শখ করে গত সেমিস্টারে দুটো কোর্স নিয়েছিলাম। জাপানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনা কেমন তা জানার জন্য। দুঃখের বিষয়, করোনার কারণে প্রথাগত ক্লাসরুমে লেকচার গ্রহন করতে পারিনি। পুরো বিশ্বের মত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ও হেঁটেছে অনলাইন ক্লাসের পথে। তবে যা দেখেছি ও শিখেছি, তা অনন্য…।
একটু জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর প্রেক্ষাপট বলে নেয়া উচিত। জাপানের ৮৮.৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত নয়। তাই মাত্র সাতটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়। যার ফলে ভর্তি পরীক্ষার চাপ এখানে আমাদের দেশ থেকে কোন অংশে কম নয়। তিন ধাপে সম্পন্ন হয় এখানকার ভর্তি পরীক্ষা। যার মাধ্যমে সেরা মেধাবীরাই শুধুমাত্র ভর্তি হতে পারে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলস্বরূপ, শিক্ষা ও ক্লাস কার্যক্রম কেমন হবে টা সহজেই অনুমেয়। ভর্তি হবার পর থেকে প্রতিটি ধাপে চলে মানোন্নয়নের চেষ্টা। আমি আসার কিছুদিন পরেই প্রফেসর তার রুমে যাবার পর হঠাৎ হাতে অংকের প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে বলে, দেখি তোমার গাণিতিক জ্ঞান কেমন? আমার সামনে বসে উত্তর দাও। এমনি যাচাই চলে প্রতি পদে পদে।
রিলাকজেশন এরিয়া
আমি এক ক্রেডিট করে দুটো কোর্স নিয়েছিলাম। শুনে অবাক হবেন যে, এই দুটো কোর্স শেষ করতে আমাকে মোট ১৪ জন প্রফেসরের ক্লাস করতে হয়েছে। অর্থাৎ, দুই ক্রেডিটের জ্ঞান অর্জনে আমাকে ১৪ জন প্রফেসর সাহায্য করেছেন, যারা ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এক প্রফেসর ক্লাস শুরু করেছিলেন একটি প্রশ্ন দিয়ে। কেন জাপান বা পুরো পৃথিবীর জন্য আফ্রিকায় বিনিয়োগ জরুরী? আর শেষে, উনার আফ্রিকা কেন্দ্রিক গবেষণার উদাহরণ দিয়ে ওখানটায় অনাবিষ্কৃত দিকগুলোর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। আরেক প্রফেসর পাহাড়ি অনুর্বর জমিতে বিশেষ ধরণের ঘাস চাষের মাধ্যমে জৈবজ্বালানীর অভাব পূরণের কথা বললেন। শুধু তাই নাহ, কোন প্রজাতির ঘাস কোন মাটি বা আবহাওয়ায় ভাল জন্মাবে তার গবেষণালব্ধ ফলাফল, আর পাশাপাশি এর ব্যবসা স্থাপন মডেলও দিলেন। আরেক অধ্যাপক মহামারীর পর তা থেকে উত্তরণের ঐতিহাসিক পটভূমি গুলো ব্যাখ্যা করে বুঝালেন। এমনি বিচিত্র তাদের পাঠ্যক্রম।
ক্লাসের গ্রেডিং হবে প্রত্যেকটা লেকচারের পর জমা দেয়া প্রতিবেদনের উপর। উনাদের মতে শেখাটা গুরুত্বপূর্ণ, পরীক্ষা নয়। তবে প্রত্যেক প্রতিবেদন তৈরির আগে যেভাবে পড়তে হয়েছে, তা পরীক্ষা থেকে ঢের বেশি। প্রফেসরদের মধ্যে একজন ছিলেন স্বয়ং আমার সুপারভাইজার, যিনি প্রায়ই আমাকে উনার লেকচার দেখে দিতে বলেন। যথারীতি আমি উনার যেই লেকচার এটেন্ড করেছি, ওইটাও আগেই সংশোধন করেছিলাম। জানিনা কেমন গ্রেড পাব, তবে ওইটাই আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে। কারণ, লেকচার দেয়া যতটা কঠিন, বুঝে আবার প্রতিবেদন তৈরি করা তার থেকে অনেক বেশি কঠিন।
যাইহোক, এর মাঝেই চলছে আমার গবেষণা কার্যক্রম। প্রতিনিয়ত যা কঠিনতর হচ্ছে। ট্রায়াল অ্যান্ড ইরোরের চলমান বৃত্ত। এক সপ্তাহে ভাল তো পরের সপ্তাহেই খারাপ।
অন্যদিকে, করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হবার পর আবার শুরু হয়েছে আমাদের ঘুরাঘুরি। প্রথম ট্রিপ ছিল প্রায় আশি কিলোমিটার দূরের সুনাগায়া অয়েসিস পার্ক। ফেরার পথে গেলাম শিনোতসু পার্কে। ক্যাম্পিং করা আর মাছ ধরার যথার্থ স্থান। পরিকল্পনা আছে আবার যাবার। কিছুদিন পর দল বেঁধে আবার গিয়েছি আসারি আর ড্রিম বীচে। জাপানে এসে প্রথম সমুদ্র দর্শন। একটি স্বচ্ছ পানির পাথুরে বীচ আর অন্যটা বালিকাময়। আমাদের দেশের মতই বীচ, কিন্তু ঢেউ নেই তেমন। ঐখানে গিয়ে তাবু খাটিয়ে বারবিকিউ করেছি। তারপর জাপানিজ বিঙ্গো খেলে সূর্যাস্তের আগেই ফেরত এসেছি।
এমতাবস্থায়, জাপানে ইতোমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়ে গিয়েছে। আক্রান্তের হার প্রথম বাবের থেকেও বেশি। যা অব্যাহত থাকলে হয়ত আবার যাপন করতে হবে “ঘরবন্দী জীবন”...
সমুদ্রতটে বার-বি-কিউ
পার্ক
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:৩২