somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানবপ্রেমিক ফৌজিয়া বীথি, জীবনসংগ্রামী এক নারী

২৭ শে অক্টোবর, ২০২৩ ভোর ৬:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রাহাত রূপান্তর: ২০১৩ সালের কথা। একমাত্র ছেলে বাঁধন তখন ভীষণ অসুস্থ্য। পরীক্ষা—নিরীক্ষায় ধরা পড়ে ব্রেন ক্যান্সার। দিনমজুরী করে পেটের ভাত জোটাবে, না ছেলের চিকিৎসা করবে। কোন কুল কিনারা না পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দশা তখন বেলকুচি মধ্যপাড়া গ্রামের দিনমজুর মহসিন আলম লালু’র। চারিদিকে যখন অন্ধকার, তখনই আলোর দিশা হয়ে হাজির হলেন বিথী আপা— বলছিলেন লালু। খবর পেয়ে বীথি আপা নিজের গলার হার বন্ধক রেখে জোগার করে দেন চিকিৎসার টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত বাঁধনকে আর বাঁচানো যায়নি।
ছেলে হারানোর শোকে পাথর হয়ে একদিন ওর মা হার্ট অ্যাটাক করলো। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে মাঝরাতেই ছুটে গেলেন বীথি। ধুনট সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিসিইউ’এ ভর্তি করালেন। বিথীর সহযোগীতায় স্ত্রী বাসন্তিকে সুস্থ্য করে তোলেন দিনমজুর মহসিন আলম লালু।

কারো কাছে বিথী আপা। কেউ ডাকে বিথী ম্যাডাম। বিথীর পুরো নাম ফৌজিয়া হক বীথি। পেশায় শিক্ষক হলেও মানবসেবা যে তার ব্রত, পথে—ঘাটে তার প্রমাণ মেলে।

কথা হচ্ছিলো ধুনটের মর্জিনা বেগমের সাথে। বললেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ। গরিব মানুষ। একদিন কাজ করলে আরেকদিন বসে থাকে। থাকার মতো বাড়িঘরও তখন নেই। বিথী আপার সাথে যোগাযোগ করলাম, ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। তাই নয় শুধু মর্জিনার ছেলে—মেয়ের খাতা—কলম, ফরম ফিলাপসহ পড়াশোনার সব খরচ দেন বিথী।


যেভাবে সামনে এলেন বিথী: করোনার দহনকাল। অদৃশ্য এক অনুজীবের কাছে অসহায় তখন পুরো পৃথিবী। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো অপরিচিত হতে থাকে ধীরে ধীরে। পাশে দাঁড়ানোতো দুরের কথা কেউ কারো খোঁজ—খবর পর্যন্ত নেয়না। এমন সময় নিদানকালের বন্ধু হয়ে অসহায় মানুষের পাশে ভরসা হয়ে দাঁড়ালেন স্কুল শিক্ষিকা ফৌজিয়া হক বীথি।

করোনা মহামারির শুরু থেকে পুরো ধুনটে স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা নিয়ে সাধ্যমত পৌঁছে যান বাড়ি বাড়ি। হাতে হাতে তুলে দেন নিজের তৈরি করা কাপড়ের মাস্ক। লকডাউন চলাকালে সাধ্যমত কর্মহীন দুস্থ মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দেন রান্না করা খাবার। ২০২০ সালে করোনার দু:সময়ে সবার সামনে চলে আসে সাধারণ মানুষের পাশে থাকা বীথির সমাজসেবার গল্প।

বিথীর পরিচয়:বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফৌজিয়া হক বীথি। তার জন্ম ১৯৭৮ সালে উপজেলার চান্দারপাড়া গ্রামে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন বাবা মোজাম্মেল হক। যুক্ত ছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। দুই ভাই—বোনের মধ্যে বীথি ১ম সন্তান। ধুনট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে ধুনট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ধুনট ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। এর আগে ২০০০ সালে সালে যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়।

ভালোবাসার মানুষের লাঞ্ছনাও দমাতে পারেনি বীথিকে: ফৌজিয়া হক বীথি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। সেই স্বামীই যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু করেন। এইচএসসি পরীক্ষার আগে তাঁর মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করেন। এই দুরবস্থার মধ্যে পরীক্ষা দিয়েও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীনও তাঁর স্বামী তাঁকে গাছের ডাল দিয়ে মারধর করেন। চিকিৎসার পর সুস্থ হলেও তিনি বাঁ কানে শুনতে পান না এবং বাঁ চোখে কম দেখেন। একপর্যায়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। এরপরও নির্যাতন থামেনি। পরীক্ষার সময় তাঁকে অপহরণ করার চেষ্টা করা হয়। পড়াশোনা শেষ করে নতুনভাবে জীবন গড়ার শপথ নেন। এক আইনজীবী রাজ্জাকুল কবিরের সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধেন। স্বামীর সঙ্গে তিনি সমাজসেবামূলক কাজ শুরু করেন।


মানুষের পাশে বিথী: মাঝে মাঝে নারীদের নিয়ে সচেতনতা মূলক সভা করেন ফৌজিয়া হক বীথি। বিশেষ করে নারী উন্নয়ন ও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে গ্রামে গ্রামে আলোচনা করেন তিনি। বেলকুচি গ্রামের আয়েশা খাতুন জানান, তাদের সামাজিক সচেতনা নিয়ে পরামর্শ দেন। এছাড়া মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। আয়েশা বলেন, অর্থের অভাবে আমার নাতীনের লেখাপড়া চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। বীথি আপার সহযোগিতায় এখনো আমার নাতনি পড়ালেখা করছে।


সমাজসেবাতেও যত বাঁধা: মানুষের সাথে মানুষের পাশে থাকতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা এসেছে কি—না, আসলে কীভাবে সেটাকে পাশ কাটিয়েছেন জানতে চাইলে ফৌজিয়া বীথি বলেন, ‘অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। যেমন আমার গ্রামের ৫ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ৬৫ বছরের একজন বৃদ্ধের দ্বারা। যখন আমি মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি, তখন আমাকে রাজনৈতিকভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়; যেন আমি মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারি এবং আমি যাতে থানায় নিয়ে যেতে না পারি। আমাকে অনেক ভয়ভীতি দেখানো হয়, এরপরও কিন্তু আমি মেয়েটাকে নিয়ে থানায় যাই, হাসপাতালে চিকিৎসা করাই এবং অভিযুক্তকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। এছাড়া আমার গ্রামের আশপাশে মাদক কারবারিদের নিরাপদ আস্তানা। আমি অনেক মাদক কারবারিকে শিক্ষার্থীদের দিয়ে ধরিয়ে থানাতেও দিয়েছি। এ কারণে আমি অনেক মাদক কারবারির রোষানলে পড়েছি। তারা আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে।’


বিলিয়ে দেন নিজের বেতনের টাকা:মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছেন, এতে টাকার দরকার। টাকার যোগান আসে কোত্থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বেতন থেকে মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করি। আমার মানুষের জন্য করার সাধ আছে। যখন দুস্থ অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে গিয়ে সাধ্যে না কুলায়, তখন খুব খারাপ লাগে। আমি যদি এসব কাজে সরকারি এবং বিত্তবান মানুষের সহযোগিতা পাই তবে আমার কাজগুলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

বিথীর আদর্শ তার বাবা:ফৌজিয়া হক বিথী বলেন, ‘বাবা বলতেন নিজে বাঁচার নাম জীবন নয়, সবাইকে নিয়ে বাঁচাই জীবন। বাবার এই কথা সবসময় মনে ধারণ করে চলি। বাবার অনুপ্রেরণাতেই স্কুলের চাকরি পাওয়ার পর থেকে সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, অসুস্থ মানুষকে নিয়ে কাজ করি। একজন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সহযোগিতার পর যখন তিনি ভালো থাকেন, তখন সেই অবস্থা দেখে আমি মানসিকভাবে শান্তি পাই, তৃপ্তি পাই। এ সব কাজের মাঝেই আমি বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজি।’

আরও পরিকল্পনা: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ফৌজিয়া বীথি বলেন, 'মেয়েদের স্বনির্ভতাই মেয়েদের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার। কোন মেয়েই অযোগ্য নয়, মেয়েরাই পারে সমাজ পরিবর্তন করে দিতে। আমি অসহায় নির্যাতিত মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দিয়ে ওদের স্বনির্ভর করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখি। স্কুল শিক্ষিকা ফৌজিয়া হক বীথি নির্যাতিত মেয়েদের নিয়ে সংগঠন গড়তে চান। নারীদের স্বনির্ভর, এবং প্রতিবাদী করে গড়তে চান।


যত অর্জন: এসব সামাজিক এবং মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য বেশ কিছু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার— আইপিডিসি তাকে ‘আনসাং উইমেন ন্যাশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড—২০২১’ প্রদাণ করে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ‘রাঁধুনী কীর্তিমতি’ সম্মাননা, প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২, রাজশাহী বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার ২০২২, ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি) সম্মাননা ২০২৩, শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

সংবাদ পেলেই ছুটে যান বিপদগ্রস্ত মানুষের বাড়িতে। পরামর্শ দেন। আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি সাহস যুগিয়ে পাশে দাঁড়ান অসহায় মানুষের। সমাজে অসহায়ের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া একজন সত্যিকারের মানবতার ফেরিওয়ালা তিনি। আত্মপ্রচারের চেয়ে মানুষের সেবাতেই আত্মতৃপ্তি খুজেঁ নেন স্কুল শিক্ষক ফৌজিয়া হক বিথী।

প্রকাশ:
দৈনিক করতোয়া/৮ম পাতা
২৭ অক্টোবর ২০২৩

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১০:০৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×