somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

███► গল্পঃ ক্র্যাচের মুক্তিযুদ্ধা ◄███

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১০:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপুরের খাবার শেষ করে শুয়ে শুয়ে ১টা গল্প বই পড়ছিল আবির। রবার্ট লুই স্টিভেনসের লেখা একটা অ্যাডভেঞ্চারের বই। ছুটির দিন হওয়াতে সারাদিন গল্পের বই পড়ে সময় পার করেছে সে। অনেকক্ষণ থেকে পড়ার কারণে হালকা ঝিমুনি চলে এসেছে চোখে। আর ভালো লাগছিল না পড়তে। বইটা বিছানার উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। আড়মোড়া দিতে দিতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো।

আকাশ সকাল থেকেই তার বুকে মেঘ জমিয়ে রেখেছে কিন্তু মেঘ ফেটে বৃষ্টি নামার নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। আবিরের আবার মেঘলা আকাশ অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না এমনটা ভালো লাগে না। সকাল থেকেই সে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় আছে। বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই ছাতাটা নিয়ে ছাদে দৌড় দিবে বলে। ভারী বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে অন্যরকমের আনন্দ লাগে তার। বৃষ্টির ভারী ভারী ফোঁটা যখন ছাতার মধ্যে পড়ে তখন সে চোখ বন্ধ করে শব্দ শুনে। ঐ শব্দে ছন্দের এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হয় তার মনে।
আকাশ যখন মেঘলা করেছে তখন বৃষ্টি একবার না একবার আসবেই। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল সে।
জানালার দিকে তাকিয়ে কালো মেঘগুলো দেখতে দেখতে অন্য একটা জগতে চলে গিয়েছিল সে।

কলিংবেলের আচমকা শব্দে তার মোহ কাটল। একটানা কলিংবেল বেজেই চলছে। সুইচটা কে যেন চেপে ধরে আছে। আর একটানা ক্রিং ক্রিং শব্দ বেজে চলছে কলিংবেলের। আবিরের খুব রাগ উঠল। খেয়ে-দেয়ে মাত্র একটু মেঘলা আকাশকে পর্যবেক্ষণ করছিল এর মধ্যেই এই জ্বালাতন। নিশ্চয়ই কোন ফকির-টকির হবে। নইলে এতক্ষন ধরে কেউ বেল বাজায়?
আবির খুব জোরে দড়াম করে দরজাটা খুলে দিল। ক্রাচে ভর করে এক পঞ্চাশউর্ধ বয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার ডান পা নেই। লোকটার গোঁফ ইয়া বড়, ঠিক যেন মিলিটারিদের গোঁফের মত। পড়নে সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছেয়ে আছে। লোকটিকে এক মুহূর্ত দেখে ভিখারি মনে হল না আবিরের। তারপরও তাকে বলল মাফ করেন।
লোকটি মৃদু হেসে বলল, 'আমি ফকির না বাবা, আমার নাম হোসেন আলী। তোমার বাবাকে আমার নাম বললে চিনবে।'
লোকটির কথা শুনে আবিরের কিছুটা সন্দেহ হল। কারন এ রকম ছদ্মবেশে আজকাল অনেক চোর-ডাকাতরা ঘুরে বেড়ায়। সে দিন খবরের কাগজে একটা খবর ছাপা হয়েছিল, 'কীনব্রিজের নিচে যে লোকটা সারা গায়ে জখমী রোগী সেজে ভিক্ষা করতো সে একজন সুস্থ সবল মানুষ!' তাই আজকালকার মানুষদেরকে বিশ্বাস করা খুবই দায় হয়ে পড়েছে। কচি মনে মাঝে মাঝে অনেক বড় চিন্তা করে আবির। আজকাল খবরের কাগজ খুললেই শুধু মারামারি, হানাহানি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদিসহ আরও নানা অপকর্মে ছেয়ে গেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ এর যুদ্ধে স্বাধীন হওয়া এই সোনার দেশটা। আজ যদি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, মতিউররা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো তারা নতুন আরেক আন্দোলন করত। সে আন্দোলন হতো সন্ত্রাস আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আর সে আন্দোলনে তার মতো অনেক কিশোর আর তরুনেরাও যোগ দিত। এই সব চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে। লোকটির ডাকে আবার চেতনায় আসলো সে। তোমার বাবাকে ভিতরে গিয়ে বলো যে হোসেন আলী এসেছে। আমার নাম বললেই ও চিনতে পারবে।

লোকটার কথা শেষ হতে না হতেই আবিরের বাবা দরজার কাছে আসলেন। হোসেন আলীকে দেখে অবাক হওয়া খুশি হলেন তিনি। তাকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে এলেন।

ভিতরে ঢুকে তিনি সবাইকে ডাক দিলেন। আবিরের মা ও বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এ হচ্ছে আমার ছোটবেলার বন্ধু হোসেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই কথা শুনে তো আবির পুরা 'থ' হয়ে গেল। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সে ফকির ভেবেছে এই লজ্জায় সে আর উনার সামনে দাঁড়াতে পারেনি।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে বসে হোসেন আলী তার মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনাতে লাগলেন আবিরের মা ও বোনকে। আমাদের গ্রামের স্কুলে পাক হানাদাররা একটা ঘাঁটি পেতেছিল। এক রাতে আমরা তাদের ঘাঁটি আক্রমন করি। আমি একাই চারজনকে খতম করি। পায়ে একটা গুলি লেগে মারাত্মকভাবে জখম হই। পরে হাসপাতাল গেলাম ওখানে ডাক্তাররা আমার পা'টি কেটে দিয়েছে। এরপর থেকে এই ক্রাচ আমার সঙ্গী। এই ক্রাচে ভর করে পুরো দেশটা চষে বেড়াচ্ছি আমি। তোমাদের এই শহরে আমাদের গ্রামের মুক্তিযুদ্ধা সংগঠনের একটা কাজে এসেছিলাম, কিন্তু লাভ হলো না। ৩ বছর থেকে চেষ্টা করেও সংগঠনের জন্য একটা বিল পাশ করাতে পারলাম না। মনে হয় আরেকটা যুদ্ধ ছাড়া পারবোও না। এইবারের যুদ্ধ হলে তা হবে ক্ষমতায় বসে থাকা বংশীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

যুদ্ধের কাহিনী শেষ করে হোসেন আলী এবার উঠে দাঁড়ালেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন তিনি। আবির লজ্জায় উনার সামনে যেতে পারছিল না। হোসেন আলী ঘর থেকে বের হলেন। যাওয়ার শেষ মুহূর্তে এসে হঠাৎ কি মনে করে আবির দৌড় দিয়ে তার ছাতাটা এনে দিল হোসেন আলীকে, বৃষ্টি আসতে পারে বলে। হোসেন আলী তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ছাতাটা নিয়ে হাঁটতে থাকলেন। আবির দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো তার যাওয়া। ক্রাচে ভর করে ঠক ঠক করে হেঁটে যাচ্ছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

*********************************************************************
গল্পটা ২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল লিখা হয়েছে। তখন আমি অনেক ছোট। এস.এস.সি ও পাশ করিনি। মুক্তিযুদ্ধের একটা ছবি দেখা থেকে এই গল্পটা লেখার ইচ্ছাটা জাগে। ডাইরিতেই ছিল অনেক দিন এবার ব্লগের পাতায় চলে এলো!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:০২
২২টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×