বিধাতা পৃথীবিতে যত জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে মানুষ দুই পেয়ে জন্তু হিসাবে পরিচিত কিন্তু বিধাতা নিজেই বলেছেন, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং এরা ফেরেশতা দের থেকে উন্নত। আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতারা মানুষকে সিজদা করতে বাধ্য হয় (শয়তান ছাড়া), কিন্তু কেন? যে ফেরেশতা আল্লাহর সাহচর্যে সব সময় থাকে, তারা আল্লাহর কাছে সর্ব শ্রেষ্ঠ হতে পারল না, মাটির সৃষ্টি সামান্য মানুষ হল আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ? এটা আশ্চর্য জনক নয় কি?
মানুষ অবিনশ্বর নয়। মৃত্যুর পর এর দেহ মাটির সাথে মিশে যায়, তবু কেন শ্রেষ্ঠ হল? অন্যান্য জীবজন্তুর সাথে মানুষের তুলনা করলে দেখা যায়, যে অন্যান্য জীবজন্তু সর্বদা রিপুর বশবর্তী, তাদের মধ্যে বিবেক বলে কোন জিনিসের বালাই নাই। যখন যা মনে হয়, তাই করে। মনকে সংযত করার শক্তি বিধাতা তাদের দেন নাই, আর শুধু এ কারনেই তারা জানোয়ার নামে অভিহিত। অপরদিকে যারা ফেরেশতা , তাদের রিপু বলে কোন জিনিস নাই, তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করেনা (শয়তান ছাড়া)। সুতরাং তারা পাপ ও করেনা।
আর মানুষ হচ্ছে একদিকে যেমন দুই পেয়ে জন্তু , বয়সের সাথে সাথে ষড়রিপুর ক্রীতদাসে পরিনত হয়, অপর দিকে তারা ফেরেশতাদের গুনে গুনান্বিত এবং নিজেকে সংযত করার মত শক্তি ও তার আছে, সেটা হচ্ছে বিবেক। এই রিপুর মোহ বন্ধন হতে যে মুক্ত হতে পারে মানে রিপুকে দমন করতে পারে, সেই সত্যিকারের মানুষ। তাই যে মানুষ শুধু মাত্র তখনই ফেরেশতাদের থেকে উন্নত হতে পারে, যখন সে সম্পুর্ন রুপে বশ করতে পারবে বা ষড় রিপুকে দমন করতে পারবে।
আমরা হারুৎ, মারুৎ নামে দুই ফেরেশতার কথা জানি, যারা মানুষের রুপ ধরে পৃথীবিতে এসেছিল। পৃথীবিতে নেমে আসতেই আল্লাহ তাদের রিপুকে জাগরুক করে দিয়েছিলেন। তাই পৃথীবিতে এসে দুই নর্তকী দেখে তারা বিবেক হারিয়ে ফেলে এবং কাম রিপুর বশবর্তী হয়ে যায়, মানে ফেরেশতাদের গুন হারিয়ে ফেলে।
পৃথীবিতে যত ধর্ম আছে, সব ধর্মেই দেখা যায় দুই শক্তির দ্বন্দ্ব। একটা ভালো অপরটা খারাপ। আমরা, মানে মুসলমানরা শয়তান রুপি খারাপ শক্তি থেকে নিজেদের বাচাঁতে চেষ্টা করি। তেমনি খ্রষ্টান, ইহুদিরাও শয়তান থেকে বাচতে চেষ্টা করে। হযরত আদম (আঃ) যদি শয়তানের প্রলোভনে পড়ে গন্দম ফল না খেতেন, তাহলে মানুষ হয়তো সারা জীবন বেহেশতেই থেকে যেত। পৃথীবিতে আসতো না কিংবা পৃথীবি সৃষ্টি হোত না। সেখানে শয়তান এসেছিল লোভের রুপ নিয়ে। অর্থাৎ, লোভই হচ্ছে শয়তানের আরেকটি রুপ।
মুসলমানরা যেমন শয়তানের কুহক থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, তেমনি গীতাতে ও রয়েছে ” উদ্ধরেও আত্মসাতময়’ অর্থাৎ, উর্দ্ধতার আত্মার দ্বারা নিজেকে নিম্নতর আত্মার বন্ধন হতে মুক্ত করতে হবে। বুদ্ধদেব বলে গেছেন ” সার নামক এক পাপ শক্তির সহিত সংগ্রাম করিয়া মোক্ষ লাভ করিতে পরিলেই সত্যিকার ধর্ম পালন কার হইবে।”
জরাহুস্থ্রর অনুসারি রা দুই দেবতার পুজা করে। একজন পাপের দেবতা AHIRMANG, অপরজন পূন্যের দেবতা ORMUZD। সুতরাং প্রতিটি ধর্মেই ঐ একই কথা বলে।
পাহাড় যেমন ধ্যান গম্ভির ভাবে দাড়িয়ে থেকে আল্লাহর উপাসনা করছে, তেমনি আমাদের দেহ ও সদা সর্বদা নিজ নিজ কর্তব্য ঠিক ভাবে করে আল্লাহর আদেশ পালন করছে। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়, তাতে আগুনের তো কোন দোষ নাই, না হাতের আছে। কারন এটাই তো বিধাতার আদেশ বা চিরাচরিত নিয়ম। সুন্দরি যুবতি দেখলে মনে পুলক লাগে, তাই বলে চোখের তো কোন দোষ নাই, দোষ হচ্ছে ঐ পাগলা ঘোড়া রুপি ঐ মনটার। একমাত্র মানুষের মন বা অন্তর ছাড়া সব কিছুই আল্লাহর আদেশ মেনে চলে অপর কথায়, তার উপাসনায় রত।
মানুষ যতদিন শিশু থাকে ততদিন তার মনে কোন রিপু ভর করতে পারেনা তাই তারা থাকে নিষ্পাপ। আর এজন্যই তাদের বলা হয় ফেরেশতা। অথচ বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথেই এই নিষ্পাপ মনটা হয়ে উঠে রিপুর তাড়নায় কূলষিত। তখন সে মানবতার ধর্ম বা আল্লাহর আদেশ বাদ দিয়ে এই পৃথীবির কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, হিংসা, মাৎশর্যের চক্রে আবর্তিত হতে থাকে এবং আস্তে আস্তে নিষ্পাপ ফেরেশতার মতো মন জানোয়ারে রুপান্তরিত হয়। ঐ সময় যে ব্যক্তি নিজের মনের রিপুর সাথে যুদ্ধ করে বিবেক কে বশ করতে পারে, সেই সত্যিকারের মানুষ বলে পরিচিত হয়। আর এ কথাটা শুধু কোরআন শরীফে নয়, বরং ইঞ্জিল, তৌরিত, গীতা সব ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে।
ধর্ম আসলে কিছ নয়, মানবতার কাজ করা, মন কে পবিত্র রাখা আর রিপুকে সংযত রাখার চেষ্টা আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুলো হলো মনকে সংযত রাখা আর রিপুকে দমন করার পন্থা বা উপায়। যেমন ধরুন কোরবানী করা বা উৎসর্গ করা। ইব্রাহিম আঃ এর উপর আল্লাহর আদেশ ছিল তার সব চাইতে প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার, তার কারন কি ? একটু চিন্তা করলে বুঝা যাবে পৃথীবিতে মানুষের সবচাইতে প্রিয় বস্তু যা, তার উপর মানুষের বিরাট মোহ সৃষ্টি হয়। এই মোহ রুপি রিপু টাকে দমন করার জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছিলেন সবচাইতে প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে। তিনি তো বলেননি বাজার থেকে গরু ছাগল কিনে এনে কোরবানী দিতে। পশুটা ছিল প্রতিকি। আল্লাহতাআলা তো বলেন নি কোরবানীর নামে বাজার থেকে পশু কিনে এনে তিনদিন ধরে গোশত খাওয়ার উৎসব করতে অথবা হজ্জের পর বিনা কারনে তিন দিন ধরে লক্ষ লক্ষ জীব হত্যা করতে। যখন পৃথীবির কোটি কোটি লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে তখন হজ্জের পর লক্ষ লক্ষ জবাই করা পশুর গোশত মাটির নিচে চাপা দিয়ে নষ্ট করে ফেলতে কি আল্লাহ বলেছেন ? আজ আমাদের এই অনুষ্ঠান গুলো কি অন্তঃসার শুন্য হয়ে যায়নি ? মানব কল্যানের পরিবর্তে এখন কি মানব অকল্যান ডেকে আনছে না ? ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য যেখানে মোহ ত্যাগ করা, সেখানে আমরা পরিনত করেছি গোশত খাওয়ার উৎসবে। আবার আজকাল ধর্ম গুরুরা কোরবানী কে এই বলেন , কোরবানীর পশুর গায়ে যত গুলো পশম হবে, সওয়াব ও নাকি তত পাওয়া যাবে। মানে খুব বেশী সওয়াব হাসিল করার লোভ সবার মনে জাগিয়ে দেয়া, যাতে মানুষ বেশী করে কোরবানী করে (ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কোরবানী ওয়াজীব)। এই যে কোরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্য আজ কোথা থেকে কোথায় দাড়িয়েছে। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য যেখানে মোহ ত্যাগ করা সেখানে আজকাল আমরা শুধু সওয়াব এর লোভে কোরবানী করছি। মানে সংযম এর বদলে আমরা লোভ কে প্রশ্রয় দিচ্ছি। উদ্দেশ্য বিহীন কোন অনুষ্ঠানের কোন দাম আছে কি ? অবশ্য তার মানে এই নয় যে কোরবানী বাদ দিতে হবে। কোরবানী বা উৎসর্গ আমাদের করতে হবে তবে তার জন্য গরু জবাই এর কথার কোন যৌক্তিকতা নাই। কোরবানী অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্য যেখানে মোহ ত্যগ করা, সেখানে গোরু, ছাগল অথবা আমার সবচাইতে প্রিয় কোন জিনিষ , যেমন টাকার কথাই ধরা যাক, আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার নিয়ত করে কোন গরিব লোক কে দান করে দিতে পারি। তাতে আরো ভালো হয় না ? এতে আমার মন থেকে মোহ কাটল আর ঐ উৎসর্গীকৃত জিনিসটা তে কোন গরীব লোকের চরম দুরাবস্থা কমলো। যে দেশে বহু লোক না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে সে দেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ গৃহপালিত পশু হত্যা করা ধর্মান্ধতার চরম গোড়ামী নয় কি?
ইসলাম ধর্মের প্রতিটি অনুষ্ঠানের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে অন্তঃসার শুন্য আনুষ্ঠানিকতার জন্যই আজকাল মুসলমানরা পৃথীবির বুকে লাঞ্চিত, গঞ্জিত হচ্ছে। যে সব জাতির মধ্যে এই মানবিক ও চারিত্রিক দায়িত্ববোধ বেশী যত, তত তারাই পৃথীবিতে প্রধান্য বিস্তার করেছে। আমরা সবাই যদি মোহ ত্যগ করতে পরি তাহলে পৃথীবিতে অন্যয়, অত্যচার থাকতে পারে না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



