somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অভিমানের দেয়াল

১৯ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।
অ্যাকসিডেন্ট করে তারিনের বাম পা গেলো ভেঙ্গে। তার কিছু দিন পর পুরুষ জাতির উপর ওর সমস্ত বিশ্বাসও ভেঙ্গে গেলো।
বিয়ের বাজার করে ফিরছিল সেদিন। দুদিন পরেই গায়ে হলুদ। আচমকা রিকশার চাকা খুলে একপাশ কাত হয়ে গেলো। হাত ভর্তি প্যাকেট সহ তারিন পড়ল রাস্তায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা লেগুনা চলে গেলো বাম পায়ের উপর দিয়ে। পরদিনই পা টা কেটে ফেলতে হয়। অপারেশন শেষে জ্ঞান ফেরার পর নিজের কাটা পায়ের বেদনা ভুলিয়ে দেয় আরো বড় একটা শোক সংবাদে। পা হারানোর অপরাধে বর পক্ষ বিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছে।
অদ্ভুত লাগে তারিনের। যার সাথে বিয়ে, তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই কথা হতো। ভালোই লেগেছিল ছেলেটাকে। কত কথাই না বলত ছেলেটা। ভবিষ্যতের কত পরিকল্পনাই করেছিল দুজনে মিলে। সেই ছেলে কি অবলীলায়ই না তাকে ভুলে গেলো।
কয়েকদিন আগেও যে বাড়িতে উৎসবের রঙে ঝলমলে ছিল, সে বাড়ির লোকেরা আজ হাসতেও ভুলে গেছে। সব কিছুর জন্যে নিজেকেই দোষী মনে হয় তারিনের। শোকে স্তব্ধ হয়ে কাদতেও ভুলে গেছে।
তারিনের শোকে নতুন মাত্রা চড়ায় তার বাবার আচরণ। ভদ্রলোকের আচরণে মনে হচ্ছে অ্যাকসিডেন্ট আর বিয়ে ভাঙ্গা দুটোই তারিনের দোষ। হাসপাতালে কিছু করেননি কিন্তু বাসায় ফেরার পর থেকেই নানাভাবে ঘুরায়ে পেচায়ে তারিনকেই সব বিষয়ে দায়ী করে চলেছেন। এমনকি সুযোগ পেলে সরাসরি খোটা দিতেও ছাড়েন না।
তারিন প্রতিবাদ করে না। শুধু তারিনের মা কাঁদেন। পাঁচটা মেয়ের জন্ম দিয়ে এমনিতেই তিনি সারাক্ষণ তারিনের বাবার কাছে অপরাধবোধে ভোগেন। মেয়েরা আর বাবা যেন চিরশত্রু। তার মাঝখানে দুপক্ষেরই কচকচানিতে জীবনটা তার ফালাফালা হয়ে গেছে। তার উপর বড় মেয়ের বিয়ে না হতেই এতো বড় সর্বনাশ হয়ে গেলো, কান্না ছাড়া কিই বা করার আছে তার।
এরপর থেকেই দুনিয়া এবং পুরুষ জাতি দুটোর প্রতিই চরম বিতৃষ্ণায় মন ভরে গেছে তারিনের। সামর্থ থাকলে দূরে কোথাও পালিয়ে যেত। কিন্তু বিছানা থেকেই তো নামতে পারে না। ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ। বান্ধবীরা আগে দেখতে আসতো প্রায়ই। এখন তা ও কমে গেছে একেবারে। নিজের রুম আর বারান্দা এতেই আটকে গেছে জীবন। টিভি রুমে বাবা থাকে বলে সেখানেও যাওয়া হয় না।
সে কারণেই আবার যখন বিয়ের প্রস্তাব এলো, শুধুমাত্র এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে হাপ ছাড়ার জন্যেই তারিন রাজি হয়ে গেলো। ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত চুলাতেই ঝাপ দিচ্ছে জানে, তাও সিদ্ধ হওয়ার চেয়ে পুড়ে মরাই কেন যেন শ্রেয় মনে হলো ওর কাছে। অন্তত মায়ের কান্না আর বাবার খোচা তো আর সইতে হবে না।
তারিনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে জাহিদ। সদ্য পাশ করা এম বি বি এস ডাক্তার। ডাক্তার হিসাবে আরো অনেক কোয়ালিফাইড মেয়ে ও বিয়ে করতে পারত। কিন্তু শুরু থেকেই জাহিদের চিন্তাধারা ছিল ভিন্ন। দেশের সেরা একজন মেধাবী হিসেবে ও চায় ওর সব কাজই হবে অন্যদের জন্য উদাহরণ। একজন প্রতিবন্ধী মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে সে তাই একটা দৃষ্টান্ত রাখতে চায়। যা অন্যরা অনুসরন করবে। তাই করুনা করে না, সত্যিকার সদিচ্ছা থেকেই জাহিদ তারিনকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। জাহিদের মা শুরুতে গাইগুই করলেও পরে ছেলের জেদের কাছে হার মেনেছেন।
এ কথা জাহিদ তারিনকে বলেছে। কিন্তু তারিনকে স্পর্শ করেনি। আগের ব্যাটাও এরকম অনেক কথা বলেছিল। সে শুধু এই জেলখানা থেকে মুক্তি চায়। জাহিদ তাকে এই কাজে সাহায্য করছে, সে জন্যে সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ করে শুধু। আর কিছুই না।

২।
খুব বেশি না হলেও মোটামুটি ধুমধামের সাথেই বিয়ে হয়ে হয়ে গেল তারিন আর জাহিদের।
এতোদিনে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির দিনে কেনো যেন তারিনের বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। হুইল চেয়ারে করে তাকে যখন গাড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল, যাকে সামনে পাচ্ছিল তাকে ধরেই মরা কান্না কাদল ও।
জাহিদ অবশ্য খুব বিব্রত হল এতে। কেমন যেন অপরাধী লাগছিল নিজেকে। সেই ভাবটা নিয়েই বাসর ঘরে ঢুকল ও। তারিন তখনও ফোপাচ্ছে। পাশে বসে স্বান্তনার স্বরে কিছু বলতে যাবে জাহিদ, তার আগে তারিনই কথা বলে উঠল,
‘দেখুন মাফ করবেন। আমি আপনার সাথে এক বিছানায় থাকতে পারবো না।’
এমন অপ্রত্যাশিত আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো জাহিদ। বলে কি মেয়ে?
‘কেনো?’
‘কেনো আমি আপনাকে বুঝায় বলব পরে। এখন আমাকে একা থাকতে দিন।’
‘কি বল, বিয়ের দিনেই বৌকে একা রেখে যাওয়া যায় নাকি?’
‘প্লীজ। আমাকে মাফ করুন। আপনার সাথে থাকার মত মানসিক অবস্থায় আমি নেই।’
‘কি করতে বল আমাকে?’
‘আপনি এই রুম থেকে চলে যান, নয়তো আমাকে অন্য রুমে রেখে আসেন।’
‘আরে ঘর ভরা মানুষ। প্রতি রুমে ফ্লোরিং করে থাকা লাগতেসে।’
‘তাহলে আপনিও ফ্লোরে থাকেন প্লীজ। প্রথম দিনে আমার এই অনুরোধটুক রাখেন।’
‘আমি কেনো থাকবো?’
‘মানে?’
‘মানে, এটা আমার ঘর। বিগত প্রায় বিশ বছর ধরে আমি এই বিছানায় ঘুমাই। আর আমারতো তোমার সাথে থাকতে সমস্যা নাই। সমস্যা তোমার, তো তোমারই তো ফ্লোরে থাকা উচিত।’
জাহিদ ভেবেছিল এই কথা শুনে বুঝি তারিন দমে যাবে। কিন্তু হলো উল্টোটা। বলামাত্র তারিন বিছানা থেকে নেমে গেলো। দেয়াল ধরে ধরে জানালার ধারে গিয়ে নিঃশব্দে কাদতে লাগলো।
জাহিদের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তারিনকে কষ্ট দিতে চায়নি ও। বাসর রাতে বিড়াল মারা আর হবে না বুঝে চুপচাপ ফ্লোরে বিছানা বানিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখে বললেও তারিনকেতো ও আর মেঝেতে শোয়াতে পারে না।
ওর খুব ইচ্ছা করছিল তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে। কিন্তু সাহস হলো না। আজ রাত নিয়ে কি কি ভেবে রেখেছিল, আর কি হলো? সামনেই বা কি আছে কে জানে?
এসব ভাবতেই ভাবতেই ও যখন ঘুমিয়ে গেলো, তারিন তখনো জানালার ধারে ফোপাচ্ছে।

৩।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তারিন দ্যাখে জাহিদ বাসায় নেই। নীচের বিছানাও তোলা।
কিছুটা খুশি হলো ও। এই মানুষটার সামনে ও পড়তে চায় না।
জাহিদ ফিরলো দুপুরের আগে। হাতে কি সব কাগজপাতি। রুমে ঢুকেই তারিনকে বললো, ‘বিকেলে তোমাকে নিয়ে আর্টিফিসিয়াল লিম্ব সেন্টারে যাব।’
‘কেন?’
‘নকল পা লাগানোর জন্যে।’
রেগে যেতে গিয়েও রাগলো না তারিন। ঠাণ্ডা গলায় বললো,
‘আমি যাবো না।’
‘কেনো যাবে না?’
‘আমার সময় নেই।’
‘তাহলে কাল।’
‘কালও নেই।’
‘পরশু।’
কিছু না বলে চোখ গরম করে তাকালো তারিন। তাতে বিন্দু মাত্র দমে না গিয়ে জাহিদ বললো,
‘তার পরের দিন?’
তারিন তাকিয়েই রইলো। আর জাহিদ বলতেই থাকলো,
‘তার পরের দিন?’
‘তার পরের দিন?’
‘তার পরের দিন?’
হাল ছেড়ে দেয় তারিন।
‘ওকে তাহলে ফাইনাল, আজ বিকেলেই যাবো। জাহিদ বলে।’
কিছুই বলে না তারিন। শুধু রুম ছেড়ে চলে যায়।
সেদিন না হলেও, জাহিদের ঘ্যানঘ্যানানির কাছে পরাস্ত হয়ে একদিন পা লাগিয়ে আসে তারিন।
অভ্যস্ত হবার পর সবার সামনে ওটা পরে ঘুরলেও কি এক অজানা জেদে জাহিদের সামনে ও কখনোই নকল পা’টা পরতো না।
সবসময়েই কেমন এড়িয়ে চলতে চাইতো। তাতে অবশ্য জাহিদকে দমানো যায় না। এটা করো, ওটা করো করে সবসময়েই তারিনকে উৎসাহ দিতো। কিন্তু তারিন কেনো যেন কিছুতেই আর মন দিতে পারে না আর। খুব ক্লান্ত লাগে ওর। জাহিদের এতো ভালোবাসা, এতো কেয়ার কেনো যেনো ওর কাছে মেকীই মনে হতে থাকে। বাসার আর সবার সাথে মিশে গেলেও জাহিদ আর তারিনের মাঝের দেয়ালটা অক্ষতই থেকে গেলো তাই।
পা লাগানোর আগে বারান্দতেই তারিন কাটিয়ে দিতে পারতো ক্লান্ত দুপুর কিংবা অলস বিকেল। নিজের অক্ষমতা কাউকেই দেখতে দিতে চাইতো না। কিন্তু পা হওয়ার পর এখন আর মন চায় না ঘরেই বসে থাকতে। ঘর থেকে বের হবার উছিলাতেই ও আবার ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু করতে চাইলো। জাহিদতো এক কথায় রাজি। কয়েকদিন আগে জাহিদই প্রস্তাব দিয়েছিলো ভার্সিটি যাওয়ার তখন তারিন না করে দিয়েছিল। এখন তারিন নিজে থেকে বলায় রাজি তো হবেই।
নতুন করে ভার্সিটির প্রথম দিন রেডি হয়ে নীচে নামতেই তারিন দেখে জাহিদ রিকশা নিয়ে হাজির।
‘তুমি অফিস যাওনি?’
‘না।‘ হাসিমুখে জাহিদের উত্তর।
‘কেনো?’
‘তোমাকে নিয়ে ভার্সিটি যাব বলে।‘
‘না। আমি আপনার সাথে যাব না।’ শক্ত গলায় বলে তারিন।
‘কেনো?’ জাহিদের উচ্ছাস দপ করে নিভে যায়।
‘আমার ইচ্ছা। আপনি সাথে গেলে আমি ভার্সিটি যাব না না না।’
মুখ কালো করে জাহিদ বলে, ‘আচ্ছা। রিকশাটা অন্তত নাও। আমি যাচ্ছি না।’
রিকশায় উঠে অবশ্য খুব খারাপ লাগে তারিনের। বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বুঝতে পারে। একটু মন ও খারাপ হয় ওর।
তবে বহুদিন পর হুডখোলা রিকশার মুক্ত বাতাস সাময়িকভাবে ওর সব কস্টগুলোকে উরিয়ে নিয়ে যায় অজানায়। তারিন ভুলে যায় ওর ব্যাথাগুলো। সকালের নরম রোদের মতই মিষ্টি লাগে ওর জীবনটাকে।

৪।
এখন নিয়মিত ভার্সিটিতে আসে তারিন। পড়াশোনায়ও মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছে। আসা যাওয়া অবশ্য একাই করে। তবে কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে যে ফেরার পথে কে যেন ওকে অনুসরণ করে। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে রিকশায় ওঠার আগ পর্যন্ত। কিন্তু ও কাউকেই ধরতে পারেনি। মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয় কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না।
সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে হঠাৎ শুরু হয় গণ্ডগোল। মানুষজন দৌড়াতে শুরু করে। নকল পা নিয়ে জোরে হাটতে পারে না তারিন। কেমন দিশেহারা হয়ে যায়। আচমকা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে ও। কালো পীচ ওকে গ্রাস করার আগেই কে যেন টেনে ধরলো ওকে।
জাহিদ।
ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই বিহ্বল হয়ে গেছিলো তারিন যে, জাহিদ কিভাবে ওকে বাসায় নিয়ে এলো তা মনে করতে পারে না। জাহিদই যে ওর গোপন অনুসরনকারী এটা ধরতেও ওর আরো দুদিন লেগে যায়। ঘটনার ধাক্কা সামলাতে এই দুদিন অবশ্য ও ভার্সিটি যায় নি।
ব্যাপারটা ধরতে পেরে অবশ্য তারিনের রাগ হয় না। কেমন যেন সূক্ষ্ম ভালোলাগার আবেশ ওকে ছুয়ে যায়।
কিন্তু পরদিন ভার্সিটি যাওয়ার সময় জাহিদ যখন জিজ্ঞেস করল, ‘এখনো তুমি একা একাই আসা যাওয়া করতে চাও?’ তখন আবার সেই পুরোনো জেদটাও ফিরে এলো। জাহিদকে উপেক্ষা করে একাই চলে গেলো ভার্সিটিতে।
সেদিন ফেরার পথে তারিন দ্যাখে জাহিদ পিছু পিছু আসছে। অবশ্য অনেক দূর থেকেই। ও রিকশা ঠিক করে তাকিয়েই দ্যাখে আর নেই।
বাসায় ফিরে অবশ্য এটা নিয়ে কোনো কথা হয় না। সেই আগের মতই এখনো ওরা আলাদাই থাকে। তারিন অবশ্য বহুবার জাহিদকে খাটে শুতে বলেছে কিন্তু জাহিদ রাজি হয়নি। রাতে রুমে তারিন পড়ে, তাই জাহিদ খুব একটা রুমে আসে না। ড্রয়িং রুমে টিভি দ্যাখে। শুধু ঘুমের সময়টাতেই এক সাথে রুমে থাকা হয়। সে কারণেই ওদের আলোচনা খুব কমে গেছে। আগে জাহিদ চেষ্টা করতো কিন্তু তারিনের শীতলতার কাছে হার মেনে বিশেষ কিছু এখন আর বলেনা। চুপচাপ ঘুমায় থাকে।
এভাবেই চলে যায় দিন। জাহিদ প্রতিদিন তারিনকে এগিয়ে দিয়ে যায় রিকশা পর্যন্ত। তারিন রিকশায় উঠতেই উধাও হয়ে যায়। অবশ্য বেশ লাগে তারিনের। সামান্য সময়ের এই লুকোচুরিটাই আজকাল ওর দিনের সবচে আনন্দময় ক্ষণ। ভার্সিটি ছুটি হবে কখন সেই প্রতীক্ষায় থাকে। যেন ছুটির পর বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে গোপন অভিসারে যায় ও। বহুদিনের নিস্তরঙ্গ জীবনে ঢিল ছুড়তে অবশ্য এটাই যথেষ্ট ছিলো।
হঠাৎ একদিন তারিন দেখে জাহিদ নেই। ভার্সিটির মোড়ে তারিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তাও জাহিদ নেই। শেষমেশ একা একাই হাটতে লাগলো। তবে খুব আস্তে আস্তে। এক পা আগায় আর দুইবার চেয়ে দ্যাখে জাহিদ আসলো কিনা। কেমন যেন কান্না পাচ্ছে ওর। একবার ভাবে ফোন করবে। মোবাইলটা বের করে হাতে নেয়। কিন্তু কি একটা যেন আটকে দেয় ওকে। অব্যক্ত অভিমানে অশ্রু নামে ওর।
জাহিদ কিন্তু কাছে পিঠেই আছে। একটা দোকানের আড়ালে দাড়িয়ে দেখছে তারিন কি করে। ভেবেছিল আজ আর দেখা দিবে না কিন্তু ওকে কাদতে দেখে আর থাকতে পারলো না। দৌড়ে গিয়ে দাড়ালো তারিনের সামনে। কিন্তু আশ্চর্য দক্ষতায় তারিন চোখের পানি সামলে এগিয়ে গেলো সামনে যেন কিছুই হয়নি। জাহিদ এতোটাই অবাক হলো যে রিকশা পর্যন্ত আর এগিয়ে গেলো না।
পরদিন জাহিদের সাহস একটু বাড়ল। পিছু পিছু না এসে পাশাপাশি হাটতে লাগলো। তারিন অবশ্য কিছু বললো না। মুখে একটা কপট গাম্ভীর্যের মুখোশ ধরেই রাখলো। আজকে জাহিদ রিকশার পাশে দাড়িয়ে থাকলো। তারিন একবার ভাবলো উঠতে বলে কিন্তু বলা হলো না।
পরদিন তারিন রিকশায় উঠতেই জাহিদ হাতটা বাড়িয়ে দিলো। হাতের মাঝে একটা নাম না জানা ফুল। হয়তো রাস্তা থেকেই কুড়িয়ে এনেছে। কিন্তু তারপরও কেনো যেন সেটা তারিনের কাছে পৃথিবীর সুন্দরতম উপহার বলে মনে হলো।
এবার শুরু হলো ফুল পর্ব। কখনো গোলাপ, বেলি, অর্কিড, ডালিয়া, জিনিয়া কিংবা রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া সেই ফুল।
পাশাপাশি দুজনের নিশ্চুপে হেটে চলা। শব্দ না করেই কত কথা বলে ফেলা। একটু একটু করে তারিনের বরফ হৃদয়ে উষ্ণ রক্তের আনাগোনা। মনের উঠোনে কে যেন উকি দিয়ে যায় নিয়মিত।
এভাবেই কি চলবে? তারিন বোঝে ও জাহিদকে এতো বেশি অপমান করেছে যে, না ডাকলে ও নিজে থেকে আর কাছে আসবে না। কিন্তু ও কি করবে? বহুবার ভেবেছে সব ভুল স্বীকার করে মাফ চাবে। কিন্তু কিসে যেন আটকে যায়।
সেদিন রাতে যথারীতি জাহিদ নীচে শুয়েছে।
তারিন অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলো জাহিদকে বলার জন্য যে উপরো শোও। কিন্তু মুখ দিয়ে বের ই হল না। আকারে ইঙ্গিতে অবশ্য বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু জাহিদ আজ বোঝেই না কিছু। জাহিদ ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু তারিনের চোখে ঘুম নাই।
জাহিদের ঘুমন্ত মুখটা দেখে ছুয়ে দিতে মন চায় কিন্তু যে দেয়াল ও গড়েছে তা ভাঙ্গার সামর্থ ওর নাই। পা লাগানোর পর ও আর রাত জেগে আকাশ দেখা হয়নি। আজ অনেকদিন পর নকল পা ছাড়াই সেই প্রথম দিনের মত দেয়াল ধরে ধরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। চাদের দিকে তাকিয়ে খুব অভিমান হলো ওর। কার উপর জানে না। নিজের উপরেই হয়তো। কাছের মানুষগুলোকে ধরে রাখার ক্ষমতা ওর নেই। সেই অক্ষমতার অভিযোগ দেওয়ারও কেউ নেই। এতো বিশাল পৃথিবীতে একাকীই হয়ত কাটিয়ে দিতে হবে সারাজীবন।
হঠাৎ পিঠে কিসের ছোয়া লাগতেই চমকে ফিরে তাকায় তারিন। জাহিদ কখন উঠে এসেছে কে জানে! শশব্যস্ত হয়ে সরে যেতে চাইলো ও। কিন্তু জাহিদ এতো জোরে জানালার গ্রিল চেপে ধরে রেখেছে ও নড়ার জায়গা পাচ্ছে না। তারপরও মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো।
কাধ ঝাকিয়ে জানালা ছেড়ে দিলো জাহিদ। কিছু না বলেই তাকিয়ে থাকলো তারিনের চোখের দিকে। সেখানে টলটল করছে জল। ছুয়ে দিলেই গড়িয়ে পড়বে। তা দেখে ওর নিজের চোখের কোণেও জমল জল। এই মেয়েটাকে ও কখনোই বুঝলো না। ওর জন্যে কাঁদছে তাও ওর কাছে আসবে না। কি হয় একবার ওর হাতটা ধরে পাশে হাটতে দিলে। ও কখনোই হাত ছাড়বে না। কিন্তু সেই ভাগ্য বোধহয় আর নেই।
সরে যাবে কিন্তু তার আগেই তারিন ঝাপিয়ে পড়ল ওর বুকে। অশ্রুর বাধ ভেঙ্গে গেছে আগেই। কাদতে কাদতে হড়বড় করে কি সব বলতে লাগলো তারিন। জাহিদ কিচ্ছু বুঝছে না।
কিন্তু তারিনের শরীরের কাপুনি ঠিকই কোনো এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় জাহিদের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে ফিসফিস করে বলে দিলো, ‘ভালবাসি।’ আর তারিন কান পেতে তার উত্তর শুনতে লাগলো।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×