পড়ন্ত বিকেল ,গৌধুলির মায়াময় আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। জান্নাত বান্ধবীদের বাড়ি থেকে ফিরছিল। জ্বর থাকায় কলেজে যায়নি কয়েকদিন। তাই গিয়েছিল নোট আনতে , গিয়ে শুনে ক্লাস নাকি হচ্ছেনা তেমন ,দেশের অবস্থা নাকি খারাপ । সামিকে দেখে থমকে দাঁড়ায় ,কতদিন দেখেনি তার স্বপ্নের রাজপুত্রকে!একই গ্রামের মাষ্টার চাচার ছেলে সামি ,ছোট থেকে একসাথে খেলতে খেলতে কখন যে দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলেছে টেরই পায়নি । সামি ঢাকা থেকে ফিরছিল।
কি ব্যাপার জান্নাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস যে ?
তোমাকে দেখছি !
মনে হচ্ছে জীবনেও দেখিসনি ?কোথায় গিয়েছিলি ?
এইতো স্বর্ণাদের বাড়ি ,দেশের অবস্থা কি এমন খারাপ হচ্ছে সামি?কি শুনছ?
হ্যাঁ জান্নাত দেশের অবস্থা আসলেই খারাপের দিকে যাচ্ছে ,ঢাকায় এখন চরম আতঙ্ক ,আর এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশেই ! পাকিস্তানিদের অত্যাচারে অতিষ্ট সব । যুবকদের বুকে বাজছে যুদ্ধের দামামা । কিছু একটা হবেই জান্নাত।
আমার যে খুব ভয় করছে সামি!
ধুর পাগলি !ভয় কিসের ?যা হওয়ার তাতো হবেই ,তাছাড়া আমিতো আছিই !
তুমি থাকবেতো সামি ?সারাটা জীবন আমার পাশে ?
আমিতো তাই চাই জান্নাত , আমি তোকে হারাতে চাইনা কোনদিন ।কিন্তু চাচাযে কিছুতেই মেনে নিবেনা আমাদের ভালবাসাটা ।তিনি কিভাবে জেনেছেন ?
কই জানিনাতো .আমাকে কিছুই বলেনি ।
এখনতো আমাকে দেখলে পারলে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন আরকি !বলেই হেসে উঠে সামি ।জান্নাত মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখে ।হাসিটা তার ভীষণ প্রিয় । বাবার কথা শুনে জান্নাত কিছুটা ঘাবড়ে যায় বলে ,তুমি হাসছো সামি ? কতটা কি করতে পারবে তুমি ? আমাদের সামনে যে কঠিন বিপদ ।বাবা যে অহংকারি।
দেখ জান্নাত এতকিছু ভেবে কাজ নেই ।আমরা দুজন ঠিক থাকলেই হলো । আমাদের মনতো অভিন্ন । তবে এখন দেশের জন্য চিন্তা হচ্ছে কিছু একটাতো করতেই হবে জান্নাত । সামির চোখেমুখে দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে উঠে।
যাই মা খুঁজবে ,ভাল থেকো সামি বলেই জান্নাত বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় । সামি ও যায় মিটিংয়ে ,দেশের এই অবস্থায় তো চুপ করে বসে থাকা যায়না।
মিটিংয়ে গিয়ে জানতে পারে ঢাকায় নতুন পতাকা উড়ানো হয়ে গেছে । সেনাবাহিনির সাথে চলছে ছাত্রদের তুমুল সংঘর্ষ ,ছাত্রদের মিছিলে চলছে রক্তের বন্যা । দোকানপাট অফিস আদালত যেন মৃত্যুপুরী ,চারিদিকে চরম আতঙ্ক । বাংলার মানুষ আজ মুক্তি চায় ।
জান্নাতও পোষ্টার লিখছিল সামিদের সাথে কলেজে । একটু পরেই মিছিল শুরু হবে .সবাই একে একে পোষ্টার নিয়ে বেরিয়ে যায়।
সামি জান্নাতকে বলে, মিছিলে যাবিনা ?
ইচ্ছে করছেনা, .শুনলাম তুমি নাকি যুদ্ধে যাচ্ছ ?
হ্যাঁ । ঠিকই শুনেছিস ।
ভয় করছেনা সামি ওরা যদি আক্রমণ করে ? শুনলাম চেয়ারম্যানের লোকেরা চারিদিকে পাহারায় আছে ,তারা নাকি তোমাদের লিষ্ট করছে । আমার খুব ভয় করছে সামি .তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব ? তোমার কি একটুও কষ্ট হবেনা আমায় ছেড়ে থাকতে?
জান্নাতের ভালবাসা মিশানো কথাগুলো সামিকে তেমন আলোড়িত করেনা । এই মেয়ে কি করে বুঝবে সামনে কি ভয়াবহ সময় আসছে? ওর মনে ভালবাসা ছাপিয়ে শুধু জেগে থাকে দেশপ্রেম। দেশের এই অবস্থায় ও কি করে নিজের ভালবাসার কথা চিন্তা করবে ? সামিকে চুপ থাকতে দেখে জান্নাত বলে, কি ব্যাপার চুপ করে কি ভাবছো ?
ভাবছি তুই আমাকে এতটা যে ভালবাসিস যুদ্ধ গিয়ে যদি মরে যাই ? জান্নাত সামির মুখ চেপে ধরে বলে, ছি !সামি ওমন অলুক্ষণে কথা বলোনা ,খোদা নিশ্চয় এতটা নির্দয় হবেননা । বিয়ের আগেই তবে যে আমি বিধবা হয়ে যাব । তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমার জীবনে আসবেনা সামি।
একি বলছিস পাগলি? দেশতো আগে স্বাধীন করি ,দেখা যাবে তখন কে কাকে কতটা ভালবাসতে পারে।
কেন আমাদের এই প্রেম থেকে কি দেশপ্রেম বড়?
অবশ্যই বড় ।
অসম্ভব আমি মানিনা ।
একটু বুঝতে চেষ্টা কর জান্নাত, তোর আর আমার ভালবাসার অনেক সময আসবে কিন্তু দেশের এই কঠিন অবস্থায় আমি কাপুরুষের মত পালিয়ে থাকতে পারবনা । আমাকে যেতেই হবে জান্নাত ,কাল সকালে চলে যাব।
কালই ? কিছুদিন পর গেলে হয়না সামি ? ভুলে গেছ কিছুদিন পরেইতো ......!
নারে ভুলিনি ,আমি যেখানেই থাকি সেদিন অবশ্যই তোকে একটিবারের জন্য হলে ও দেখা দিয়ে যাব ,তোর জন্ম দিন আমি ভুলেছি কোনদিন ?
পরদিন খুব ভোরে জান্নাত ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, কেউ জাগেনি এখনো , কিন্তু ও ঘুমায়নি সারারাত কেঁদেছে । সামির বন্ধুরা সব নৌকায় উঠে গেছে ,জান্নাতকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ায় সামি । জান্নাত কান্নায় কথা বলতে পারেনা। সামিও কিছুটা নার্ভাস হয়ে যায়,নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কেঁদোনা জান্নাত,তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর, আমি আসবই ! যেখানেই থাকো আমি তোমাকে খুঁজে নিবো । সাবধানে থেকো!
বলেই দ্রুত পায়ে নৌকায় উঠে যায় , চোখ উপচে পড়ে জলে , একটি বারের জন্য ও পিছন ফিরে দেখেনা ও,মায়ায় জড়াতে ওর বড্ড ভয় । জান্নাত কাঁদতেই থাকে।
চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে তুমুল যুদ্ধ ,সামিরা ভয়াবহ অপারেশনে ব্যস্ত । হঠাত্ সামির মনে পড়ে আজ জান্নাতের জন্মদিন।বড্ড জেদী আর অভিমানি মেয়েটা । এদিকটা ম্যানেজ করে বন্ধু সাগর কে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা
দেয়।
ওরা যখন গ্রামে ঢুকে, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে । দূর থেকে দেখে মানুষজন কেমন পাগলের মত ছুটাছুটি করছে! কিছু বাড়ি থেকে আগুনের ফুলকি উঠছে। যেন দাউদাউ করে ঝলছে গোটা গ্রাম । ওরা মুহুর্তকাল থমকে দাঁড়ায়,ফের দৌঁড়াতে শুরু করে। পথে বুড়া একজন কে পেয়ে থামিয়ে বলে, কি হইছে চাচা ?
বাবারে মিলাটারি আসছে ! সব জালিয়ে দিয়েছে , যুবকদের মেরে ফেলেছে .যুবতি মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের লোকেরা আছে সাথে।
সামি কথাটা শুনে চমকে উঠে ,ওর জান্নাতের কিছু হলনাতো ? ওরা জান্নাতদের বাড়ির দিকে দৌঁড়াতে থাকে। গিয়ে দেখে জান্নাতদের উঠানে ওর ভাইয়ের লাশ । বাড়িঘর পুঁড়ে ছাই ,সামি ওর বাবাকে দেখে ওদের বাডির অবস্থা জানতে চায় .ওর বাবা বলে সবাই পালাতে পেরেছিল .তবে বাড়িঘর পুডিয়ে দিয়েছে । সামি জান্নাতকে খুঁজে সবাই জানায় ওকে মিলিটারি রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে । আর বাবা মা কোথায় জানি পালিয়ে গেছে ,সামি পাগলের মত কাঁদতে থাকে .ওকে নানা জায়গায় খুঁজতে থাকে .কিন্ত জান্নাতকে যে তখন ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে !
সেই রাতে জান্নাতের দিকে তাকানোর খুব একটা সুযোগ পায়নি খান সেনারা । চারিদিকে শুধু গোলাগুলি । পথে পথে অফিসার বার কয়েক ওর দিকে তাকিয়ে হাসছিল ,মানুষের হাসি যে এত অশ্লিল হতে পারে তা জান্নাতের আগে জানা ছিলনা । সারারাত কিছুই পেটে পড়েনি ,পরদিন ওকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ক্যাম্পে ,সেখানে ওকে নিয়ে বসে ভোগের আসর .নারী ও পুরুষ যেন খাদ্য ও খাদক ! অফিসারের চোখে কামার্ত দৃষ্টি ! আঠার বছর লুকিয়ে রাখা সমস্ত ঐশ্বর্য যেন মুহুর্তেই গ্রাস করে ফেলে শয়তানরুপি পিশাচরা ! ও চিত্কার করে কাঁদতে কাঁদতে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে নিজেকে কেমন যেন অধম মনে হয় ওর কাছে । সারা শরীরে যন্ত্রণা ,সেই সাথে প্রচন্ড ক্ষুধার কষ্ট । এখনে তার মত এমন হতভাগি আর ও অনেক । মোটা একটা মহিলা ওর জন্য কাপড় আর কয়েকটা রুটি নিয়ে আসে । ও গোসল সেরে পাগলের মত গিলতে থাকে! ক্ষুধার যে এত কষ্ট তা আজই বুঝতে পারে ।
প্রতি রাতেই চলতে থাকে এমন নির্মম অত্যাচার! প্রতিদিন নতুন করে মৃত্যু হয় যেন জান্নাতের। ওর চোখে ঘুম নেই। ও কাঁদে আর সামির কথা ভাবে। সামি কি আসবে ওকে ফিরিয়ে নিতে? রাত জেগে ও আকাশের চাঁদ দেখে , চাঁদের আলোও ওর অসহ্য লাগে ।
যে সব কুমারি মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে যায় তাদের গর্ভপাত করা হয়। প্রতিদিন কত মেয়ে সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে! কেউবা আবার বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। শুরু হয় নিত্য নতুন অত্যাচার ।
জান্নাতেরও পালা আসে এক সময়। ও নির্বিকার ভাবে সব সয়ে যায়,যেন এছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। কিইবা করতে পারতো সে?
একসময় যুদ্ধ শেষ হয়, মুক্তিবাহিনী বুক ফুলিয়ে রাজপথে জয়ের মিছিল করে। স্বাধীন দেশে ওরা তখনও অসহায়ের মত পড়ে থাকে। সবার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়! জান্নাতের বাবা আসে একদিন। অনেকদিন পর বাবাকে দেখে জান্নাত জড়িয়ে ধরে কেদে উঠে। বলে, বাবা ,মা কেমন আছে ?
আছে ভাল আছে! তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখে ছানি পড়ে গেছে ।
আজ আমাকে নিয়ে যাবে বাবা? কতদিন মাকে দেখিনা ।
মেয়ের কথা শুনে বাবা আমতা আমতা করে বলে ইয়ে মা আর কিছুদিন তুই এখানে থাক, আমি তোকে ঢাকার কলেজে ভর্তি করিয়ে হোষ্টেলে দিয়ে আসব!
জান্নাতের আশেপাশের সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়; ও চিত্কার করে কেঁদে বলে, নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে লজ্জা পাও বাবা? জান্নাতের বাবা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। জান্নাত আবার প্রশ্নটা করলে বলেন, তোকে নিয়ে গেলে তোর ছোট বোনদের বিয়ে দিতে পারবনা মা। আমাকে ক্ষমা করিস .বলে ধীর পায়ে বেরিয়ে যান। জান্নাত লুটিয়ে পড়ে কান্নায়। একটু পরই সামি আসে; ও অস্থির হয়ে জানতে চায় কি হয়েছে জান্নাত? চাচাকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম ।
সামি আমাকে নিয়ে গেলে উনাদের জাত যাবে , তাই রেখে গেলেন। বলে জান্নাত আবারও কাঁদতে খাকে।
সামি ওকে দুহাতে তুলে দাঁড় করায়। বলে, কাঁদছিস কেন পাগলি? তুই না চিরদিন আমার পাশে থাকতে চেয়েছিলি? চল আজ আমরা দেখিয়ে দেই কে কাকে কতটা ভালবাসতে পারি! যাবিনা জান্নাত?
জান্নাত অবিশ্বাস্য চোখে সামির দিকে তাকায়। এমন মানুষও আছে দুনিয়ায়? একসময় ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, আমি যে নষ্ট হয়ে গেছি সামি ,আমাকে তুমি ঘৃণা করবেনাতো কোনদিন ?
সামি হেসে বলে, ধুর পাগলি! এটাতো যুদ্ধরই একটা অংশ। আজ থেকে আমাদের দুজনেরই যুদ্ধ শেষ। আমরা ফিরে যাব আমাদের শান্তির নীড়ে।
দুজনের এই শুদ্ধতম ভালবাসা দেখে স্বাধীন বাংলার মানুষ আরেকবার বিজয়ের হাসি হাসে ।।
###################################################
ভালোবাসা যেমনি হোক যে অবস্থার হোক, ভালোবাসার মানুষকে শুধু ভালোবাসা যায়। কোনোদিন তাকে হারিয়ে ফেলার কথা মনে আনাও ঠিক না। কারন, ভালোবাসা অনেক মূল্যবান একটা অনুভূতি, সবার কপালে ভালোবাসা থাকেনা। তাই কোনোদিন ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে নেই। এই গল্পে প্রতীকি একটা উদাহরন দেয়া হলো বিজয়ের মাস উপলক্ষ্যে বিজয়ের আদলে। ধন্যবাদ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




