
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
উনিশ শ’ আটষট্টি সাল। নানার বাড়ি থেকে ফিরছি। মা, বাবার সাথে পারবর্তীপুর জংশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। শেষ রাতে দিনাজপুর থেকে মিটার গেজ লাইনের গাড়ি এলো। গাড়িতে অনেক ভির। সিট খালি না থাকায় মাকে আর আমাকে মহিলা গাড়িতে তুলে দিয়ে বাবা পাশের বগিতে গিয়ে উঠলেন। মহিলা গাড়িতে বসার জন্য লম্বা লম্বা তিনটি বেঞ্চ আছে। দু’টি বেঞ্চি দুই পাশে জানালার ধারে আরেকটি বেঞ্চি মাঝখানে। জানালার পাশের বেঞ্চিতে জায়গা নেই। মাঝখানের বেঞ্চিতে তিনজন বিহারী মহিলা ঠ্যাং তুলে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। ছয়জনের সিট তারা তিনজনেই দখল করে আছে। তিনজনেই বোরখা পড়া। সেই সময়ে বাঙালীরা ওদের মত বোরখা পরতো না।
মা সিটে বসতে চাইলে বিহারী মহিলা কথাই বলল না। আমি মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পরে মা আবার মহিলাকে সরতে বললেন, মহিলা চোখ তুলে তাকালেন বটে সরলেনও না কথাও বললেন না।
মা খুব সহজ সরল মহিলা। লেখা পড়া জানেন না এমন কি হিসাব নিকাসও জানেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা টাকা গুনতে জানতেন না। মা’র কাছে টাকা রাখতে দিলে টাকা পেঁচিয়ে লাল, কালো বিভিন্ন রংয়ের সুতা দিয়ে বেঁধে ছোট নোট, বড় নোট, লাল নোট আলাদা আলাদা করে রাখতেন। কারো সাথে কখনও ঝগড়া করতেন না। কেউ ঝগড়া করলে নিজেই চুপ হয়ে থাকতেন। বাবাকে সারা জীবন যমের মত ভয় পেতেন। যেহেতু পরিচিতদের সাথেই কখনও ঝগড়া করতেন না সেখানে অপরিচিতদের সাথে ঝগড়া করার তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু আমার এই সহজ সরল মা, আজ যেন প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। মা মহিলাকে ধমক দিয়ে বললেন, আমরা টিকিট কাইটা উঠছি, আপনারা সিট ছাড়েন না ক্যান?
মার ধমকে মহিলাদের তিনজনের মুখে যেন আগুন লেগে গেল। মার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। তিনজনের মুখই নেকাব দিয়ে ঢাকা। একজন মহিলা নেকাবের আবারণ সরিয়ে মুখ বের করে কড়কাড়ানি মুরগীর মত ক্যাক ক্যাক করে উঠল। তাদের আচরণ দেখে মনে হলো-- ওরা এই দেশের মালিক আমরা উদ্বাস্তু। এই গাড়িতে উঠাই যেন আমাদের অপরাধ হয়ে গেছে। অথচ এটা আমার জন্ম ভূমি। শুধু আমার জন্মভুমিই নয় আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির জন্মভুমি। আমার জন্মভ’মিতে আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে তারা অন্য দেশ থেকে এসে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। ওদের আচরণে আমারও শরীরে জেদ এলো কিন্তু ছোট হওয়ায় কিছু বলার সাহস পেলাম না।
মা কখনও এত কথা বলেন না, কিন্তু ঐদিন বিহারী মহিলাদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক কথা বললেন। মা এত কথা বলার পরও লাভ হলো না, তারা কোন ভাবেই সিট ছেড়ে দিল না। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রংপুর স্টেশনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো। বাবা আমাদের হালত দেখার জন্য পাশের কামরা থেকে চলে এলেন। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের দাঁড়ানো অবস্থা দেখে বাবা দরজার কাছে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন?
মা বলল, এই মহিলা তিনজন আমাদের বসতে দেয় না।
আমাদের বসতে দেয় না শুনে বাবার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। বাবা খুব সাহসী লোক। ত্রিং করে কামড়ায় লাফিয়ে উঠে মহিলাদের আঙ্গূল উঁচিয়ে বললেন, আপনারা বসতে দেন না কেন?
বাবার শাসানীতে মহিলা তিনজন একসাথে “বেগানা আদমী বেগানা আদমী” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তাদের চেঁচানিতে বাবা বেশি সুবিধা করতে পারলেন না। কারণ দেশটা তখন পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসনে চলে। পুলিশ থেকে প্রশাসনের সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রনে। তারা যত অন্যায়ই করুক না কেন তাদের অন্যায় খুব একটা আমলে নেয়া হয় না। নির্দোষ হওয়া সত্বেও সব দোষ বাঙালীদের ঘাড়ে চাপানো হয়। তারোপর অপরিচিত বিহারী মহিলা হওয়ায় তাদের সাথে পুরুষ হয়ে ঝগড়া করাও শিষ্টাচার বহির্ভূত। বাবা হয়তো এসব চিন্ত করেই নিচে নেমে টিকিট চেকার ডেকে আনলেন। টিকিট চেকারও সম্ভাবত বিহারী। তিনি একটি বাংলা কথাও বললেন না। উর্দুতে কি কি সব বলার পর পাশের মহিলাটি সরে সামান্য একটু জায়গা দিলো। তাতে মা কোন রকমে বসতে পারলেও আমার বসা সম্ভব হলো না। আমি মায়ের কোলের উপর বসলে পাশের মহিলাটি মায়ের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিল। আমাকে এই গাড়িতে থাকতেই দিবে না। আমিও নাকি বেগানা আদমী। মা তাদের উর্দু কথা কিছুই বোঝে না, তারপরেও তাদের হাত নাড়ানো আর মুখ নাড়িয়ে কড়কড়ানো দেখেই আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় দুই চার কথা শোনাতে লাগলেন। জানালার পাশের মহিলারা দুই চারজন বাঙালী থাকলেও কোন কথা বলছে না, আমাদের অসহায় অবস্থা আর বিহারী মহিলাদের অত্যাচারের আচার আচরণ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বিহরী মহিলারা আমাকে দূরে দাঁড়াতে বললেও মা জেদ করে আমাকে তার কোলে বসিয়ে বুকের সাথে মাথাটা চেপে ধরে থাকলেন। কোনমতেই আমাকে কোল থেকে নামতে দিলেন না। এই অবস্থায় কাউনিয়া জংশনে এসে গাড়ি থামলে বাবা আবার এলেন। এসে দেখেন আমাদের ঠিকমত বসার জায়গা দেয়নি। বাবা আবার টিকেট চেকার ডেকে এনে বললেন, আমার ছেলের হাফ টিকিট কাটা আছে কিন্তু মহিলারা বসতে দিচ্ছে না।
টিকেট চেকার বগিতে উঠে সিট দেয়ার কথা বললে মহিলারা আমাকে ‘বেগানা আদমী’ হিসাবে বগি থেকে নামিয়ে দিতে বলল। টিকেট চেকার তাদের কথা শুনে বাবাকে বলল, আপনার ছেলেকে অন্য বগিতে নিয়ে যান।
বাবা তার কথায় রাজী হলেন না। বাবা খুব একটা লেখাপড়া না জানলেও অত্যান্ত বুদ্ধিমান, সাহসী এবং বাকপটু লোক। তিনি চেকারকে বললেন, বাচ্চার জন্য হাফ টিকিট কাটা আছে। টিকিট অনুযায়ী আমার বাচ্চা সিটের দাবীদার। আর বাচ্চারা সবসময় মায়ের সাথেই থাকে। আমি তাকে নামিয়ে নেব কেন? এটা কোন আইনে কথা বললেন?
বাবার যুক্তি পূর্ণ কথা শুনে টিকেট চেকার আবার মহিলাদেরকে কি কি সব উর্দুতে বলার পর সামান্য একটু জায়গা দিল। তাতে মা ভালভাবে বসলেও আমার পুরোপুরি বসার জায়গা হলো না। প্রথমেই মা আমাকে মাঝখানে বসানোর চেষ্টা করতেই মহিলারা বাঁধা দিয়ে বসল। তারা বাঁধা দেয়ায় মা আমাকে তার ডান পাশে বসালেন। মা আমাকে তার ডান পাশে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। এই অবস্থায় গাড়ি কাউনিযা জংশন ছেড়ে বামন ডাঙ্গা এসে থামল। বামন ডাঙ্গা থেকে শাড়ি পরা দু’টি মেয়ে উঠল। বয়স আঠারো বিশের মত হবে। সম্ভাবত গাইবান্ধা কলেজে পড়ে। হাতে বই খাতা আছে। তাদের একটি মেয়ে মাকে সরে গিয়ে জায়গা দিতে বললে মা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, মা গো, এই হারামজাদীরা জায়গা দেয় না। সারা রাস্তা আমার সাথে ঝগড়া করতে করতে আইছে।
মা’র কথা শুনে পাশের মেয়েটি বিহারী মহিলাকে সরতে বলল। কিন্তু বিহারী মহিলা না সরে উর্দুতে বকর বকর করতে লাগল। তার বকবকানি দেখে মেয়েটি মাকে বলল, খালা আপনি একটু উঠে দাঁড়ান তো, আমি মাগীদের একটু সায়েস্তা করে নেই।
মা উঠে দাঁড়ালে মেয়েটি সিটে বসে তিন মহিলাকে এমন জোরে ঠেলা দিলো-- ঠেলার চোটে পাশের মহিলা দেয়ালের সাথে মাথায় বাড়ি খেলো। দেয়ালের পাশে রাখা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি সিটকে নিচে পড়ে গেল। ক্যারিয়ারের বাটিতে রাখা মাংস রুটি ছড়িয়ে গেল। মেয়েটির কান্ড দেখে মহিলারা বারুদের মত জ্বলে উঠল। পারলে মেয়েদের গায়ে হাত তোলে। মেয়ে দু’টিও কম নয়, ঘুষি নিয়ে নাকের উপর গেল। দুইজনের ঘুষি আর উগ্র মুর্তী দেখে মহিলারা ভয় পেয়ে গেল। বিড়ালের মত চুপসে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রুটি গোস্ত মেঝে থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
গাইবান্ধা স্টেশনে গাড়ি থামলে মেয়ে দু’টি নেমে গেল। নামার সময় একটি মেয়ে মকে উদ্দেশ্য করে বলল, খালা, এই মহিলারা আবার যদি কিছু বলে, ধাক্কা দিয়া গাড়ি থেকে ফেলে দিবেন। এটা আমাদের দেশ ওদের না।
মেয়েটির প্রতিবাদী কণ্ঠ আমার মাকে যেন প্রতিবাদী হওয়ার উৎসাহ জাগিয়ে দিয়ে গেল। তারা নেমে যাওয়ায় বিহারী মহিলারা মা’র দিকে কটমট করে তাকালো। তাদের তাকানো দেখে মা চোখ গরম করে বলল, চোখ বড় করবি না, চোখ বড় করবি তো চোখ টান দিয়া ছিঁড়া ফালামু, বহুত জ্বালাইছোস, এটা এখন আমাগো দ্যাশ। এতক্ষণ বিদেশে আছিলাম দেইখা কিছু কই নাই (সেই সময়ে গ্রামের মানুষ এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গেলে সেই জেলাকে বিদেশ মনে করতো)।
মা’র কড়া কথা শুনে মহিলারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল বটে তবে জায়গা দখল করার সাহস পেল না। তিনজন অনবরত বকর বকর করতে লাগল। মহিলাদের বকবকানো অবস্থায় গাইবান্ধা থেকে ট্রেন ছেড়ে বাদিয়াখালী স্টেশনে এসে গাড়ি থামলে আমরা নেমে গেলাম।
বাবার দেয়া সময় অনুযায়ী বড় ভাই গরুর গাড়ি নিয়ে স্টেশনের পূর্ব পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি আর মা গরুর গাড়িতে উঠতেই গারোয়ান জোয়ালে গরু লাগিয়ে গাড়ি ছাড়লেন। দুপুরের পরপরই বাড়ি গিয়ে পৌছলাম।
আজ আমার মা বেঁচে নেই, কিন্তু ছোট কালের মায়ের সাথে সেই ভ্রমণের স্মৃতি এখনও মনে আছে। আজ সেই ভ্রমণের কথা মনে হলেই মনে পড়ে বিহারীদের কোন পর্যায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একজন সহজ সরল মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে, সেই উদাহারণ আমি স্বচক্ষে দেখেছি। সেই দিনের আত্যাচারে অতিষ্ট মা প্রতিবাদের যে স্বাক্ষর আমার সামনে রেখে গেছেন, আমি তা জীবনেও ভুলবো না। সেই অত্যাচারের স্মৃতি মনে পড়লে আজো রক্ত টগবগিয়ে উঠে। সেদিনের মায়ের প্রতিবাদ দেখে আজো আমার তার প্রতি শ্রোদ্ধায় মথা নত হয়ে আসে। লেখাপড়া না জানা সহজ সরল মায়ের এই প্রতিবাদ হয়তো সেই সময়ের অত্যাচারের কাছে তেমন কোন বড় ঘটনা নয়, তারপরেও তার প্রতিবাদী হয়ে উঠাটাই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার আগুন ঝরা বিপ্লবের একটি অংশ বটে।
আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার মায়ের সেই ঘটনা হয়তো ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে না। কিন্তু পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে এদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি যতটুকু প্রতিবাদ করে গেছেন সেইটুকুর জন্যই মায়ের অবদান এদেশের মানুষ স্বীকার করবে কিনা জানি না তবে আমার কাছে অনেক।
যদিও ছয়চল্লিশ বছর আগের ঘটনা, তার পরেও মায়ের প্রতিবাদী হওয়ার সেই দৃশ্যটি আজো আমার চোখে চোখে ভাসে।
(গত ৫ই অক্টোবর ছিল আমার মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সবার কাছে দোয়া চাই।)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



