somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আশ্চর্য বিদ্যা নির্দেশিকা

০৬ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘সাঁতার শেখার উপায় একটাই। শুধু ঝাঁপ দিতে হয়।

বলেই আব্বা ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিলেন আমাকে। আমি পানির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মনে মনে সাহস সঞ্চয় করছিলাম কিভাবে নামা যায়। লক্ষ্য করি নি সন্তর্পণে কখন আব্বা আমার পেছনে চলে এসেছেন। পিঠে তাঁর দুই হাতের সজোর ধাক্কা খেয়ে আমি প্রায় উড়ে গিয়ে ঝপ্পাস করে পড়েছি গভীরে, অবাক হবার-ও সময় পাই নি। গলায় আটকে গেছে চিৎকার। হাতপা ছুঁড়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করছি, লাভ হচ্ছে না; দুনিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে, চোখে কখনো নীল আসমান কখনো ঘোলা কাদামাটি, শরীরে শক্তি পাচ্ছি না। বাতাস, একটু বাতাস দরকার! বাতাসের বদলে হাঁ করলেই সমানে পানি খাচ্ছি আর বুঝতে পারছি - ডুবে যাচ্ছি আমি।

মৃত্যুভয়।

শরীর প্রায় ছেড়ে দিয়েছে আমার।

কে জানে কখন, হয়তো মৃত্যুর দরজায় পা রাখার ঠিক এক কদম আগে, খাবি খেতে খেতে আমার হাতে একটা কিছু আটকালো যেন। রিফ্লেক্সের বশে খামচে ধরলাম, পিছলে ফসকে গেল। আবার চেষ্টা। এবারে নখ বসেছে। মাটি। আল্লাহ, মাটি!

শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মাটি আঁকড়ে নিজেকে তুলে আনলাম পানির নিচ থেকে। যক্ষ্মারোগীর মতন ক্ষ্যাস ক্ষ্যাস করে জঘন্য কাশি উঠে গেছে, মনে হচ্ছে আস্ত ফুসফুসটাই বেরিয়ে আসবে গলা দিয়ে। কাশতে কাশতে তিনবারের মাথায় থামাতে না পেরে বমি হয়ে গেল, দমকে দমকে পানি বেরিয়ে আসছে আর ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। উফ! পাড়ের কাদায় মুখ বুজে নিজের বমির পাশে নিথর কিছুক্ষণ পড়ে রইলাম আমি মিনিটখানেক, বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই শরীরে।

‘গুড। দেখলি, সাঁতার শিখেই ফেলেছিস প্রায়!’

আমি কোনোমতে চোখ তুলে তাকাই। আব্বা সেই পাড়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছেন, নিজের জায়গা থেকে একচুল নড়েননি। মুখে তার সন্তুষ্টিমাখা হাসি।

‘ধাক্কা দেবার পর মাত্র ফুটচারেক দূরে পড়েছিলি। মাথা ঠাণ্ডা রাখলে সহজেই ফিরে আসতে পারতি, ভয়ের চোটে দিক গুলিয়ে খেয়েছিস। তারপরেও খারাপ্ না; প্রায় ছয়-সাত ফুটের মতন জায়গা কাভার হয়েছে। ভেরি গুড। পানির ভয় কেটে গেছে নিশ্চয়ই?’

আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে নিষ্পলক চেয়ে থাকি আব্বার দিকে। মাথা কাজ করছে না।

‘এবারে নিজের ইচ্ছায় নাম। প্রাকটিস, প্রাকটিস, প্রাকটিস। দেখবি তিন দিনের মাথায় তোকে নদীতে সাঁতার কাটিয়ে ছাড়বো।’

তিন দিনে হয় নি, পুরো এক সপ্তাহ লেগেছিল, তবে আব্বার কথা ফলেছে শেষমেষ। আমি এখন ভালো সাঁতার পারি। হয়তো সেদিন আব্বা যা করেছিলেন ঠিক করেন নি। আমি আমার সন্তানকে অন্ততঃ এরকম হৃদয়হীন হয়ে কিছু শেখাবো না। কিন্তু আব্বার যুক্তি হচ্ছে - তাছাড়া আমার পানিফোবিয়া আজীবন থেকে যেত, সাঁতার তো দূর, পানিতে নামতেই ভয় পেতাম। মাঝেমধ্যে শেখানোর জন্যে এমন কড়া হতে হয়।

কে জানে! এখন সাঁতার পারি- এই রেজাল্ট তো অস্বীকার করার উপায় নেই! সুতরাং নিমরাজি হয়ে মেনে নিয়েছি ব্যাপারটা। যদিও ঘটনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়ে গেছে কিছু। পানি দেখে আর ভয় লাগে না। ভয় কেটে গিয়ে সেখানে এসেছে অস্বস্তি। পানির প্রতি নয়, আব্বার প্রতি।

অস্বস্তিটা অদ্ভুত - আব্বার দিকে এখন আর আমি পিঠ দিতে পারি না। সেটা হোক বাড়িতে, হোক বাইরে। ঘাড় শিরশির করে, মনে হয় আব্বা এই পিছনে এসে দাঁড়াবেন, এই ধাক্কা মেরে ফেলে দেবেন আবার। বাড়িতে সবসময় দেয়ালের দিকে পিঠ রাখার চেষ্টা করি। ফ্যামিলি ছবি তোলার সময় সবার পিছনে দাঁড়াই। এমনকি একবার ঈদের নামায পড়তে গিয়ে একটু দেরি হওয়ায় আব্বা আমার পেছনের কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন, সহ্য না করতে পেরে আমি জায়নামায তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম শেষ কাতারে। আব্বা কি কখনো ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন? মনে হয় না। কোনোদিন তো কিছু বলেননি আমাকে। জিনিসটা আমি মন থেকে সরাতে পারি না। আমার জানা আছে যে এই ভয় ভিত্তিহীন, কোন মানে নেই। কি হবে আব্বা পেছনে এলে? কি-ইবা হবে ধাক্কা দিলে? হুড়মুড় করে পড়ে যাবো খুব বেশি হলে, তাতে কি?

সমস্যাটা মানসিক নিঃসন্দেহে। অর্থ খুঁজে লাভ হবে না। হয়তো ডাক্তার দেখানো উচিত আমার। কিংবা সাইকায়াট্রিস্ট। মোটা ফি দিয়ে চেম্বারে যাবো, ডাক্তার গম্ভীর মুখে চশমা-চোখে আমার কথা শুনবে। তারপর চিন্তিত গলায় বলবে, ‘হুমম, আপনার কথায় চাপা ক্ষোভের আভাস পাওয়া যাচ্ছে; চাইল্ডহুড ট্রমার টেক্সটবুক উদাহরণ। একটা শিশুর নিষ্পাপ বিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার প্রভাব যা হয়। আচ্ছা বলুন তো, আপনি কি আপনার বাবাকে ঘৃণা করেন? অনেস্টলি বলবেন...’

আব্বাকে ঘৃণা করার প্রশ্নই আসে না। হয়তো দু’জনের চিন্তাচেতনা সবসময় খাপ খায় না (আমি বরাবরই মায়ের ব্যাটা ছিলাম এবং আছি), তাই বলে ঘৃণা? অসম্ভব। আমার আব্বা একটা জীবন্ত ঘূর্ণিঝড়ের মতন, যখন যা করেন প্রচণ্ড ফোর্স দিয়ে তীব্রভাবে করেন; কিন্তু মানুষটা খারাপ নন। একটু একরোখা, একটু স্বৈরাচারী, কিন্তু তার নিজের মতন করে আমাদের ঠিকই ভালোবাসেন।

তাই আব্বা যেদিন বাসায় এসে বললেন, ‘তোর মা তো বাপের বাড়ি যাচ্ছে। এই বয়সে আর শ্বশুর-বাড়ী দাওয়াত খাওয়ার ইচ্ছে নেই। চল, বাপ-ব্যাটা মিলে পাহাড় দেখে আসি’ – তখন অবাক হলেও অমত করি নি। আম্মাও উৎসাহ দিলেন, ‘যা, মানুষটা নিজে থেকে বলেছে যখন, একসাথে সময় কাটানোর শখ হয়েছে নিশ্চয়ই। যা, অনেক খুশি হবে।’

আমরা কাপড়চোপড়, ট্রেকিং শ্যু, শুকনা খাবার থেকে শুরু করে মশাতাড়ানি মলম পর্যন্ত কিনে নিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে ফেললাম। ফোনেই গাইড ঠিক করা হলো। তারপর রাতভর বাসজার্নি করে পাহাড়ি এলাকায় এসে নামা। অফিশিয়ালি যাত্রা শুরু! আব্বার তো তুমুল আগ্রহ, গাইডকে সারাক্ষণ জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন – ‘এই পাহাড় কত উঁচু? কত দূরে যাওয়া সেফ? আমরা কোন ট্রেইল ধরে যাচ্ছি?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গল্প করতে করতে আবিষ্কার হলো সামনে যে আরেকটা কোণাকুণি পথ চলে গেছে পাহাড়ি এলাকার গভীরে, পথের শেষে দেখা যাবে দাঁড়িয়ে আছে এলাকার সবচে উঁচু পাহাড়। রাস্তা খারাপ, আশেপাশে গ্রাম নেই কোন, তাই ট্যুরিস্টরা সচরাচর সেদিকে ঘেঁষে না। শুনে আব্বার আগ্রহ আরও বাড়লো যেন, আমাকে বলছেন, ‘দেখ কেমন অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে না? চল এই রাস্তায় যাই, কি বলিস?’ আমার আগ্রহ-ও বাড়ছিল শুনে, আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

কিন্তু সমতল রাস্তায় হেঁটে ট্রেইল ফলো করা যত সহজ, পাহাড়ে ওঠা ততই কঠিন। আদ্ধেক উঠতে উঠতে সন্ধ্যা, জিভ বেরিয়ে গেছে আমাদের; গাইড বললো ব্রেক নিতে। কিন্তু উহু, আব্বার জেদ চেপে গেছে। আজ রাতেই উঠতে হবে চূড়ায়, তারপর সেখানে তাঁবু গেড়ে যত ইচ্ছে রেস্ট, ঘুম যা করার করো। আগে ওপরে ওঠো।

কি আর করা, দাঁতে দাঁত চেপে উঠলাম। এতো ক্লান্ত লাগছিল শেষের দিকে! বিশেষ করে শেষ আধঘণ্টা, জোঁকের কামড়, মশার কামড়, ক্লান্তি সব মিলিয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। কত কুলায় আর শরীরে? হয়তো বসেই পড়তাম, কিন্তু সত্যি কথা তারপরেও পা চালিয়ে যাচ্ছিলাম আব্বাকে দেখে। তার চোখেমুখে ক্লান্তি আছে, কিন্তু আনন্দমাখা। মানুষটা সত্যিই ইনজয় করছে ট্রেকিং। আব্বাকে ফলো করে করেই অবশেষে উঠলাম, গাইড আগেই চূড়ায় এসে তাঁবু-খাবার সব রেডি করে রেখেছিল, গোগ্রাসে খেয়ে একটা মরার মতন টানা ঘুম।

ঘুম ভাঙল ভোরে।
তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আব্বা, গাইড, কারুরই দেখা নেই। এখনো ঘুমাচ্ছে মনে হয়। আমি তাঁবু থেকে চোখ সরিয়ে চারিপাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রাতে উঠেছি, তখন এই স্বর্গীয় শোভা চোখে পড়ে নি। চারিপাশে পাখির কিচিরমিচির, বাতাসে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, আকাশে কাঁচা সোনা ছড়িয়ে রেখেছে কেউ - আর এতো সবুজ, এতো সবুজ! এই এক দৃশ্য দেখলেই তো পাহাড়ে ওঠার সকল কষ্ট উসুল হয়ে যায়! আরেকটু ভাল করে দেখার জন্যে আমি চূড়ার কিনারে সরে আসি। সামনে হাজার ফুট নিচে দুনিয়া প্রেমিকার মতন উন্মুক্ত হয়ে আছে আমার চোখের সামনে। কি সুন্দর!

তখনি কেন যেন ঘাড়টা শিরশির করে ওঠে আমার। আমি জমে যাই। আব্বার শান্ত কণ্ঠ ভেসে আসে পেছন থেকে,

‘উড়তে শেখার উপায় একটাই। শুধু ঝাঁপ দিতে হয়।’
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১২
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×