somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আত্মহত্যা করা মহাপাপ

১৩ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে টিপু দীর্ঘ একটা শ্বাস নিল। আজকে টিপুর বায়োপসি রিপোর্ট এসেছে। ডাক্তার যা সন্দেহ করেছিলেন তাই। তার প্রোস্টেটে ক্যান্সারের কোষ পাওয়া গেছে।

ঘটনার শুরু প্রায় ছয় মাস আগে। রাতে বার বার উঠে প্রস্রাব করতে হত, প্রস্রাবের সময় তলপেটে ব্যথাও করত। টিপু প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু যখন প্রস্রাবের সাথে রক্ত পড়া শুরু করল, তখন সে চিন্তায় পড়ে গেল। তবুও তখন ডাক্তার দেখায়নি, আরও কিছুদিন পর গেছে। ডাক্তার হাইপারপ্লেসিয়া না কি এক রোগের ওষুধ দিল, টিপুও নিশ্চিত হয়ে বাড়িতে ফিরে এল।

দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ গেল, রক্ত পড়া বন্ধ হল ঠিকই, কিন্তু ব্যথা কমল না। বরঞ্চ পায়ের শক্তি কমে যেতে লাগল। টিপু সামান্য কাজেই দ্রুত হাঁপিয়ে উঠতে লাগল। বাসার মানুষকে তখনো সে জানায়নি। নিরুপায় হয়ে এক বন্ধুর ডাক্তার বাপের কাছে গেল। তিনি মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন, পুরো একটা দিন ধরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। সবশেষে গম্ভীর মুখে বললেন, 'ছেলে, তোমার ফ্যামিলিতে কারো ক্যান্সার ছিল?' টিপু কেঁপে উঠল। ক্যান্সার? তার ক্যান্সার হবে কেন?

-'না, সার'।
-'তাহলে প্রোস্টেটে একটা বায়োপসি করাবে, ঠিক আছে? এই সপ্তাহের মধ্যে। রেজাল্ট পেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করবে।'

তার কথার মাঝে প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত ছিল। টিপু তাঁকে কিছু বলেনি। বন্ধুকে ধরেছিল। অনেক চাপাচাপির পর বন্ধুটা মুখ খুলেছিল, বলেছিল ওর বাপের ধারণা টিপুর সম্ভবতঃ প্রোস্টেট ক্যান্সার হয়েছে। বায়োপসি করালে নিশ্চিত হওয়া যাবে। বায়োপসির দুই সপ্তাহ পর এই আজকে রেজাল্ট পেল টিপু। পজিটিভ।

এই দুই সপ্তাহ টিপু ঘর থেকে বেরোয়নি। শুধু ভেবেছে। তার পরিবার খুব একটা সচ্ছল নয়। টিপুর বাবা এখনো চাকরি করছেন, ওর বড়ভাই ব্যাংকে সদ্য একটা পদ পেয়েছে। টিপু বেঁচে না থাকলেও পরিবারটা দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু যদি তার ক্যান্সার সত্যিই হয়ে থাকে, তবে তার পেছনে টাকা ঢালতে ঢালতে পরিবার সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যাবে। ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক খরচসাধ্য। বহুবার নিজের সাথে বোঝাপড়া করে শেষমেশ টিপু ঠিক করেছিল, ক্যান্সার না হলে তো বেঁচেই গেল, কিন্তু ক্যান্সার হয়ে থাকলে এই দূষিত জীবন সে আর রাখবে না। মরে যাবে। মরণের সাথে যুদ্ধ করতে অস্ত্র লাগে, সেই অস্ত্র- মনোবল আছে ওর। কিন্তু অস্ত্রের ব্যবহার সে জানে না - টাকা কই? আর কটা দিন ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার লোভে পরিবারকে নিঃস্ব করে যাবার মত অমানুষ টিপু নয়।

সে ছাদের রেলিংয়ের ওপরে দাঁড়াল। পা টলমল করছে, আর কি বাতাস, যেন ছোঁ মেরে ফেলে দেবে! টিপু সাবধানে সামলে দাঁড়াল, আত্মহত্যা করতে এসে অন্ততঃ বাতাসের ধাক্কায় সে মরতে চায় না। ভবনটা কত উঁচু হবে? পনের তলা? বিশ তলা? এত উঁচু থেকে নিচে গাড়িঘোড়া কেমন ছোট ছোট, অস্পষ্ট লাগছে। টিপু বুকভরে বাতাস নিল, শেষবারের মত দেখে নিল ওপরের নীল আকাশ, তারপর ভাবল, তাহলে নিচের দৃশ্য ভালমত দেখা যাক? হাঁটু ভাঁজ করে সে লাফিয়ে পড়ল শূন্য বাতাসে!

প্রবল বাতাসের ঝাপটা, নাকি ডেকে আনা নিশ্চিত মৃত্যুর ভয়ে, কে জানে - লাফ দেবার তিন-চার সেকেন্ড বাদেই টিপু অজ্ঞান হয়ে গেছিল। দমবন্ধ করা কেমন একটা টায়ার-পোড়া গন্ধে ওর জ্ঞান ফিরল। প্রথম কয়েক মিনিট চোখ খোলার চেষ্টা করল টিপু। কাজ হল না। তারপর হাতপা নড়াতে চাইল। কিন্তু ওগুলো যেন অন্য কারো অধীনে আছে এখন, টিপুর মস্তিস্কের নির্দেশ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাথরের মত পড়ে রইল। হতাশ হয়ে বাজে একটা গালি দেবে এমন সময়ই বিদ্যুৎচমকের মত টিপুর মাথায় এল, আরে! ও বেঁচে আছে!

এটা কিভাবে সম্ভব?

টিপুর স্পষ্ট মনে আছে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাতাসে, বাতাসের ঝাপটা তার চোখেমুখে প্রবল বেগে লাগছিল। তখনই তার কেমন যেন দুর্বল লাগতে থাকে, নিচে ক্রমশ বড় হতে থাকা শহরের খুঁটিনাটি চোখের সামনে থেকে মুছে যায়। তারপর আর কিছু মনে নেই ওর।

এমন অবস্থায় কেউ কি বেঁচে যেতে পারে? বিজ্ঞানের পড়ন্ত বস্তুর সূত্র মেনেই একটা পাথরের মত তার নিচের কঠিন মাটিতে আছড়ে পড়ার কথা, মাথাটা তরমুজের মত ফেটে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ভবলীলা সাঙ্গ হবার কথা। কিন্তু সেটা যে হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। শরীর আংশিক প্যারালাইজড হয়ে থাকলেও যেভাবেই হোক টিপু একশ ভাগ বেঁচে আছে, এবং একটা কিছুর ওপরে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিন্তু কোথায় আছে ও? মরিয়া হয়ে এবারে সিসার মত ভারি চোখের পাতা খোলার চেষ্টা করতে লাগল টিপু। একটা সময় চোখ খুলে তাকাতেও পারল।

অন্ধকার।

ধীরে ধীরে হাত পা নড়ানোর ক্ষমতা ফিরে আসছে ওর, কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে সোজা হয়ে বসল। এতক্ষণ পাথুরে কিন্তু সমতল কোন একটা কিছুর ওপরে শুয়ে ছিল সে। স্থির হয়ে বসার কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে অন্ধকার চোখে সইয়ে এলো। এখন আবছা আবছা অনেকটাই দেখতে পাচ্ছে টিপু। চারপাশে ঠিক অন্ধকার নয়, তার বাম পাশে অজানা কোন উৎস চুইয়ে চুইয়ে এক প্রকার কমলা-বাদামি আলো উদগিরণ করছে। সেই আলোতে উঁচুনিচু মেঝে, ওপরে ছাদ এবং চারপাশে দেওয়াল দেখা যাচ্ছে। সবই পাথুরে। জায়গাটা সম্ভবতঃ কোন গুহা।

তিব্বতি কোন সাধু মৃতপ্রায় ওকে হিমালয়ের দুর্গম, পবিত্র কোন গুহায় এনে চিকিৎসা করছে?

বিষয়টা ভাবতেই এর মধ্যেও টিপুর হাসি পেল, সাথে সাথে মাথায় চিনচিন ব্যথা করতে লাগল। সে দুহাতে মাথা ধরে টলতে টলতে কোনমতে আলোর উৎসের দিকে হাঁটতে লাগল। আলোর আকার বড় হতে লাগল, কিছুক্ষণ পরেই টিপু গুহার মুখের কাছে পৌঁছে গেল।

কি বিশ্রী রবার-পোড়া গন্ধ! আর কি চোখ ধাঁধানো রোদ! হাত দিয়ে ও চোখ ঢেকে ফেলতে বাধ্য হল। গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে। বমি হয়ে যাবে বোধহয়! ভাবতে না ভাবতেই টিপু ওয়াক ওয়াক করে একগাদা পিত্তরস মিশে হলুদ হয়ে যাওয়া বস্তু পাথরের ওপর বমি করে ফেলল। তাকিয়ে বুঝতে পারল সকালে খাওয়া ডাল-ভাতের অবশিষ্টাংশ ওগুলো। ইস কি বাজে গন্ধ!

টিপু মুখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াল, এবং সামনে তাকিয়ে আরেকবার ধাক্কা খেল। এই জায়গাটা...কোথায়??

যতদূর চোখ যায় শুধু পাথুরে সমতল জায়গা। এখানে ওখানে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে নানা আকারের বিশাল বিশাল সব পাথর, প্রত্যেকটা টিপুর পেছনে গুহার ছাদ থেকে বহুগুণ বড়। দিগন্ত সীমার কাছে, অনেক দূরে, বাদামি-কালচে রঙের একটা কিছু শুয়ে আছে। চারপাশে কোন প্রাণের চিহ্ন নেই। কিছু নড়ছে না, সরছে না, স্রেফ টিপুর চোখের সামনে সবকিছু দাঁড়িয়ে আছে, থেমে আছে।

রোদটা আসছে কোত্থেকে? টিপু সাহস করে উপরের দিকে তাকাল। আকাশে যা দেখবে আশা করেছিল তার কিছুই দেখতে পেল না। আকাশের রং ওর পায়ের নিচে পাথুরে জমির মতই, কমলা-বাদামি। আকাশে কোন সূর্য নেই, কিচ্ছু নেই, সমস্ত আকাশ থেকে একজোটে রোদ এসে জমির ওপর হামলে পড়ছে। জায়গাটা পৃথিবী নয়, টিপু নিশ্চিত হল।

এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকায় টিপুর চোখ জ্বালা করতে লাগল। পোড়া গন্ধটা আরও জোরদার হয়েছে, ওর পেট শক্ত হয়ে গেল। তারপর আবার হড়হড়িয়ে বমি হয়ে গেল। তারপর আবার। তারপর আবার। টিপু বুঝতে পারল বাইরের পরিবেশে থাকলে ও বমি করতে করতেই মারা যাবে। পা ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে কোনোমতে নিজেকে গুহার ভেতরে টেনে নিয়ে এল, তারপর তেতো মুখেই ঘুমিয়ে পড়ল।

কতক্ষণ পরে ওর ঘুম ভেঙেছে টিপু বলতে পারবে না। ফুলে যাওয়া ঠোঁট আর অবশ বাম হাত নিয়ে যখন ও জাগল, মাথায় একটাই চিন্তা, খাবার! এত ক্ষিধে কোনোদিন লাগেনি ওর। ঘষটে, দৌড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়েছে, ভীষণ গন্ধ আর রোদ উপেক্ষা করে খাবার খোঁজা শুরু করেছে। আশ্চর্য হলেও, ওকে বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি। গুহা থেকে একটু দূরে দুটো পাথরের গায়ে হলুদ রঙের এক ধরণের খসখসে উদ্ভিদ-জাতীয় একটা কিছু পেয়েছে ও। আরেকটু খুঁজতেই পাথরের আড়ালে গরম রংহীন তরলের একটা উষ্ণ প্রস্রবণও পাওয়া গেছে। বিষাক্ত কিনা তা পরীক্ষা করার মন মানসিকতা টিপুর ছিল না। আর সেখানেই হয়েছে বড় ভুল।

দুহাতের আঁজলা ভরে খেয়েছে ও, শুকনো ঠোঁট আর ফুলে ওঠা জিহ্বা সাথে সাথে তরল পদার্থটা শুষে নিয়েছে। তরলটা গলায় পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই ওটার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে ওর মুখ ভরে গেছে, পুরো মুখটা জ্বালা করে উঠেছে। থুঃ থুঃ করে তরলটা ফেলে দিয়ে গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করেছে টিপু। বমি করার সময় পুরো শরীরে অনিয়ন্ত্রিত একটা ঝাঁকি শুরু হল, দুর্বল শরীরে ওই ঝাঁকি সহ্য করতে না পেরে বমি করতে করতেই একটা সময় টিপু অজ্ঞান হয়ে পাথুরে জমিতে পড়ে গেল।

প্রথমদিকে এভাবে কতবার যে বমি করেছে আর কতবার যে অজ্ঞান হয়ে গেছে, সে তা বলতে পারবে না। শুধু জানে, প্রত্যেক বার ঘুম ভাঙার পর ওর প্রচণ্ড খিদে পায়, তখন ওই বিষাক্ত ফুটন্তপ্রায় তরল আর খসখসে উদ্ভিদ খুঁজে খুঁজে তাঁকে খেতে হয়। এখন নির্দিষ্ট একটা পরিমাণে খেলে জিনিসটা টিপু কোনোক্রমে পেটে রাখতে পারে। বেশি খেলে আবার বমি হয়ে যায়। এই দুটো ছাড়া আশেপাশে কোন খাওয়ার মত কিছু নেই, টিপু খুঁজে দেখেছে। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ মাথা পরিষ্কার থাকে, তারপর খুব ঘুম পায়। বাইরে থাকতে পারে না ও, সেই রবার-পোড়া গন্ধের মাঝে বেশিক্ষণ থাকলেও বমি হয়ে যায়। গুহায় গন্ধটা কম, সেই প্রথম যে সমতল জায়গায় ঘুম ভেঙেছিল ওর, সেখানেই ঘুমায়।

যে সময়টায় মাথা পরিষ্কার থাকে, তখন টিপু ভাবার চেষ্টা করে। নিজের মনুষ্যত্ব বজায় রাখার চেষ্টা আর কি! কিভাবে এজায়গায় এল, বা আগের জীবনটা আসলে কি ছিল, তা সে ভাবার চেষ্টা করে না। এখন বিশ্বাসই হয় না টিপুর আগে কোন জীবন ছিল। পৃথিবী বলে একটা গ্রহ আদৌ কি ছিল? ঢাকায় ওর বন্ধুরা, আম্মার মুখ বা আব্বার ক্লান্ত মুখভঙ্গি - সবই স্বপ্ন, অনেক দূর অতীতের ঝাপসা স্মৃতি বলে মনে হয়।
সময় মনে হয় থমকে গেছে। ঘুম থেকে ওঠার পর পাঁচ মিনিট কাটল, নাকি কয়েক শতাব্দী কেটে গেছে? ও কি আদৌ নড়েছে এখান থেকে, নাকি চিরকাল এখানেই ছিল? টিপু কদিন ধরে এখানে আছে? ভাবতেই ওর মুখে তিক্ত হাসি ফুটে উঠল। এখানে দিন রাত নেই। গুহার ভেতরে টিপুর রাত, বাইরে দিন। হিসাব রাখা অসম্ভব, কিসের হিসাব রাখবে? আর কেনইবা রাখবে? টিপু নিজের বুকের বামপাশে হাত রাখল। ও এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে হৃদ-স্পন্দন বোঝাই যায় না। নিজেকে কেমন মৃত মৃত লাগে ওর।

এই জায়গাটা থেকে পালাবার অনেক চেষ্টা করেছে ও। একবার শার্ট ছিঁড়ে অনেকগুলো খসখসে উদ্ভিদ একসাথে জড়ো করে বেঁধে নিয়েছিল, অনেক কষ্টে তরল পান করেছিল যতটা সম্ভব। তারপর দিগন্তের কাছে সেই বাদামি-কালচে অংশ লক্ষ্য করে হাঁটা শুরু করেছিল ও। কিন্তু কিছুক্ষণ যাবার পর সারা শরীর দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম গড়াতে লাগল, হঠাৎই যেন গরমটা দ্বিগুণ হয়ে বেড়ে গেল। গরমে ওর মাথা ফেটে যাবে মনে হতে লাগল। প্রচণ্ড পিপাসা পেল। নিরুপায় হয়ে টিপু আবার ঘুরে গুহার দিকে ফিরে গিয়েছিল সেদিন।

তাই এখন পালাবার সবচে ভালো পন্থা বের করেছে ও। গুহার কাছেই বাঁকানো এক বিশাল পাথর পড়ে ছিল। আজকে খাওয়ার পর্ব শেষ করে টিপু বিশ্রামে আর বসে নি। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে পাথরটা বেয়ে ওটার মাথায় উঠেছে। পাথরটার শীর্ষ, অর্থাৎ যেখানে এখন টিপু দাঁড়িয়ে আছে, সেটা নিচের এবড়োখেবড়ো জমি থেকে কমপক্ষে চার-পাঁচ তলা উঁচু। পেটের কাছে ছড়ে গেছে, আঙ্গুলগুলো অবশ হয়ে গেছে প্রায়, মাথা ঘুরছে একটু একটু; তবু টিপু বেশ সন্তুষ্ট। এই জায়গা থেকে নিচে ডাইভ দিলে কারো বাঁচার কথা না। টিপু সেটাই করবে, এবং এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। ওর মুখে একটু হাসি ফুটল। তারপর ডাইভারদের ভঙ্গিমায় লাফ দেবে, ঠিক এমন সময় পেছন থেকে শক্তিশালী একটা হাত ওকে পাথরটার ওপরে সজোরে আছড়ে ফেলল। প্রচণ্ড ব্যথায় অস্ফুট স্বরে গোঙাতে গোঙাতে টিপু ওর রক্ষাকারী(?)কে দেখার চেষ্টা করল। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে ও, পরিচিত বমি বমি ভাবটা ফিরে এসেছে, চোখে ঢুকে গেছে অনেকটা ধুলো; কিন্তু চোখ বার বার ঘষেও ও সামনের দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারল না।

একটা দশ বছর বয়সের ছেলে ওর দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে।

টিপু ছেলেটাকে দেখতে দেখতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ওর বুকসমান লম্বা হবে বাচ্চাটা, ফরসা, মাথাভরা কুচকুচে কালো চুল, সারা চোখেমুখে কেমন একটা শান্ত কিন্তু ধারালো ভাব আছে। একটা ময়লা হলুদ গেঞ্জি আর কমলা হাফপ্যান্ট পড়েছে, তাতে আশেপাশের পরিবেশের সাথে যেন পুরো মিশে গেছে ছেলেটা। টিপুকে সোজা হতে দেখে বেমানান ভরাট গলায় ছেলেটা বলল, 'বোকা মানুষ, আবার আত্মহত্যা করতে গেছিলে কেন?'

টিপুর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। আবার! বাচ্চাটা জানল কি করে? কোত্থেকেই বা এলো?

বাচ্চাটা এবার মৃদু হাসে, 'বুঝতে পার নি এখনো? নাকি বুঝতে চাইছ না? এরকম রুক্ষ পরিবেশে, এরকম মানববর্জিত একটা জায়গায় তুমি কি করে এলে, ভাব নি কখনো? কোথাও বাধো-বাধো ঠেকে নি? নাকি সব বুঝে আবার যাচ্ছিলে আত্মহত্যা করতে, আবার পালাতে চাইছিলে?'

জমে যাওয়া মস্তিস্ক টিপুর ভাবলেশহীন মুখে কোন অনুভূতি ফোটায় না। কিন্তু মাথার ভেতরে, মনের গহীনে কোথাও অনেকদিন মুখ লুকিয়ে বসা একটা সন্দেহ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বাচ্চাটা হাল ছাড়ার ভঙ্গি করে বলে, 'আচ্ছা, আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দিতে হবে বুঝেছি'। নিজের বুকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে সে বলে, 'আমি, শয়তান', আর দুইপাশে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে উঠে দেখায়, 'আর এই জায়গাটা? আমার রাজত্ব - নরক! হাত মেলাবে?'

টিপুর সারা শরীর অদম্য এক ভয়ে কেঁপে ওঠে। ছেলেটার চোখে, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে, সম্পূর্ণ অস্তিত্বে ও অশুভ এক দ্যুতি দেখতে পায়, এবং হঠাৎ করেই বুঝতে পারে, ওর সামনে শয়তান স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে। ও ভয়ে ভয়ে বলে, 'কিন্তু তুমি তো...'

-'আহহা, চিরাচরিত সেই প্রশ্ন। তোমার কি ধারণা, শয়তানের প্রকাণ্ড শরীরটা হবে টকটকে লাল রঙের, মাথায় দুটো বাঁকানো শিং থাকবে, সাপের মত জিভ বের করে মানুষকে সে ভেংচে ভেংচে বেড়াবে? আমি তো খুব সুন্দরী কোন নারীর রূপ ধরেও আসবে পারতাম, বা বুড়ো কোন লোকের রূপে - তাতে কি আসে যায়? অবশ্য যদি জানতে চাও তবে বলি, তোমার সাথে দেখা করার জন্য এই রূপটা যথার্থ বলে মনে হচ্ছিল আমার। কে জানে, ওই দুনিয়ায় তুমি পেডোফাইল-ই ছিলে কি না!' - বিশ্রী শব্দে হেসে উঠল ছেলেটা।

টিপু জিনিসটা অবচেতনে অনেক আগে থেকেই জানত, জানত আত্মহত্যা করার শাস্তি আজীবন নরকবাস, কিন্তু নিজে পুরো বিষয়টা এখন হজম করতে পারছিল না ও। নরক? ধর্মগ্রন্থের সেই নরক? কিন্তু...

ও প্রশ্ন করার আগেই ছেলেটা, কিংবা শয়তান বলল, 'হয়েছে, আর বলতে হবে না। এটা নরকই। প্রমাণ চাইলে এখনি তোমাকে আগুনে দুচারবার পুড়িয়ে দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ওসব থাক। স্বচক্ষে দেখ।'

কথা শেষ হবার আগেই তীব্র গতিতে দিগন্তের বাদামি-কালচে অংশটা কাছিয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে। কাছে আসার পর ভালো করে তাকাতেই টিপু লক্ষ্য করল, জিনিসটা আসলে কোন একটা তরলের মহাসাগর সম্ভবত। মাঝে মাঝে বিরাটকায় কিছু প্রাণী ভুস করে পানির ওপরে শরীর জাগাচ্ছে। নিচে কাঁকড়ার মত কিছু প্রাণী দাপাদাপি করছে পানির ফেনার মধ্যে। ও প্রশ্নবোধক চোখে শয়তানের দিকে তাকাল।

-'এই প্রাণীগুলো 'তাঁর' অনেক আগের সৃষ্টি। এদের স্বাভাবিক বাসস্থান ঠাণ্ডা বরফের মত জমে থাকা একটা গ্রহে, গরম পানি এদের কাছে বিষ। এরা কিছু ভুল করেছিল, স্রষ্টার আদেশ অমান্য করেছিল। তাই এই ফুটন্ত সমুদ্র এদের শাস্তি। সমুদ্রের এদিক ওদিক তীব্র যন্ত্রনায় মোচড় খেতে খেতে একটা সময় এরা উপকূলে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকে। ওই অবস্থাতেই নিচের ওই কাঁকড়াগুলো এদের মাংস খুবলে খুবলে খায়, একটা সময় শুধু পড়ে থাকে হাড়গোড়। তবু এরা মরতে পারে না। শত শত বছর ধরে ধীরে ধীরে আবার মাংস গজায়, তার ওপরে চামড়ার আবরণ পড়ে, তারপর এরা আবার তীব্র যন্ত্রণায় সমুদ্রে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। অনন্ত এভাবেই এদের শাস্তি হতে থাকবে।'

শয়তান আর টিপুকে রেখে সমুদ্র আবার দূরে ফিরে যায়। টিপু ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, 'আমার শাস্তিটা কি?'

- 'তুমি সবুজ শ্যামল অংশের মানুষ, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলে মিশে বড় হয়েছ। বেশি ধনী না হলেও কখনো অন্ততঃ খাবার বা বাসস্থানের সমস্যায় পড় নি। তাই তোমার নরক খুব রুক্ষ পরিবেশের। তুমি একাকি, তোমার চারপাশে কোন জীবন্ত প্রাণী রাখা হয়নি। তুমি ভালভাবে খেতে পাও না, শুতে পার না। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় তুমি বোধবুদ্ধি হারিয়ে পশুর মত হয়ে যাবে, মরে যেতে চাইবে। কিন্তু মরতে পারবে না। মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ ভেঙে যাবার পর আবার ধীরে ধীরে সেটা গড়ে উঠবে। তারপর আবার ভাঙা, আবার গড়া। পশু প্রবৃত্তির সাথে মানসিক যাতনা নিয়ে বেঁচে থাকা। এটাই তোমার অনন্তকালীন শাস্তি।'

-'কিন্তু আমি তখন লাফ দিলেই আত্মহত্যা করতে পারতাম। তুমি বলছ আমার হাত পা ভেঙে যেত, কিন্তু আমি মরতাম না?'

শয়তান তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল, 'না না, এখানেই তো 'উনি' আমার হাত পা বেঁধে রেখেছেন। নইলে কি মনে কর আমি তোমাকে নরকের ট্যুর দিতে আসতাম? তোমার আগের নরকে তুমি আত্মহত্যা' - কথার মাঝেই টিপু থামিয়ে দিল তাঁকে, 'কি বললে, আগের নরক? আমি আগে পৃথিবীতে ছিলাম, পৃথিবী কি নরক?'

-'কেন, এতদিন ছিলে, কখনো নরক বলে মনে হয়নি ওটাকে? আচ্ছা, তোমাকে প্রথম থেকে সব বলছি। স্বর্গ হচ্ছে সবার ওপরে, তারপরে পৃথিবী-নরক, তারপরে অন্যান্য নরক। যারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছে, অর্থাৎ মানুষ, তারা প্রথমে যায় পৃথিবী নরকে, বাকি সৃষ্টি যায় অন্যান্য নরকে। সেখানে জীবন কাটিয়ে আবার স্বর্গে উঠতে পারল তো ভালো, আর যদি খারাপ কাজ করে তবে তারও চেয়ে নিচে বাকি কোন এক নরকে অনন্তকাল শাস্তি পেতে থাকে।

কিন্তু পৃথিবী-নরক থেকে, জীবন যুদ্ধে না লড়ে যেসব মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চায়, মানে তোমার মত আত্মহত্যা করে- তাঁদের ওপর 'উনি' খুব খ্যাপা। আত্মহত্যা করার সাথে সাথে পৃথিবী-নরকের চেয়ে একটু বেশি কষ্টের নরকে তাঁদের জায়গা হয়। কিন্তু সেই নরকে তাঁদের আত্মহত্যা করার সুযোগটা দেওয়া থাকে। কেউ যদি কষ্ট সহ্য না করতে পেরে আবার আত্মহত্যা করে, তবে তাঁদের স্থান তারও চেয়ে বেশি কষ্টের নতুন এক নরকে স্থান হয়। আবার আত্মহত্যা করলে আরও কঠিন শাস্তি...এভাবে চলতে থাকে।'

টিপু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, 'তার মানে আমি ঠিকই মরতে পারতাম, কিন্তু জেগে উঠে দেখতাম নতুন এক কঠিনতর নরকে আমার ঘুম ভেঙেছে?

শয়তান মাথা নাড়ে, 'ঠিক তাই। কিন্তু 'তাঁর' আদেশ, দ্বিতীয়বারের বেলায় অপরাধীকে বিষয়টা জানিয়ে দিতে হবে, যাতে সে ভুল শোধরাতে পারে। সেজন্যেই নিচের নরক থেকে এসেছিলাম, কিন্তু দেখি আগেই তুমি পটোল তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছ, তাই বাঁচাতে হল আরকি। যাক, আমার কাজ ফুরোল। এখন টসকে যেতে পার, আমি অন্ততঃ আর বাধা দিচ্ছি না।' এই বলে বালকরূপি শয়তান পাথর বেয়ে নামতে শুরু করল। টিপু হঠাৎ পেছন থেকে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে বলল, 'তোমাকে কিন্তু শয়তান বলে আমার মনে হল না। শয়তান কখনো কাউকে সাহায্য করবে না। আমি কি কোন স্বপ্ন দেখছি?'

শয়তান থেমে একটু বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, 'আমার কাজ পৃথিবী-নরকে। সেখানকার মানুষ সামান্য পুণ্য করেই স্বর্গে উঠে যেতে পারে, তাই তাঁদের টেনে নিচে নামানোর জন্য নানা ভেক ধরে চাল চালা-টা আমার কর্তব্য। কিন্তু তুমি যে জায়গায় আছ, এখানে কোন শয়তানি চাল খাটিয়ে আমার বিন্দুমাত্র লাভ নেই। এই জায়গাটার মতই, তুমিও অভিশপ্ত। তোমার জন্য আমি স্রেফ সহানুভূতি দেখাতে পারি।' এই বলে শয়তান সহসা নেই হয়ে গেল।

শয়তানের সহসা অন্তর্ধানে টিপু হঠাৎ খুব দুর্বল বোধ করে। তাঁর প্রচণ্ড পানি পিপাসা লাগে, উষ্ণ সেই বিষাক্ত প্রস্রবণের খোঁজে সে তাড়াতাড়ি পাথর বেয়ে নামতে শুরু করে।

আর কখনো টিপু আত্মহত্যা করে নি।
৫৪টি মন্তব্য ৫৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×