
রাহাত রূপান্তর: এক সময়ের স্রোতস্বিনী করতোয়া এখন জীর্ণ শীর্ণ অভিভাবকহীন এক অসহায় নদী। এক সময়ের টইটম্বুর নদী এখন প্রবাহ হারিয়ে দূষণ, দখল, ভরাটে মরা খালে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিনের দাবির মুখে নদীর এই ধারা ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস আর কর্মপরিকল্পনা ফাইলবন্দি হয়ে হিমঘরে পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষের এমন নীরবতায় অবৈধ দখলকারিদের দৌরাত্ম্যে বেড়েছে। প্রতিনিয়তই জীর্ণ শীর্ণ খাল হয়ে যাওয়া সেই নদীর কোনো না কোনো অংশ দখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর বুকে গড়ে উঠছে দালানকোটা। পরিবেশবাদীরা বলছেন, জেলা সরকার দলীয় কোনো সংসদ সদস্য না থাকায় মৃতপ্রায় করতোয়া বাঁচাতে কেউ উদ্যোগী হচ্ছে না। মূলত রাজনৈতিক কারণেই বগুড়া শহরকে ঝুঁকিতে ফেলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে করতোয়া।
অথচ করতোয়া এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ইতিহাস সমৃদ্ধ নদী। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে এ নদীর উৎসমুখ। সেখান থেকে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর হয়ে নেমে এসেছে অববাহিকায়। এরপর নানা ধারায় প্রবাহিত হয়ে প্রবেশ করেছে উত্তরের প্রবেশদ্বারখ্যাত বগুড়ায়। যে নদী ঘিরে গড়ে উঠেছে বগুড়া জেলা শহর। করতোয়ার প্রবাহিত সেই ধারা পরে শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় গিয়ে পড়েছে বাঙালি নদীতে।
সূত্রমতে, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শেষ সীমানা থেকে বাঙালি নদীতে পতিত হওয়া পর্যন্ত করতোয়ার দৈর্ঘ্য ১২৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে বগুড়া শহরে নদীটির দৈর্ঘ্য ১৩ কিলোমিটার। এক সময়ের প্রবল স্রোতের সেই করতোয়া এখন শহরের বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দু’এক স্থানে পানি দেখা গেলেও শহর ও শহরতলীর প্রায় ৩০ কিলোমিটারে শুধু ড্রেনের কালো পানি। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, জেলা কারাগার ও বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেই নদীর তলদেশে বর্জ্য দৃশ্যমান। এছাড়া নদীর পাশের কলকারখানার দূষিত পানির জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে নদীতে। আর করতোয়ার দূষণের প্রভাব পড়েছে গোটা শহরেই। বিশেষ করে নদীতীরের এলাকাগুলোতে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে হুমকিতে।
স্থানীয়রা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে নদীর বর্জ্যগুলো ভেসে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে ফতেহ আলী সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত পরিণত হয় বর্জ্যের পাহাড়ে। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে নগরায়ন, অবৈধ দখলদারিত্বের পাশাপাশি শহরের ময়লা ফেলার ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে করতোয়া। নদীটিকে দখলমুক্ত করতে প্রায় বছরখানেক ধরে নেই কোনো উচ্ছেদ অভিযান।
প্রশাসনের নজরদারী না থাকার সুযোগে দখল উৎসবে নেমেছেন প্রভাবশালীরা। তারা ইচ্ছেমতো দখল করে নদীর সীমানায় নির্মাণ করছেন আবাসিক আর বাণিজ্যিক ভবন। এমনকি নদীর শুকনা অংশগুলোতে নিজেদের জমি দাবি করে চলছে চাষাবাদ। পাশাপাশি প্রশাসনের চোখের আড়ালে নদীর বিভিন্ন অংশে যন্ত্র বসিয়ে অবাধে চলছে বালু উত্তোলন। ফলে একদিকে দখল দূষণে নদী মরে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ-প্রতিবেশগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সূত্রমতে, দখল দূষণে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়া করতোয়া নদীকে দখলমুক্ত করে পানির প্রবাহ ফিরে আনতে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১২৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তেমন কাজ হয়নি। শুধু শহরের এসপি ব্রিজ নামক স্থান থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় পর্যন্ত কিছু গাছ লাগানো আর খানিকটা খনন করা ছাড়া তেমন কোনো কিছু করা হয়নি।
দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পরে ২০১৫ সালে করতোয়া দখলমুক্ত করে প্রবাহ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। যেখানে বগুড়া জেলা প্রশাসক, পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ (পাউবো) ২১ জনকে বিবাদী করা হয়। শুনানি শেষে উচ্চ আদালত একই বছর করতোয়াকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে নদীতে সব ধরনের বর্জ্য ফেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পৌরসভাকে নির্দেশও দেন। তবে অর্ধযুগের বেশি সময়েও আদালতে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
সূত্রমতে, পৌরসভার সঙ্গে ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ খনন, দখলমুক্তকরণসহ নদীর দুপাশে হাঁটার রাস্তা তৈরির জন্য প্রায় ২৭০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবও করা হয়েছিল। তবে পরে সেটা বাদ দিয়ে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে এতকিছু করার পরও মৃতপ্রায় করতোয়া বাঁচাতে আর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলছেন, একসময় তিলোত্তমা বগুড়া করার উদ্যোগ নিয়েছিল বগুড়া পৌরসভা। তারই অংশ হিসেবে সাতমাথা থেকে মাটিডালি, বানানী ও তিনমাথা পর্যন্ত রাস্তা আধুনিকীকরণ করা হয়। এরপর বগুড়া উন্নয়নে কোনো প্রতিশ্রুতি বা দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে পড়েনি। জিয়াউর রহমান মনে করেন, বগুড়া থেকে সরকারি দলের কোনো সংসদ সদস্য না থাকায় সরকার সম্ভবত বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। সেই হিসেবে বলা যায়, রাজনৈতিক কারণেই থেমে আছে করতোয়া সংস্কার।
করতোয়ার দখল-দূষণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদ সিদ্দিকী। বলেন, ছোটবেলায় সাগরের স্বাদ পেতাম এই করতোয়ায়। আজ সেই মনোমুগ্ধ চিত্র আর নেই। নদীর পাশেই অবস্থিত বগুড়া থিয়েটারে বসে সাংস্কৃতিক কর্মীরা ময়লার দুর্গন্ধে স্বাচ্ছন্দে সাংস্কৃতিক চর্চাও করতে পারছেন না। অন্যান্য জেলার নদীগুলোর সংস্কারের সংবাদ শুনি, কিন্তু বগুড়ায় প্রশাসন নীরব। এটা পুরো বগুড়াবাসীর জন্য কষ্টের, অপমানের। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের বগুড়ায় কেন কাজ হচ্ছে না, এটা আমাদের অজানা।
বগুড়া জেলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়ার দু’পারে লাখ লাখ মানুষের বসবাস। তারা নদী দূষণের প্রভাবে শঙ্কিত। তীরে বসবাসকারীরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নদীর পরিবেশগত বিপর্যয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই। তাদের অনেকেই বলছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নদীর প্রবাহ ফেরাতে মেগা প্রকল্পের প্রস্তাব দিলেও তা আজও ফাইলবন্দী।
এ ব্যাপারে বগুড়ার সিনিয়র সাংবাদিক মহসিন আলী রাজু বলেন, ২০০৬ সাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বিউটিফিকেশন অব করতোয়া রিভার ফ্লাই’ প্রস্তাবনায় ১২৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বন্ধ হয়ে আছে। প্রকল্পটি বিএনপি সরকারের সময় অর্থ মন্ত্রণালয় আটকে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্পটির আবশ্যকতা পেলেও এখন পর্যন্ত ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনা থাকলেও রহস্যজনকভাবে আর কোনো উচ্ছেদ অভিযান চোখে পড়ছে না।
তবে বগুড়া শহরের প্রাণের সূত্রে গাঁথা করতোয়া নদীর দখল ও দূষণ রোধে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আন্দোলনসহ বিভিন্ন রকম কর্মসূচি পালন করেই যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। তবে তাতেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পাচ্ছেন না আন্দোলনকারীরা। গত বছরে বিশ্ব নদী দিবসে ‘মানুষের জন্য নদী’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাপা, বগুড়া জেলা শাখাসহ টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্স (তীর) নামের সংগঠন আবারও মাঠে নামে। পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীদের পাশাপাশি এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন বগুড়ার সাধারণ মানুষও।
গত বছরে বিশ্ব নদী দিবসের মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে করতোয়াসহ বগুড়ার সব নদীর পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনা, দখলমুক্ত করতে অবৈধ সব স্থাপনা অপসারণ ও বালি উত্তোলন বন্ধে দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়। সেই সঙ্গে করতোয়া প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে উচ্চ আদালতের আদেশ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিও জানানো হয়। তবে সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
এদিকে, নদীর দূরাবস্থার ফলে নদীপাড় ও সংশ্লিষ্টদের জীবনধারণ গেছে বদলে। বিশেষ করে নদীনির্ভর মাছ চাষিরা পড়েছেন বিপাকে। সাধারণ মাছ চাষিরা উপযোগী পরিবেশ না পেয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। অনেককেই পেশা ছাড়তে হচ্ছে। এ ব্যাপারে বগুড়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার আনোয়ারুল কবীর আহম্মেদ বলেন, ‘করতোয়া নদী আর মাছ চাষের উপযোগী নেই। নদীর ভালো পরিবেশ ফিরে আনা গেলে মাছ চাষে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে। এতে সাধারণ মাছ চাষিদের মুখেও হাসি ফুটবে।
পাউবো, বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প জমা আছে। আশা করছি শিগগিরই অনুমোদন হবে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের একটি টিম করতোয়া পরিদর্শন করেছে। গত বছরের কিছু অতিরিক্তি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে কয়েকটি স্থাপনা বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান। জেলা প্রশাসন থেকে দখলকারীদের আরও নতুন তালিকা করা হচ্ছে। শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। আর প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে নদীর দু’পাশে প্রায় ২৭ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে ও ড্রেন নির্মাণ করা হবে।
বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, করতোয়া নদীর খনন এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। নদী দূষণ বন্ধে ও পৌরসভার ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদীর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী করতোয়া নদী অস্তিত্ব হারানোর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বগুড়াকে বাঁচাতে হলে করতোয়াকে করতে হবে প্রবাহমান।
প্রকাশ:
আনন্দবাজার(বাংলাদেশ) ২১ অক্টোবর ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৩ বিকাল ৩:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




