কায়দা করে কলা খাওয়াটা এক বিশেষ ধরনের শিল্প। চিড়িয়াখানায় উৎসুক জনতার ছুড়ে দেয়া কলাটা সুন্দর করে ছিলে খাওয়াটা যে যথেষ্ট আদবের মধ্যে পড়ে সেটা খাঁচার বাদরটা জানলেও চায়ের টং-এ আমার পাশে বসে থাকা লোকটা এ ব্যপারে মোটেও শৈল্পিক নয়। পুরো আস্ত একটা ধামড়া সাগরকলা একেবারে ন্যাংটো করে চা বিস্কিটে ভিজিয়ে খাওয়া হালজামানায় চরম অভদ্রতা তো বটেই বরং খোঁজ নিলে জানা যাবে অতীতে কোনো রাজার হুকুম ছিলো এহেন কলার অসম্মান চরম শাস্তিযোগ্য। আগের যুগে রাজারা অনেক অদ্ভুত আইন করে রাখতেন। রাজা তিলোত্তোরাজ তার ঘুমের ব্যাঘাতের জন্য এমন আইন করেছিলেন যার বলে তার স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো শব্দে যদি তার ঘুম ভাঙ্গে তো তার আঙ্গুল কাটা যাবে! তবে হ্যা কলা,বিস্কিট আর চা এই তিনটা জিনিসের সাথে একটা বিশেষণ যেটা না দিলেই নয় সেটি হলো "উত্তম ক্ষুধানিবারক"। লোকটার জিপার খোলা। এই অবস্থায় বলা ঠিক হবে কিনা বুঝে উঠতে পারছি না।
আপনার জিপার খোলা,কেও দেখে ফেলার আগেই গেটে শেকল দেন!
লোকটা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমরা সবাই জিপার লাগিয়ে মহা অসভ্যতামি করে ফেলেছি!
চেইন কাটা ভাইসাব। তয় কোনো সমিস্যা নাই, পিসাব করতেও সুবিধা। অতীত জামানার লোকেরা এইদিক দিয়া বহুত সুবিধা পাইসে। তাগো কাপড় আর খাইদ্য নিয়া চিন্তা করতে হয় নাই।
বাহ! আপনি তো মানুষের জন্য অনেক গভীর চিন্তা করেন!
না ভাইসাব। মানুষ মানুষের চিন্তা করে না। মানুষের থাইকা কুত্তা ভালা। কুত্তার মুখের পিছে মুখোশ নাই। মানুষ নিজের বুঝ ছাড়া কিছু বুঝে না। তয় জানেন ভাইসাব মানুষ জন্ম থাইকা যেই জিনিসটা সবচেয়ে ভালোবাসে ঐ জিনিসটার কারনেই হ্যায় মইরা যায়।
লোকটা এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ভাইসাব বলে ফেলেছে।এটা ঘনিষ্ট হতে চাওয়ার লক্ষন। তার শেষ কথাটা উচ্চমার্গীয় দার্শনিক টাইপ কথা বার্তা। মানুষেরা ছোটবেলা থেকে আমার আমিকে সর্বোচ্চ আগলে রেখে নিজ দেহের কাছে পরাজিত হয়ে আত্মার খাঁচা হারায়, অথচ এই খাঁচার জন্য সারাজীবন কতোই না সাধনা। মহাপুরুষদের এসব লোক এড়িয়ে চলতে হয়। কেন এড়িয়ে চলতে হয় এটা জানিনা তবে বাবার নিষেধ অমান্য করা ঠিক হবে না।
বিল দিয়ে আপাতত আমার পকেটে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর টাকার একটা নোট আর একটা লজেন্স আছে। লজেন্স এখন খুচরা টাকার পরিবর্তে ব্যাপক জনপ্রিয়, স্বীকৃতি দিতে শুধু বঙ্গবন্ধুর একটা জলছাপ লজেন্সের প্যাকেটে দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। আজকের রোদের কারণে বাড়াবাড়ি রকমের গরম পড়েছে। প্যাচপ্যাচে ঘামে আমার হলুদ পাঞ্জাবীর কালার হয়েছে ড্যাফোডিল ইয়েলো। কালারটার নাম যা বলেছি তা ছেলেদের কাছে বুঝতে পারাটা কঠিন হলেও মেয়েদের কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না! ছেলেদের কাছে যেটা গোলাপি সেটা মেয়েদের কাছে যথাক্রমে পিঙ্ক স্কারলেট, রুবি, ব্লাশ, ম্যাজেন্টা, সলমন ইত্যাদি। মাজেদা খালার কোনো এক পরিচিত মেয়ের বিয়ের বাজারে গিয়ে এসব শিখেছি।
আরে হিমু ভাই! কতোদিন পর আপনার সাথে দেখা!আপনারে আমি বহুত খুজছি! আইজ কোনো ছাড়াছাড়ি নাই!
আমি তো ভাই পথের মানুষ পথেই থাকি, সমস্যা হয় না। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না।
আইজ আর কোনো কথা হবে না হিমু ভাই! আপনে আমারে না চিনলেন, আমি কিন্তু আপনারে ঠিকই চিনছি! এই গরিবের ঘরে দাওয়াত না নিলে কুকুরের পিশাব খেয়ে মারা যাবো বলে দিলাম।
এই সময় আর তোমাদেরকে বিরক্ত না করে আমি না হয় আমার পথ ধরি হারু মিয়া?
এইযে আপনে চিনতে পারছেন! তয় এইডা একটা কথা কইলেন হিমু ভাই? যেদিন আপনের কথায় বিরক্ত হমু সেইদিন যেন শকুনে আমার চক্ষু তুইলা নিয়া যায়! আপনে ঐদিন আমার চক্ষু না খুইলা দিলে আইজও আমি হারাম পয়সা কামাইতাম। আপনের লাইগা আমি আইজ খাইটা খাওয়া ভালা মানুষ!
হারু মিয়ার থেকে নিস্তার পেলাম না। অবস্হা এমন যেন আমি নিজ ইচ্ছায় না গেলে প্রয়োজনে সে ক্রেন পর্যন্ত নিয়ে আসবে। হারু মিয়ার সাথে পরিচয়ের কাহিনীটা অনেক মজার। একদিন রাতে আগাঁরগাও বস্তির পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাত কোথা থেকে দুই জন রাস্তা আটকালো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ছুরি দাগিয়ে বলে যা আছে বের কর!আমার ব্যাগে ছিলো খালু সাহেবের দেয়া একটা একশ টাকার কড়কড়ে নোট, একটা মোমবাতি, একটা ম্যাচ, একটা আধখাওয়া নানরুটি আর এক পোটলা জিলাপি। সব কিছু দেখে দুই জন খুব একটা খুশি হলো বলে মনে হলো না। একজন সামনা সামনি প্যাকেট খুলে জিলাপি খাওয়া শুরু করলো। একটা খাওয়া শেষে আরেকটা যখন খেতে যাবে তখনই কিনা তার মুখের হা আর বন্ধ হয় না! নানা হম্বিতম্বি করেও বেচারা হা আর বন্ধ করতে পারে না। এদিকে পাশের জন রীতিমত ছুরি দেখিয়ে আমাকে ঠিক করিয়ে দিতে বলছে। আমি বললাম বাবার মাজারের জিলাপি খারাপ কাজের পর খেলে বাবা সেই মানুষকে কষ্ট দেন। নিয়্যত ভালো করে তওবা করে পশ্চিম দিকে ঘুরে পাঁচশবার কানে ধরে উঠবস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। তারা আমাকে যাচ্ছেতাই গালি দিয়ে ধরে নিয়ে গেলো কাছেধারে একটা ফার্মেসিতে। ফার্মেসিতে যিনি ছিলেন তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন বিশাল অপারেশন ছাড়া এটা ভালো হবার নয়। তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেন।
শেষ পর্যন্ত বেচারা হারু মিয়া সেইরাতেই পাঁচশবার কান ধরে উঠবস করে হড়হড় করে বমি করে দিলো। জ্ঞান ফেরার পর আজই তার সাথে প্রথম দেখা। ঐদিন জিলাপির প্যাকেটটা রহমান এন্ড সন্স মিষ্টান্ন ভান্ডার-এর ম্যানেজার মবিন সাহেব তার দোকানের হালখাতার অনুষ্ঠানের এক ঠোঙ্গা জিলাপি জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে চোয়ালের পেশীতে টান পড়লে মানুষের হা বন্ধ হয় না। এটা খুব একটা জটিল কিছু না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে এক মিনিটের কাজ। তবে ঐদিনের আন্দাজে বলা কথায় কেমন যেন বেশী ভয় পেয়েছিলো হারু মিয়া। আসলে এখানে অলৌকিক কিছুই হয়নি।
হারু মিয়ার বাসা থেকে ভরপেট খেয়ে বের হলাম আবার রাস্তাতে। বিকেলের হালকা বাতাসে খুব আরাম লাগছে।রুপার সাথে অনেকদিন কথা হয় না, দেখা যা হয়েছিলো তাও মাস তিনেক আগের কথা। কথা বলার অত্যাধুনিক যন্ত্রটি আমার নেই। শিক্ষানবিশ মহাপুরুষদের কপর্দকশুন্য থাকতে হয়। পকেটের দুই টাকা দিয়ে কথা বেশি বলাও যাবেনা হয়তো।
হ্যালো! তুমি কি মানুষ? এতদিনে একটা খবর-ও দেবে না!
এই মেয়েটার এই এক প্রতিভা। কথা বলার আগেই বুঝে যায় আমিই ফোন দিয়েছি।
বুঝলে কি করে আমি ফোন দিয়েছি?
তোমার মতো হাঁদারামের পাল্লায় যখন পড়েছি তখন এসব না শিখে উপায় আছে?আচ্ছা তুমি এখন কোথায়? এক্ষুনি আমাদের বাসায় চলে আসো!
এত তাড়াহুড়া কেন বলতো?
তুমি আজ আসবে বলে সকাল থেকে নীল শাড়ি পড়ে বসে আছি তাই।
আমি আসবো তোমাকে কে বললো?
এখন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসো তো!
খট করে লাইনটা কেটে গেলো। ভালোই হলো। এক মিনিটে দুই টাকার উত্তম সদ্ব্যবহার। আমি জানি মেয়েটা সকাল থেকে সেজে আছে। আজ যে হঠাত সেজে আছে তাও না। প্রতিদিনই নীল শাড়িতে সেজে থাকে সে। এবং সে এটাও ভালো করে জানে আজও আমি আসবো না। কোনো এক মহাপুরুষ বলে গিয়েছেন ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল। মহাপুরুষ হতে যাওয়া একটা কঠিন সাধনা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে নির্দিষ্ট কোর্স করেই পার পাওয়া যায়। আর আমার ক্ষেত্রে কোর্স কো-অরডিনেটর আমার বাবা। মহাপুরুষদের নাকি মাঝে মাঝেই ডুব দিতে হয়। আমাকে বুঝি চিরতরেই ডুব দিতে হবে জনমানুষের মাঝে। তবুও একজনের কথায় কাঠের পুতুলের মতো চলতাম। মানুষটা নাকি বাড়াবাড়ি রকমের দূরে চলে গিয়েছেন। চলে গিয়ে হয়ত তিনি ভালোই আছেন। কিন্তু তার জেনে রাখা উচিৎ প্রথমবারের মতো হিমুর মনে হচ্ছে সে আসলেই সর্বহারা...
কিছু কথাঃ নাহ। এটা হুমায়ূন আহমেদের কোনো উপন্যাসের অংশ নয়। তবে সম্পূর্ণটাই হুমায়ূনি ঢং-এ লিখা। তাঁর মতো করে লিখার সাহস কোনো কালেই ছিলো না, এবং ভবিষ্যতে এই ধরণের লিখা লিখব না বটে।
প্রিয় মানুষটির হুমায়ূন অভাব কিছু সময়ের জন্য ভুলিয়ে দিতে সাহস নিয়ে উপরের চেষ্টাটা করে ফেলেছিলাম কিছুদিন আগে।
তবে আজ মনে হচ্ছে মস্তিষ্কে একটি স্বতঃস্ফুর্ত উভমুখী নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার নাম হিমু...
মিসির আলী সাহেব, ভুল বলে ফেললাম?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



