের মেসেজে অন্তত তাই মনে হয়। সবাই ভাবে, এখানে জীবন কত সুন্দর আর সহজ। কিন্তু, জীবনের অন্য সমীকরণগুলোও যে মিলিয়ে দেখা উচিত...
আমি বরাবরই একটু পরিবার- অনুরক্ত ছেলে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ বরিশালের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হবার আগ পর্যন্ত কখনো পুরো এক সপ্তাহ পরিবার থেকে দূরে থেকেছি বলে মনে পড়ে না। সেই আমি দেশের বাইরে দিব্যি চার মাস কাটিয়ে দিয়েছি। বরিশালে থাকার সময়, বৃহস্পতিবার তাড়াহুড়ায় কাজ শেষ করে দুপুর তিনটার গ্রিনলাইন ওয়াটার বাস ধরতাম। ঢাকায় যাব বলে। কলিগরা বলত, এত অস্থির হবার কারণ কি, ধীরে সুস্থে রাতের লঞ্চে যাও। জবাবে বলতাম... যত রাতই হোক, বাসায় তো পৌঁছাব। আর শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে যখন দেখি, আমি বাসায়, সেটা এক স্বর্গীয় অনুভুতি। আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। শুনে কলিগরা হাসত। আর এখন... ছুটির দিনে চোখ খুলে যখন নিজেকে ডরমের রুমে আবিষ্কার করি, বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। উঠেইবা কি করব। বরফাচ্ছন্ন চারদিক, কোথাও যাবার অবস্থা নেই। বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে ল্যাবে গিয়ে বসে থাকি।
মানুষজন বলে, কত ভাল আছ, সুন্দর দেশে থাকছ, ঘুরে বেড়াচ্ছ, আর কি চাই। কিন্তু ভাই... আমার দরজায় নক পড়ে না কতদিন জানেন? আর, শুধুমাত্র কারো সাথে বাংলায় কথা বলার জন্য, এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকতে হয়। কবে শুক্রবার আসবে, মসজিদে যাব আর দেশি কোন ভাইকে ঈদ মোবারক বলে জড়িয়ে ধরে বাংলায় কথা বলব।
বিদেশ জীবনের অতৃপ্তি গুলো বলে শেষ করা যাবে না। ছোট ভাতিজা-ভাতিজিকে প্রতিবছরের মত এবার শীতের কাপড় কিনে দিতে পারিনি। ওরা এখন আর মন খুলে কোন আবদারও করে নাহ, জানে ওদের ছোট বাবা অনেক দূরে থাকে। আসতে দেরি হবে।
কাজিনের বিয়ে, পরিবারে উৎসবের আমেজ। ছোট মামা’রাও আসছে কানাডা থেকে ৩ বছর পর। ফেসবুক গ্রুপ খুলে গায়ে হলুদের পাঞ্জাবীর মাপ নেয়া হচ্ছে। শুধু আমি আর সিয়াম (ও কানাডায় থাকে) নেই।
আপনজন ছেড়ে থাকার কষ্ট যে শুধু আমাদেরই হয় তা কিন্তু না। দেশে যারা আছে, তারাও প্রতিনিয়ত অনুভব করে। ঐদিন আব্বার সাথে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করলাম, নাস্তা করেছে কিনা? বললেন, পিঠা খেয়েছি। শুনে আম্মা অন্য ঘর থেকে চিৎকার করে বলল... পিয়াসের মন খারাপ হবে দেখে আমি বলি নাই, আর তুমি সেটাই বলে দিলা!! ছেলেকে ছাড়া পিঠা বানানোও যে মায়ের কাছে অপরাধ মনে হয়।
কিন্তু মা, পিঠাতো আমিও খাই। শুধু তোমার হাতেরটা খাওয়া হয় নাহ। এই যেমন, বছর শেষের ছুটিতে সাপ্পরোর প্রতি বছরের রীতি অনুযায়ী পার্টি হল। হাঁস আর পিঠা উৎসব। অনুষ্ঠানের ধরণটাও বেশ মজার। আমরা ছেলেরা সবাই এক বাসায় মিলে হাঁস রান্না করেছি। আর ভাবিরা অন্য বাসায় পিঠা। তারপর সবাই এক বাসায় জড়ো হয়ে আড্ডা দিতে দিতে উদর পূর্তি। মধ্যরাত অব্দি আড্ডা।
বছরের শুরুতে আবার তাওফিক ভাই, ইশরাক ভাই, সজল ভাইদের সাথে গিয়েছিলাম মাকোমানাই তাকিনো সিমেট্রি আর তাকিনো সুযুরান হিলসাইড পার্কে। ইস্টার্ন আইল্যান্ডের মোয়াইদের অদ্ভুদ সুন্দর রেপ্লিকা বানিয়েছে জাপানিজরা। সাথে রয়েছে হিল অব বুদ্ধা, বরফাচ্ছাদিত থাকার কারণে যা দেখা সম্ভব হয়নি। শেষমেশ, স্কিং করার স্থানে টিউব স্লাইডিং করে ফিরে এসেছি।
আবার, নতুন বছরের শুরুতেই অনুষদের ইন্টারন্যাশনাল নিউ ইয়ার পার্টিতে ভাইদের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশী কমিউনিটির কনভেয়র হিসেবে কাজ করেছি। দেশকে উপস্থাপন করতে অন্য অনুষদ থেকেও বাংলাদেশী ভাইরা যোগ দিয়েছিলেন আমাদের সাথে।
সব কিছু মিলিয়ে বলতেই হয়... আলহামদুলিল্লাহ্, ভাল আছি। কিছু কষ্টতো থাকবেই। ভাল-মন্দ মিলিয়েই যাপন করছি জীবনের জাপানি অধ্যায়। যার অনেকটা সময় এখন কেটে যায় ল্যাবে; ট্রায়াল অ্যান্ড ইরোরের বৃত্তে...।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৩৭