শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
গোলাম কিরীয়া আর রশীদুন্নবী এরা ছিল আপন দুই ভাই। গোলাম কিবরীয়া বড় আর রশীদুন্নবী ছোট। দুই জন এক ক্লাসেই পড়তো। গোলাম কিবরীয়া ছাত্র হিসাবে খুব একটা ভালো ছিল না তবে রশীদুন্নবী ট্যালেন্ট ছিল। গোলাম কিবরীয়ার বাবা গেরস্থ হওয়ায় ক্ষেত খামার নিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে গোলাম কিবরীয়ার লেখা পড়া বন্ধ করে গৃহস্থ কাজে লাগায়। যে কারণে গোলাম কিবরীয়ারও লেখাপড়া ক্লাস ফোরেই বন্ধ হয়ে যায়।
মেয়েদের মধ্যে বয়স বেশি ছিল ফাতেমার । খুবই চুপচাপ মেয়ে। ক্লাস ফোরে উঠার পর তারও বিয়ে হয়ে গেল। ফাতেমার বিয়ের কিছুদিন পরেই নুরজাহানের মা মারা গেল। নুরজাহান অসহায় হয়ে পড়ল। নুরজাহানের বাবা স্কুল কমিটির সভাপতি হওয়া সত্বেও তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিল। এর কয়েক মাস পরেই নুরজাহানের বিয়ে হয়ে গেল। পনর বিশ বছর আগে একবার নুরজাহানের সাথে দেখা হয়েছিল। তখনই ওর নাতি বেশ বড় হয়েছে। এখন হয়তো নাতির ঘরেও ছেলেপুলে জন্ম নিয়েছে।
আরেকজনের কথা বর্ণনা না করলে আমার প্রাইমারী স্কুলজীবনের বর্ননাই পূর্ণতা পাবে না। সেই ছাত্র হলো শাহা আলী। সবাই তাকে সংক্ষেপে শাহালী নামে ডাকতো। এই ছাত্র ক্লাস থ্রিতে এসে ভর্তি হলেন। তখন তার বয়স আঠারোর বেশি ছাড়া কম নয়। মিডিয়াম লম্বা হলেও প্রশস্ত বক্ষসহ গোট্টাগোট্টা শক্তিশালী চেহারা। সামনের দাঁতগুলো একটু বড় বড় ছিল। মাথার চুল ব্যাক ব্রাশ করে আছড়াতো। একটু তোতলা তোতলা ছিল। কিন্তু মানুষ হিসাবে খারাপ ছিল না।
শাহা আলীকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। কারণ তার বাবা আমার বাবাকে চাচা বলে ডাকতো। স্কুলে ভর্তী হওয়ার ঠিক ছয় মাস আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পরে এত বয়সে কেন তিনি স্কুলে পড়তে এলেন এটা এখনো জানতে পারি নাই। পরিণত বয়সে এধরনের প্রশ্ন আমার মাথায় অনেক বার এসেছিল কিন্তু বয়সের পার্থক্য অনেক হওয়ায় কখনও প্রশ্ন করার সাহস পাইনি। নদী ভেঙে আমরা উভয়ই এলাকা ছাড়া। আজ তিনি বেঁচে আছেন কিনা জানি না। তবে তাঁর একটি ঘটনা আজো ভুলতে পারি নাই সেটা হলো--
ক্লাস থ্রীতে উঠার পরে সম্ভাবত জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা। হাইস্কুল এবং প্রাইমারী স্কুল এক দিনেই প্রতিযোগীতা হবে। প্রতিযোগীতার জন্য হাইস্কুলের ফান্ড থাকলেও প্রাইমারী স্কুলের কোন ফান্ড নেই। বাধ্য হয়ে স্যারেরা আমাদের ঘাড়ে ছালার বস্তা চাপিয়ে দিয়ে গ্রামে গ্রামে চাল, টাকা পয়সা উঠানোর জন্য পাঠালো। চাল উঠানোর দায়িত্ব পড়ল ক্লাস থ্রী, ফোর ও ফাইভের ঘাড়ে।
আমরা ক্লাস থ্রীর বারো তেরোজন একটি দলে পরিণত হলাম। আমাদের টিম লিডার হলো শাহা আলী। ক্লাস না করে দল ধরে ছালা ঘাড়ে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এই বাড়ির পিছন দিয়ে ওই বাড়ির সামান দিয়ে কয়েকটি গ্রাম চষে বেড়াতে লাগলাম। বড়ই গাছ পেলে তো কথাই নাই বারো তেরো জনের ঢিলের চোটে ঐ গাছের অর্ধেক বড়ই ঐদিনেই ছাফা হয়ে যেত। । স্কুলের ছাত্র হওয়ায় বাড়ির বুড়ো বুড়িরা হাউকাউ করলেও ঠেকাতে পারতো না। গাছের তলে যত খেতাম তার চেয়ে বেশি পকেট ভরাতাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই বাকি বড়ই সাবার করতাম। এমনি ভাবেই চাউল তোলার আনন্দে আত্মহারা ছিলাম। তবে গ্রামের কেউ আমাদের অবজ্ঞা করতো না। স্কুলের খেলাধুলার জন্য চাউল চাইলে সাধ্যমত সবাই বেশি বেশি করে চাউল দেয়ার চেষ্টা করতো। রোদের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। তখন অনেক বাড়িতেই চাপ কল বা কুয়োর ব্যাবস্থা ছিল না। একটি চাপ কলের উপর কয়েক বাড়ি নির্ভর করতো। কারো বাড়িতে কেউ পানি খেতে চাইলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। মুহুর্তেই এক কলসি পানি সাবার হয়ে যেত।
চার পাঁচ দিন চাল তোলার পর পরবর্তী দিন স্কুলের পূর্ব পাশের গ্রামে চাল তুলতে গিয়েছি। স্কুল থেকে প্রায় আধা মাইল পূর্বে এই গ্রাম। আট দশটি বাড়ি মিলে উত্তর দক্ষিণ পাড়া। বাড়িগুলি মোটামুটি অবস্থাপন্ন। আমরা বাড়ির পিছন দিয়ে মরিচ ক্ষেতের মাঝের আইল দিয়ে লাইন ধরে যাচিছ। আমাদের দলের সামনে দলনেতা শাহা আলী। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই হালকা পাতলা খাটো সাইজের এক বৃদ্ধ লাঠি নিয়ে আমাদের ধাওয়া করলো। বৃদ্ধকে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতে দেখেই আমরা ভয়ে মরিচ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে দিলাম দৌড়। বারো তেরো জন এক সাথে দৌড় দেয়ায় কাঁচা মরিচ ক্ষেতের বারোটা বেজে গেল। কিছুদূর দৌড়ে এসে সবাই থেমে গেলাম। তাকিয়ে দেখি শাহা আলী সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ো চোটপাট করতে করতে লাঠি নিয়ে শাহা আলীর কাছাকাছি এসেছে। শাহা আলী কোন কথাই বলছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। বুড়ো কাছাকাছি এসেই শাহা আলীকে মারতে উদ্যোত হলো। শাহা আলীকে মারার জন্য বুড়ো মাথার উপরে যেই লাঠি তুলেছে অমনি শাহা আলী বুড়োর লাঠি এক হাতে থাপা দিয়ে ধরেই গলা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। মাটিতে ফেলেই গলায় পাড়া দিয়ে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বুড়ো শাহা আলীর পায়ের নিচে পড়ে ওরে বাবারে ওরে বাবারে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। বুড়োকে কুপোকাত করায় আমরা সবাই আবার শাহা আলীর কাছে দৌড়ে গেলাম। বুড়ো শাহা আলীর পায়ের নিচে পড়ে মরার অবস্থা। বুড়ো মরে যাবে মনে করে আমরা শাহা আলীকে ধাক্কাতে লাগলাম। কিন্তু শাহা আলীকে কোন ভাবেই বুড়োর উপর থেকে নামাতে পারছিলাম না। শাহা আলীর চোখ দু’টো রাগে লাল হয়ে গেছে। একে তো চরের মানুষ তারোপর শক্তিশালী চেহারা। বিনা কারণে বুড়োর মারতে আসাটা সে সহ্য করতে পারে নাই। আমরা সবাই মিলে তাকে টেনে হিঁচড়ে স্কুলের দিকে নিয়ে এলাম। আমরা সেদিন শাহা আলীকে টেনে হিঁচড়ে না নিয়ে এলে সে হয়তো বুড়োকে মেরেই ফেলতো। মেজাজ চড়ে গেলে যে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না সেই দিন শাহা আলীর তান্ডব দেখেই বুঝেছি।
এদিকে বুড়োর চিৎকার চেচামেচিতে পুরো পাড়া হৈচৈ পড়ে গেল। আমরা ততক্ষণে অনেক দূর চলে এসেছি। আমাদেরকে দৌড়াদৌড়ি করে স্কুলে ঢুকতে দেখে হেড স্যার এগিয়ে এলেন। হেড স্যারের কাছে আমরা সব ঘটনা খুলে বললে স্যার কিছুই বলল না। কিছুক্ষণ পরেই কয়েকজন লোক ধুলাবালি মাখানো সেই বুড়োকে নিয়ে স্কুলে হাজির।
তারা খুব চোটপাট করে হেড স্যারের কাছে বিচার দিলো। একে বৃদ্ধকে মাটিতে ফেলে গলায় পাড়া দিয়ে ধরা তারোপরে দুই বিঘা জমির মরিচ ভেঙে ফেলা, দুই অপরাধের কড়া বিচার দাবি করে বসল।
আমাদের স্কুলের প্রভাবশালী শিক্ষক ছিলেন আব্দুল হামিদ স্যার (চেহারা কালো হওয়ায় গ্রামের লোকজন তাকে কালু মাস্টার নামে ডাকতো)। তিনি শুধু শিক্ষকই নন কয়েক গ্রামের মাতাব্বরও ছিলেন। হামিদ স্যার প্রথমেই বুড়োকে প্রশ্ন করলেন, ছোট ছোট বাচ্চাগুলা আগে আপনাকে ঘাড় ধরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে না আপনি তাদের আগে লাঠি দিয়ে তাড়া করেছেন?
স্যারের প্রশ্নে বুড়ো আর কথা বলে না। কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে উত্তর না পেয়ে হামিদ স্যার বত্রিশটা দাঁত খেচে ধমকে উঠলেন-- বুড়ো বয়সেও আপনার শয়তানি যায় না না--হ। ছোট ছোট বাচ্চাদের উপর পালোয়ানী দেখাতে গেছেন। ছোট ছোট বাচ্চারা যে আপনার গলায় পারা দিয়ে জানে মারে নাই এই তো আপনার সৌভাগ্য। আবার আসছেন বিচার নিয়ে- - -- ?
বুড়োর সাথের একজন বলল, চাচা না হয় বুড়ো মানুষ ভুল করেছে, আমি তো বাচ্চাদের কিছু বলি নাই, আমার দুই বিঘা জমির মরিচ ভেঙে যে শেষ করল আমার মরিচ ক্ষেতের কি হবে?
হামিদ স্যার তার উপরেও চটে উঠলেন, ধমক দিয়ে বললেন, এই রকম একজন বয়স্ক মানুষ লাঠি নিয়ে ধাওয়া করলে বাচ্চারা কি ওখানে মাইর খাওয়ার জন্য বসে থাকবে? ওরা জান বাঁচানোর জন্য জ্ঞান শূণ্য হয়ে দৌড় দিয়েছে। মারের ভয়ে দৌড় দেয়ার সময় কি কারো ধান ক্ষেত আর মরিচ ক্ষেতের কথা মনে থাকে? এখানে বাচ্চাদের কোন দোষই দেখি না। আমি যা দেখতেছি সব দোষ এই বুড়োর। এই বুড়োকে জিজ্ঞেস করেন মরিচের কি করবে?
স্যারের যুক্তির কাছে আর টিকতে পারল না। অবশেষে বুড়োকে সবাই ধমকাতে ধমকাতে বাড়ির দিকে চলে গেল। এদিকে শাহা আলীকে হেড স্যার পাশের ক্লাসে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কারণ আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের নিয়ে সমস্যা ছিল না কিন্তু শাহা আলী যেহেতু বয়সে বড় তাকে নিযে সমস্যা ছিল। এত বড় মানুষকে তারা বাচ্চা হিসাবে কখনই মানবে না, বুড়োকে গলায় পাড়া দেয়ার বিচার তারা করেই ছাড়বে, এই ভয়েই স্যার তাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এই ঘটনার পরে স্যার আর আমাদের চাল তুলতে পাঠান নাই। তবে পাঁচ দিনেই আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রায় পৌনে দুই মনের মত চাল তুলেছিলাম। তিন ক্লাস মিলে কমপক্ষে ছয় মণের মত চাল সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই চাল বিক্রি করেই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছিল। খেলার পুরষ্কার মন্দ ছিল না। প্রত্যেক খেলায় তিনটি করে পুরুষ্কার ছিল। প্রথম পুরুষ্কার একটি টিনের প্লেট, দ্বিতীয় পুরুষ্কার একটি কাঁচের গ্লাস, তৃতীয় পুরুষ্কার একটি এক্সার সাইজ খাতা অথবা কাঠের পেন্সিল। এভাবেই খেলাধুলায় পুরুষ্কার দিয়ে আমাদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তখন আমাদের কাছে এই সামান্য পুরুষ্কারই অনেক দামী মনে হতো। কারণ যে কোন খেলায় প্রথম হলেই পুরো স্কুল জুড়েই হাত তালি দিয়ে তাকে বাহবা দেয়া হতো। পুরুষ্কার যেমন তেমন পুরো স্কুল জুড়ে বাহবা পাওয়াটাও কম গৌরবের ছিল না।
শাহা আলীকে বেশি দিন স্কুলে পাইনি। মাত্র সাত আট মাস ক্লাস করার পরে আর কখনও স্কুলে আসে নাই।
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন--
প্রাইমারী স্কুলের বিবাহযোগ্য ছাত্র ছাত্রী এবং কিছু ঘটনা (২)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৭