একটি দেশের কথা চিন্তা করুন, দ্বীপ রাষ্ট্র। যার অন্য কোন দেশের সাথে সীমান্ত নেই। নেই কোন তেল, গ্যাস বা সোনার খনি। পর্যাপ্ত সমতল ভুমি বা উপযুক্ত আবহাওয়াও নেই, যাতে অন্তত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আবার যাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে গিয়েছে। তারপরও ঐ দেশটা এখনো পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ভাবছেন কিভাবে সম্ভব??!! কারণ, দেশটা যে জাপান। তাদের মূল কৌশল হল “সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার” আর “যার যে দায়িত্ব তা সুচারুরূপে পালন”।
আমি জাপানের যেখানটায় থাকি, প্রায় ৪-৫ মাস তুষারপাত হয়। যেহেতু কৃষিপ্রধান অঞ্চল, কাজও বন্ধ। কিন্তু তাতে কি? এই কর্মঠ জাতি’তো আর বসে থাকতে পারে নাহ। এই সময়টা যা পাওয়া যায় টা নিয়েই কাজ চলে। স্নো আছে পর্যাপ্ত। তাই নিয়েই ওদের জমজমাট পর্যটন ব্যবসা। বছরের এ সময়টা তাদের স্নো ফেস্টিভাল চলে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসে প্রচুর পর্যটক, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে। কারণ এসময় যে তাদের দেশে প্রচণ্ড গরম। আর, এই বিশাল পর্যটকদের জন্য রয়েছে হরেক আয়োজন। অদরি পার্কে স্নোয়ের তৈরি ভাস্কর্য বানানোর প্রতিযোগিতা হয়। হরেক রকম অদ্ভুত সুন্দর ভাস্কর্য। বরফের দলা দিয়েও যে এত সুন্দর করে ভাস্কর্য বানানো যায়, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সাথে থাকে নানা কনসার্ট আর গেমস শো। পাহাড়ের উপরে রিসোর্টগুলোতে চলে স্কিইং প্রতিযোগিতা। মাটির নিচে বানানো সাবওয়ে দিয়ে হাটার সময়ও আপনাকে থমকে দাড়াতে হবে। কারণ, পাশেই দেখবেন ওদের ঐতিহ্যবাহী “আইনু” সভ্যতার প্রদর্শন অথবা ম্যাজিক শো চলছে।
ওদের আরেকটি শহরে চলে স্নো-কেন্ডেল উৎসব। যথারীতি তাওফিক-সজল ভাইদের সাথে গিয়েছিলাম ঘুরতে। লেকের পাড়ে সারি সারি স্নোয়ের মাঝে জ্বলছে মোমবাতি। জ্বলন্ত মোমবাতির তাপ, তবুও বরফ গলার কোন নাম নেই। হিমশীতল বাতাসে লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে হাতে এক কাপ কফি নিয়ে উপভোগ করুন... নানান ধরণের স্নো-কেন্ডেল। এখানেও বিদেশি পর্যটকের ভীর।
ক’দিন আগেই ল্যাবের নমুনা সংগ্রহে গিয়েছিলাম এক পোল্ট্রি ফার্মে। প্রায় ২ লক্ষ মুরগীর খামারে কাজ করছে ২ থেকে ৩ জন মানুষ। যাদের কাজ আবার শুধু পর্যবেক্ষণ। সব কাজই হচ্ছে মেশিন দিয়ে। খাবার দেয়া থেকে শুরু করে ডিম প্যকেজিং, সবই মেশিন করে থাকে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার।
তবে জাপানিজদের একটা জিনিস খুব চমকপ্রদ। তা হল ওরা সামাজিক সম্প্রীতিকে ব্যক্তিগত সুনাম বা উন্নতির থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা সমন্বিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাসী। যা তথাকথিত পুঁজিবাদ থেকে অনেকটা আলাদা। আপনাকে উন্নতি করতে হলে অন্যকে হারাতে হবে, এটা তারা বিশ্বাস করে নাহ। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ শিক্ষাটা মনে হয় খুব জরুরী, যেখানে প্রতিনিয়তই অতিধনীর সংখ্যা বাড়ছে।
অন্যদিকে, আমাদের জীবনের বরফাচ্ছন্ন এ সময়টায় খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমাদের ঘরবন্দি জীবনে প্রায়ই দাওয়াত খেতে যাওয়া হয়। পুরো বাঙ্গালী স্টাইল। একটু রাত করে যাওয়া আর মধ্যরাত পর্যন্ত খেতে খেতে আড্ডা। আড্ডার গল্পের কোন নির্দিষ্ট শিরোনাম থাকে না। গল্পগুলো দেশের রাজনীতি থেকে শুরু হয়ে মেডিকেল ল্যাবের ভূতের গল্পে গিয়েও শেষ হয়।
এর মাঝে আবার বিদেশের মাটিতে স্টুডেন্ট সেন্টারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছি। আমাদের আমন্ত্রণে প্রায় পাঁচটা দেশের শিক্ষার্থী তাদের নিজেদের মাতৃভাষার উপর প্রেজেন্টেশান দিয়েছে। দেখে মনে হল মাতৃভাষাটা সবার জন্যই আবেগের। কারো কারো সেটা আবার পিতৃভাষাও বটে...। গর্ব করেই বলেছি আমরা, মাতৃভাষা নিয়ে অহংকার করাটা সারাবিশ্বকে আমাদের পূর্বপুরুষ’রাই শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। যাদের জন্যই পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস...
সর্বোপরি, করোনা আক্রান্ত সময়ে এখনো বেশ ভাল আছি।
...জাপানের স্টেট অব ইমারজেন্সি থেকে। (০৮/০৩/২০২০)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২০ দুপুর ১:৫১