somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাকিস্তানি ড্রামা সিরিজ এহদ এ ওয়াফা...

০৩ রা জুন, ২০২০ সকাল ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


করোনাকালে ইউটিউবের কল্যাণে চোখ ব্যথা করে ফেলা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে নিতান্তই কম না। পাকেচক্রে আমিও ওই দলে পড়ে গেছি। এই ওয়াচ রেসিপিতে দেশি-বিদেশি, ক্লাসিক-টিপিক্যাল, নাটক-সিনেমা, অখাদ্য-কুখাদ্য, কিছুই বাদ যায়নি। আমার আইডি থেকে ভিডিও দেখার পরিমাণ অকস্মাৎ এভাবে বেড়ে যাওয়ায় ইউটিউবও আমাকে বিভিন্ন পদের ভিডিও সাজেস্ট করতে থাকে।

স্ক্রল করতে গিয়ে একদিন দেখি একটা ভিডিও সাজেশান দিচ্ছে, নাম এহদ এ ওয়াফা। ওটা একটা পাকিস্তানি ড্রামা সিরিয়ালের শেষপর্ব ছিলো। আউট অব ইন্টারেস্ট আমি ভিডিওটা দেখতে শুরু করলাম; কিন্তু শুরুর পর বলা চলে এক নিশ্বাসেই একঘন্টা বাইশ মিনিটের শেষপর্বটা দেখে ফেললাম। এবং তারপর আমি খুঁজে নিয়ে প্রথমপর্ব থেকে দেখা শুরু করে পুরো সিরিজটাই দেখলাম।

এ দেশের অনেকের মতই পাকিস্তানি মুভি বা ড্রামার সাথে আমার পরিচয় ছিলো না। কিন্তু এহদ এ ওয়াফা সিরিজটা দেখে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। যেহেতু আমি নাটক-সিনেমার লোক নই, সুতরাং এর রিভিউ করাটা আমার কম্ম না। তাছাড়া যেকোনো আসপেক্টেই পাকিস্তানি একটা প্রোডাকশনের প্রশংসা করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ট্যাবু রয়ে গেছে। তবুও এই লেখাটা লিখছি কারণ ওই ড্রামা সিরিজটা দেখতে গিয়ে সমসাময়িককালে আমাদের দেশে নির্মিত নাটকের সাথে তুলনা চলে আসছিলো বারবার। বলাবাহুল্য, সেখানে ব্যাপক ব্যবধানে আমরা অকৃতকার্য হয়েছি।

আমি তাই এই ড্রামা সিরিজের ক্রিটিসিজম করছি না, আমি স্রেফ ব্যক্তিগত ভালোলাগার সাথে সাথে আমরা কি বানাচ্ছি তার একটা তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবো।

এই ড্রামা সিরিজটা একটা দেশত্ববোধক সিরিজ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অথবা তাদের অনুমোদনক্রমে নির্মিত হয়েছে, স্ক্রিনের কোণায় সারাক্ষণ আইএসপিআর লেখা থাকতে দেখেছি। মুন্সীয়ানাটা এখানেই যে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা এবং দেশপ্রেমের ধুঁয়ো গায়ে নিয়েও এটা পুরোমাত্রায় অসামরিক ও শক্তিশালী সামাজিক একটা গল্প। গল্পের প্লট, কাহিনী, গাঁথুনি, সংলাপ অত্যন্ত চমৎকার। গল্পকার এবং পরিচালকের দক্ষতায় তাই নাটক হয়েও এটা নাটকীয় হয়ে যায়নি। স্বাভাবিক থেকেছে।

একটা কলেজ হোস্টেলে থাকা চারজন কৈশোরউত্তীর্ণ যুবকের বন্ধুত্ব নিয়ে গল্পের শুরু হয়। এই চারজন ছেলে এসেছে একাধারে সমাজের চার ধরনের শ্রেণী থেকে। অর্থনৈতিক শ্রেণীকরণ ও পারিবারিক ঐতিহ্যর দিক থেকেও তারা চারটি ধারার প্রতিনিধি। কিন্তু যেহেতু দেশপ্রেমকে উপজীব্য করে এই ড্রামা সিরিজ, সেহেতু শেষবিচারে তারা দেশের প্রতি নিবেদনের যায়গায় এসে এক যায়গায় মিলে যায়। এই চার ছেলের ব্যক্তিগত পথচলা, পারিবারিক টানাপোড়েন, সততা-শঠতা, প্রেম-ভালোবাসার আখ্যান নিয়েই পুরো সিরিজ এগিয়েছে, যা শেষ হয়েছে দেশপ্রেমের মন্ত্রে।

বৈরী প্রতিবেশীবেষ্টিত একটা দেশ তার শিল্প সাহিত্যে দেশপ্রেমের ‘তাস’ ব্যবহার করে জনগণের আবেগকে প্রভাবিত করতে চাইবে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু আমার কাছে সিরিজটির শক্তিশালী গল্প, সাবলীল সংলাপ, চমৎকার দৃশ্যায়নের সাথে সাথে আবহসঙ্গীত, সব মিলিয়ে একটা কমপ্লিট প্রোডাকশন মনে হয়েছে; যেখানে অভিনেতা অভিনেত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয় আছে, সুন্দর কিছু মেসেজ আছে। সেটাই তো হওয়া উচিৎ। দিনশেষে দর্শক যেনো কিছু একটা মনে রাখতে পারে।

এখন আসেন আমাদের নাটকের কথায়। গত এক-দেড়বছরে আপনার দেখা কোনো নাটকের কোনো বিশেষ বক্তব্য কি আপনার মনে রেখাপাত করেছে? আমার মনে হয় উত্তরটা হবে ‘না’। আমাদের নাটকের শেষ কথা বলতে ঘুরেফিরে সেই ‘বহুব্রীহি, সংসপ্তক, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, এইসব দিনরাত্রী, রূপনগর বা সেই নব্বুইয়র দশকের নাটকগুলোই আসে। যার কারণে এই লকড ডাউনের সময়ে বিটিভি পুনপ্রচারের জন্য আর্কাইভ থেকে এই নাটকগুলোকেই খুঁজে বের করতে পেরেছে!

গত কয়েকবছরে আমাদের এখানে নির্মিত নাটকগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘বড়ছেলে’ নাটকটার কথাই যা একটু আলাদা করে বলা যায়, এ ছাড়া বাকি সব নাটকই একই ধারার, গতানুগতিক, একঘেয়ে ও চরমমাত্রায় বৈচিত্র্যহীন। সেখানে মূল চরিত্র দুজনের মাঝে প্রেম হওয়ানো ছাড়া আর কোনো মোক্ষই থাকে না। ইদানিংতো বাজেট কমাতে গিয়ে দেখা গেছে একটা বাসার মধে অথবা একটা ট্রেন বা বাসজার্নিতেই তিন চারজন চরিত্র নিয়েই একটা নাটক শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার অধিকাংশ নাটকেই দেখা যায় মূল চরিত্রের মা থাকলে বাবা নেই, অথবা বাবা থাকলে মা নেই.... । অদ্ভুত একটা অবস্থা, যেনো এ দেশে সব ফ্যামিলিই ব্রোকেন ফ্যামিলি হতে হবে অথবা মা-বাবার কেউ একজনকে বাধ্যতামূলকভাবে অকালপ্রয়াত হতে হবে।

সবচেয়ে বিপদজনক দিকটা হলো আমাদের নাটকগুলোতে এমন সব সংলাপ এখন অবলীলায় বলা হচ্ছে, যা যেকোনো বিচারেই অশ্লীল হিসেবে গণ্য হবে। গল্পহীনতা, অতি নাটকীয়তা এগুলো বাদই থাকলো।

সাম্প্রতিককালে ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’ নামের একটা ধারাবাহিক নাটক চোখে পড়লো। প্রথম আট দশটা পর্ব দেখে মনে হলো, না এখানে কিছু গল্প আছে, বক্তব্য আছে। তারপর এর গল্পে অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন নতুন নতুন চরিত্রের অন্তর্ভূক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু গল্পের মেরিট একটুও বাড়েনি। বরং নতুন এইসব চরিত্রের অভিনয় বিরক্তিই উৎপাদন করেছে শুধু। শতাধিক পর্ব পার করে করোনার কারণে এই সিরিজটা এখন বন্ধ রয়েছে।

এই সুযোগে ‘গল্পগুলো আমাদের’ নামের অন্য একটা ধারাবাহিক বিক্ষিপ্তভাবে দেখলাম। এই সিরিজের অন্যতম চরিত্র প্রায় বৃদ্ধ এক দম্পতি একটা রেস্তরা চালান, যেখানে উনারা উনাদের যৌবনের জোশ উর্ব্ধে তুলে রেস্তরায় আসা বিভিন্ন কাপলকে নিয়ে আলোচনা, সমস্যা সমাধান ইত্যাদি করেন! গল্পকারের বলিহারি সেন্স!! অতি নাটকীয় এই প্যানপ্যানানীর ফলে ওখানেই ওই সিরিজ দেখা সমাপ্ত। দুঃখজনক হলো দিলারা জামান এবং হাসান ইমামের মত শক্তিমান অভিনয়শিল্পীরাও এখন এ ধরনের চরিত্র অভিনয় করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন!!

এই প্রেমের ছ্যাবলামীর বাইরে আমাদের নাটকে বর্তমানকালের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো- কমেডি ধারা। এই ধারায় অভিনয় করতে করতে আমাদের গুণী পরিচালকদের গাড্ডায় পড়ে ‘কেরাম’ এর মোশাররফ করিম বা মনপুরার চঞ্চল চৌধুরীরা আজ নিজেদেরকে মোটামুটিভাবে ‘ভাড়’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। অথচ আমাদের বহুব্রীহি বা আজ রবিবারে হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন সেন্স অব হিউমার কিভাবে নাটকে দৃশ্যায়ন করতে হয়!

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এখন আমরা। এই স্বল্প সময়ে আমরা পাকিস্তানকে অনেক ক্ষেত্রেই পেছনে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু এহদ এ ওয়াফা এবং তৎপরবর্তী আরও কিছু পাকিস্তানি নাটক ও মুভি দেখে মনে হচ্ছে ধর্মীয় গোড়ামী ও সন্ত্রাসে আক্রান্ত হয়েও এই ক্ষেত্রে ওরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে যোজন যোজন দুরে। প্রযুক্তির ব্যবহারে খামতি থাকতে পারে, কিন্তু গল্প তৈরী বা পরিচালনায় দক্ষতার দিক থেকে কেনো আমরা পিছিয়ে থাকবো? প্রগতির দিক থেকে পিছিয়ে থেকেও এহদ এ ওয়াফা ড্রামা সিরিজে যেভাবে ওরা স্বাভাবিক বর্তনীর মধ্যে থেকেই পাকিস্তানের সমাজকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে, আমাদের নাটকগুলোতে কি আমরা তা পারছি?

এই যায়গাটাতে আমাদের চিন্তার অবকাশ রয়ে গেছে। কারণ সোহরাওয়ার্দীতে দলীয় জনসমাগমে গলা ফাটিয়ে বলা বক্তব্য আর নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে সমাজ ও দেশের উন্নতি নিয়ে যতই বকওয়াজ করা হোক না কেনো, দেশ ও সমাজের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব হিসেবে মানুষ শিল্প-সাহিত্যকেই গ্রহণ করে। মানুষ মনেও রাখে সেটাই।

মনে রাখলে সুবিধা হবে যে ইরানের যাবতীয় বিতর্ক পাশে রেখেও মানুষ কিন্তু মাজিদ মাজিদির ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ বা এই ধরনের শিল্পকর্মগুলোর কথাটাই আগে বলে।



সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২০ সকাল ১১:১৮
২২টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×